শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল ১৯২৬-২৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করলেও তারা ১৯৮১ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরই আইসিসির পুর্ণ সদস্যভুক্ত দেশ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা বিশ্ব ক্রিকেটে একটি সাধারণ দলের মতোই ক্রিকেট খেলেছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে শ্রীলঙ্কা সবেমাত্র বড় কয়েকটি দলের বিপক্ষে জয় পেতে থাকে। কিন্তু তা স্বত্বেও সকল ফেভারিট দলকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটা সে সময় পুরো বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কা দলের এমন ঈর্ষনীয় পরিবর্তন রাতারাতি কিন্তু সম্ভব হয়নি। শ্রীলঙ্কা দলের এই অবিস্মরণীয় পরিবর্তনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন আর্জুনা রানাতুঙ্গা। যার নেতৃত্বে বিশ্বের বাঘা বাঘা দলগুলোকেও চোখ রাঙিয়ে জয় তুলে নেওয়ার স্পর্ধা দেখানোর আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করেছিল তৎকালীন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর্জুনা রানাতুঙ্গার ওয়ানডে অভিষেক হয় ১৯৮২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সে ম্যাচে ৫৩ বলে ৪২ রান করে রান আউট হন তিনি। অবশ্য সে ম্যাচটি ৩ রানে জিততে সমর্থ হয় শ্রীলঙ্কা। একই বছরের ১৭ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই। তার অভিষেক টেস্টেও তিনি দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন বেশ ভালোভাবেই। প্রথম ইনিংসে ৩৪ রানে ৪ উইকেট হারানো শ্রীলঙ্কা দলকে সাময়িক ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি এবং ৫৪ রানের একটি চমৎকার ইনিংস খেলেন।

অর্জুনা রানাতুঙ্গা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হওয়ার সুযোগ পান ১৯৮৮ সালে। তিনি যখন শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক হন, তখন শ্রীলঙ্কা একটি সাধারণ দলের মধ্যেই একটি ছিল। কিন্তু তার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বদলে যায় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের মুখ এবং সে কারণেই হয়ত শ্রীলঙ্কা দল একটি মাঝারি মানের দল থেকে বড় দল হয়ে উঠে অর্জন করেছিল বিশ্বসেরা হওয়ার গৌরব। তার অধীনেই শ্রীলঙ্কা দলে জায়গা জায়গা পেয়েছিল চামিন্দা ভাস, মুত্তিয়াহ মুরালিধরন, মহেলা জয়াবর্ধনের মতো খেলোয়াড়েরা যারা পরবর্তীতে নিজেদের কিংবদন্তীদের কাতারে নিয়ে গেছেন। এছাড়াও তার আমলে নিজের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে নতুন করে জন্ম হয়েছিল লঙ্কান কিংবদন্তী ওপেনার সানাথ জয়সুরিয়ার। পুরো বিশ্বে আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্ব এবং ক্রিকেটের পরিচায়ক হয়ে উঠেছিলেন রানাতুঙ্গা।
চামিন্দা ভাস
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চামিন্দা ভাসের অভিষেক ঘটে ১৯৯৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি অর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে। ভাস নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৭৬১টি উইকেট লাভ করেন যা তাকে করেছে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা পেস বোলিং কিংবদন্তী।

সানাথ জয়সুরিয়া
সানাথ জয়সুরিয়াকে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম সেরা কিংবদন্তী ক্রিকেটার হিসবে ধরা হয়। তার মারকুটে ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা জিতেছে বহু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলা ছিলো তার ব্যাটিংয়ের মূলমন্ত্র। কিন্তু নিজের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ছিলেন না। তিনি একজন অলরাউন্ডার হিসবে দলে নিযুক্ত ছিলেন যার কাজ ছিলো মিডেল অর্ডারে ব্যাটিং করে ইনিংসের শেষের দিকে দ্রুত রান করা। কিন্তু ক্যাপ্টেন রানাতুঙ্গার ক্রিকেটীয় স্বভাবই ছিলো আক্রমণাত্মক।

তাই আর্জুনা ইনিংসের শুরু থেকেই প্রতিপক্ষ দলকে চাপে ফেলে আগ্রাসী ব্যাটিং করার গুরুদায়িত্ব দিয়ে মিডেল অর্ডার থেকে উপরে উঠিয়ে ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করান জয়সুরিয়াকে। সানাথ জয়সুরিয়ার এই আক্রমনাত্মক ব্যাটিং শ্রীলঙ্কাকে ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জেতাতে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জয়সুরিয়া শ্রীলঙ্কার হয়ে আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেটে সব থেকে বেশি ২৮টি সেঞ্চুরি করেছেন। সানাথ জয়সুরিয়া তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ২১,০৩২ রান করেন যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম ব্যাটিং কিংবদন্তী হিসবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। হয়তো তাকে রানাতুঙ্গা ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করার সুযোগ না দিলে তিনি একজন মাঝারি মানের খেলোয়াড়ই হয়ে থাকতে পারতেন।
মাহেলা জয়াবর্ধনে
শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের অন্যতম কিংবদনন্তী ক্রিকেটার হলেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। মাহেলা জয়াবর্ধনেরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় আর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বেই ১৯৯৭ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে। অর্থাৎ সেই রানাতুঙ্গার আমলেই জন্ম হয় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তীর। জয়াবর্ধনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৫,৯৫৭ রান করেন যা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে পৌঁছে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।

