আকবর আলী: দ্যা ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক

“বোন হারানোর শোক যখন আশ্রয় নেয় পতাকাতলে, তখন সে পতাকা হারে না, হারতে জানে না”- এমনটাই যখন বলছিলেন সাংবাদিক ফাহিম হাসান; পচেফস্ট্রুম জয়ের আনন্দে তখন নাচছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের অলিগলি। প্রথমবারের মত কোনো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতার আনন্দে মত্ত বাংলাদেশ। আকবর আলীর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে বাংলাদেশ জিতে নিয়েছে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা।

সময়টা ২০২০ সালের জানুয়ারি। বড়দের ক্রিকেটে যেনো লেগেছে শনির দশা। ক্রিকেটের কোনো ফরম্যাটেই সুবিধা করে উঠতে পারছিলো না বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এমন সময় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপটা বাংলাদেশের জন্য ছিল এক বিশ্বযুদ্ধের মতো। টুর্নামেন্ট শুরু হলে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলটি দেখাতে থাকে ক্রিকেটের সুদিন এখনও হারিয়ে যায়নি, বরং চমক অনেক বাকি। টুর্নামেন্টে জিম্বাবুয়ে, স্কটল্যান্ড, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় বাংলাদেশ। তাও আবার সবগুলো ম্যাচ জিতে নিয়ে, টুর্নামেন্টের অপরাজিত দল হিসেবে। ফাইনালে প্রতিপক্ষ– সেই শক্তিশালী ভারত, যাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের টানা তিন ফাইনাল ম্যাচ হারের ক্ষতটা তখনও দগদগে। আর এমন ঐতিহাসিক এবং উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচের দোরগোড়ায় দলের ক্যাপ্টেন জানতে পারলেন তার প্রিয় বোনটি আর বেঁচে নেই। আর হয়তো শোক হয়ে দাঁড়ালো কঠিন পথের পাথেয়।

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচের দৃশ্য; Image Courtesy: Scroll.in

বিশেষজ্ঞ ও দর্শকদের মতে, ম্যাচটিতে ক্রিকেটারদের উদ্দীপ্তকরণ থেকে শুরু করে বোলার পরিবর্তন, কৌশল এবং মনোবল বৃদ্ধি- সবটায় ছিল নিখুঁত ক্যাপ্টেন্সির ছোঁয়া। টস জিতে আগে বোলিং করার মত সঠিক সিদ্ধান্ত শুরুতেই নিয়ে নেন আকবর আলী। ম্যাচে অসাধারণ বোলিং, ফিল্ডিংয়ের পর বাংলাদেশ ব্যাটিংয়েও করে দারুণ এক শুরু। কিন্তু সময় গড়াতেই ভারতীয় স্পিনার বিশ্নয়ীর দারুণ বোলিং এ খেই হারাতে শুরু করে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা। ০ উইকেটে ৫০ রান থেকে বাংলাদেশের স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৬৫/৪ এ। সেখান থেকে ক্রমেই যেন পৌঁছে যায় খাদের কিনারা, ১৪৩/৭ এ! ১৭৭ রানের টার্গেট যেখানে মনে হচ্ছিল হাতের মুঠোয়, সেখানে ম্যাচের এ মুহূর্তে ভারত যেন পাচ্ছিল আবার একটি ফাইনাল জয়ের সুবাস। এমন শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের ত্রাতা হিসেবে ব্যাট হাতে রুখে দাঁড়ান কাপ্তান আকবর। ভারতের খেলোয়াড়দের স্লেজিং এর জবাব দিতে শুরু করেন তাচ্ছিল্যের হাসিতে, কঠিন বলগুলো মোকাবিলা করতে শুরু করেন ঠান্ডা মাথায়। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচটিতে মাঠ কামড়ে পড়ে থাকেন শেষ পর্যন্ত। অবশেষে লড়াই করে ছিনিয়ে নিয়ে আসেন কাঙ্খিত জয়। দলের এমন ডু অর ডাই মুহূর্তে ৪৭ রান, অসাধারণ উইকেটকিপিং আর দারুণ ক্যাপ্টেন্সির সুবাদে জিতে নেন অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যান অফ দ্যা ফাইনালের পুরস্কার। আর নিজ হাতে রচনা করেন বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের কাহিনী।

চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ; Image Courtesy: ICC

অথচ বাংলাদেশকে ট্রফি এনে দেয়া এ ডানহাতি ব্যাটসম্যানের কিন্তু প্রাথমিক স্কোয়াডে নাম ছিল না। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের জন্য শুরুতে দল নির্বাচনে বাদ পড়েছিলেন আকবর আলী। বিশ্বকাপ শুরুর কিছুদিন পূর্বে বিকেএসপিতে এক অনুশীলন ম্যাচে আকবর আলীর ব্যাটিং দেখে তাকে দলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ততদিনে দলের বাকি সবার পাসপোর্ট থেকে শুরু করে বাকিসব প্রস্তুতি নেয়া শেষ, একদম শেষ মুহূর্তে পাসপোর্ট, বোন টেস্টসহ সব নিয়মকানুন পূরণ করে আকবর আলী যোগ দেন বাকিদের সাথে।

ডানহাতি উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান আকবর আলী; Image Courtesy: ESPN

বিকেএসপিতে যাওয়ার আগে আকবর আলীর বেড়ে ওঠা তার জন্মস্থান রংপুর শহরের পশ্চিম জুম্মাপাড়া এলাকায়। জন্মগ্রহণ করেন ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর। শৈশব থেকেই তার ছিল ক্রিকেটে আগ্রহ। কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারেন ৫ ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ জোটানোই যেখানে তার বাবার জন্য কষ্টসাধ্য, সেখানে ব্যাট, বল, গ্লোভস, প্যাডের মত দামী ক্রিকেট অনুসঙ্গ কেনা প্রায় দুঃসাধ্য। তাই বলে হাল না ছেড়ে চেষ্টা চালাতে থাকেন ক্রমাগত। এরই পরিক্রমায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালে যোগ দেন রংপুরের আসিম মেমোরিয়াল ক্রিকেট একাডেমিতে। সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য ১০০টাকা ফিস দেয়ার মত অবস্থাও তার ছিল না। ট্রেনিং ও প্র্যাক্টিসে আকবর আলীর কঠোর পরিশ্রম ও ভাল পার্ফরম্যান্স দেখে অ্যাকাডেমি তার ট্রেনিং এর সব খরচ বহন করে। লায়ন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০১২ সালে ভর্তি হন বিকেএসপি এর দিনাজপুর রিজিওনাল সেন্টারে এবং ২০১৩ সালে যোগ দেন সাভার মেইন বিকেএসপি ক্যাম্পাসে। সেখানে অনূর্ধ্ব — ১৬, ১৭, ১৮ এসব বয়সভিত্তিক দলে খেলতে থাকেন। স্বপ্নের পরিধি বড় হতে থাকে ক্রমশই। আকবর আলী বিকেএসপি এর হয়ে টি-২০ অভিষেক করেন ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ এ। আর লিস্ট ‘এ’ অভিষেক হয় ৮ মার্চ, ২০১৯ এ। এভাবেই ২০১৮-১৯ ঢাকা প্রিমিয়াম ডিভিশন টি-২০ ক্রিকেট লিগে খেলা শুরু।

ফাইনাল ম্যাচে ব্যাটসম্যান আকবর আলী; Image Courtesy: ICC

ডিসেম্বরে প্রথমে প্রাথমিক দলে জায়গা না পেলেও হঠাৎই পেয়ে যান অনূর্ধ্ব- ১৯ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ। সুযোগটা বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাতে শুরু করেন আকবর আলী। তার নেতৃত্বে একের পর এক ম্যাচ জিততে থাকে বাংলাদেশ। শিরোপা ছোঁয়ার থেকে যখন কয়েক কদম দূরে, এমন সময় জানতে পারেন তার একমাত্র বড় বোনের মৃত্যুসংবাদ।

দলের সাথে ট্রফি হাতে আকবর আলী; Image Courtesy: News Age

২২ জানুয়ারি জমজ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান তার বোন খাদিজা খাতুন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা। এ খবর জানলে আকবর আলীর মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা খেলায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এমন আশংকায় তাকে এ সংবাদ জানানো হয়নি। দেশের স্বার্থে তার পরিবার এই খবর গোপন রাখে। তবুও কোনোভাবে এ খবর জেনে যান তিনি। বাংলাদেশে ফোন করে খবরের সত্যতা জানেন এবং অবশেষে নিশ্চিত হন তার বোন আর বেঁচে নেই। কিন্তু তখন বাংলাদেশ যে ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। দেশের প্রতি এ দায়িত্ব এড়ানো যায়না কিছুতেই। এড়াননি আকবর আলীও। বরং পাহাড়সম শোক তাকে দিয়েছে পর্বতসম দৃঢ়তা ও স্থিরতা। নিজে খেলেছেন, দলকে দিয়ে খেলিয়েছেন, একদম শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে দেখিয়েছেন ফাইনাল কোনো জুজু নয়। আমরা চাইলে কী না করতে পারি! প্রমাণ করেছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মহান বাণী, “Man can be Destroyed but Not Defeated.”

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ২০২০ জয়ী বাংলাদেশ দল; Image Courtesy: ICC

এমন এক সময় দেশকে ট্রফি এনে দিয়েছেন, পদ্মা মেঘনার ক্রিকেট যখন প্রশ্নবিদ্ধ। সকল প্রতিকূলতা কাটিয়েই রংপুরের ছেলেটি কোটি কোটি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন ‘আকবর দ্য গ্রেট’। আর আকবর দ্য গ্রেটের কথায়, “এটা কেবলই শুরু!”

Feature Image Courtesy: tbsnews.net

References:

  • Prothom Alo
  • ICC
  • TBS News
  • ESPN