মাহেলা জয়াবর্ধনের সাথে আর্জুনা রানাতুঙ্গা; Image Courtesy: timescontent.com
মুত্তিয়া মুরালিধারান এবং আর্জুনার ঐতিহাসিক প্রতিবাদ
মুত্তিয়া মুরালিধারানকে হয়ত সর্বকালের সেরা স্পিন বোলার বললে তেমন আপত্তি করার মানুষ থাকবে না। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পরিসংখ্যান দেখে যে কেউই তাকে সর্বকালের সেরা বোলার হিসবে অভিহিত করতে পারেন। মুরালিধারান তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে অন্য যেকোনো বোলার থেকে সবচেয়ে বেশী ১৩৪৭টি উইকেট লাভ করেন। এই মুরালির কারণে বিশ্বক্রিকেটে অন্য যেকোনো দল তৎকালীন শ্রীলঙ্কা দলের বোলিং আক্রমণকে সমীহের চোখে দেখতেন। কিন্তু কিছু ক্রিকেটীয় মাফিয়ার বেড়াজালে আটকে অচিরেই শেষ হতে পারত তার ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ার। গল্পের শুরু ১৯৯৫ সালে। মাত্রই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রবেশ করেছিলেন মুরালি। সে সময় আইসিসির একটা নিয়ম ছিলো যে, বোলিং করার সময় বল হাত থেকে ছাড়ার সময় হাত নিচু করা যাবে না। কিন্তু তখন প্রযুক্তি তেমন একটা উন্নতর না থাকার কারণে বোলারের বোলিং করার সময়ে সে সিদ্ধান্ত আম্পায়ারকেই নিতে হতো।

১৯৯৫ সাল, মেলবোর্ন টেস্ট। আম্পায়ার ছিলেন ডেরেল হেয়ার। মুরালি যখন বোলিং করতে আসলেন, তখনই আম্পায়ার ডেরেল হেয়ার মুরালির বোলিং একশনকে সন্দেহজনক ঘোষণা করে একের পর এক নো বল দিতে শুরু করে। শুধু ডেরেল হেয়ার নয়, এরপরেও বেশ কিছু ম্যাচে আম্পায়ার এমারসন তার বোলিং একশনকে অবৈধ বলে তার বলে একের পর এক নো বল ঘোষণা করতে থাকেন। এরপর এলো সাল ১৯৯৮। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা, যে জয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন মুরালি। ইতোমধ্যে আইসিসির দেয়া বোলিং একশন টেস্টে কার্যকর হন মুরালি যার মাধ্যমে আইসিসির দ্বারা তার বোলিং একশন একদম বৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পুনরায় একটি ওয়ানডে ম্যাচে আবারও মুরালির বোলিং একশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং পুনরায় মুরালির বোলিং করা বোলিংয়ে একের পর এক নো বল ঘোষণা দিতে থাকেন।

কিন্তু এবার আর কোনো প্রকার অন্যায় সহ্য করলেন না আর্জুনা। তিনি ম্যাচের মধ্যেই আম্পায়ারের সে দৃষ্টিকটু আম্পায়ারিং দেখে ম্যাচটি বয়কটের সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে পুরো টিম নিয়ে ম্যাচ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরপর আম্পায়াররা এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বড় কর্তারা অনেক চেষ্টার পর ম্যাচটি আবারো মাঠে গড়ায়।
আর্জুনার ধারণা ছিলো এই যে, যেহেতু পুরো বিশ্বে মুরালির বোলিং নিয়ে কোনো সমস্যা নেই তাহলে মাত্র দুইজন আম্পায়ারকে ভয় করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। এরপর মুরালির বোলিংয়ে আর কোনো প্রকার বাজে আম্পায়ারিং দেখা যায়নি। রানাতুঙ্গা যখন মুরালির সাথে এমন অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেন, তখন মুরালি শ্রীলঙ্কা দলের এক তরুণ খেলোয়াড়। যদি রানাতুঙ্গা ক্যারিয়ারের সবথেকে কঠিন সময়ে মুরালির পাশে না দাড়াতেন তাহলে সে তরুণ মুরালি আজকের স্পিন বোলিং কিংবদন্তী মুত্তিয়া মুরালিধারাণ হওয়ার আগেই হয়তো ফুরিয়ে যেতেন।

ব্যাটসম্যান আর্জুনা রানাতুঙ্গা
আর্জুনা রানাতুঙ্গা শুধু একজন কিংবদন্তী অধিনায়কই ছিলেন না বরং ছিলেন একজন দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান। তার হাত ধরে শ্রীলঙ্কা অতিক্রম করেছে বহু কণ্টকময় পথ এবং ছিনিয়ে এনেছে বিজয়ের লাল সূর্য। রানাতুঙ্গার হাত ধরে শ্রীলঙ্কা সর্বপ্রথম বিশ্বসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শুধু তার বিচক্ষণ অধিনায়কত্বই নয় বরং তার অসাধারণ ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ের মাধ্যমেও দলকে বিশ্বসেরা করতে এক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সেই বিশ্বকাপে নিজ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সব থেকে বেশি ১২০.৫০ গড়ে রান করেন। সে বিশ্বকাপে নিজ দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক না হলেও তার ব্যাটিং গড়ই উক্ত বিশ্বকাপে তার ধারাবাহিকতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা দলের খারাপ পারফর্মেন্সের কারণে রানাতুঙ্গাকে অধিনায়কত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। রানাতুঙ্গা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টের মাধ্যমে।
আর্জুনা রানাতুঙ্গা তার আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ারে ৩৫.৭০ গড়ে ৪ সেঞ্চুরি ও ৩৮টি ফিফটির বিনিময়ে ৫১০৫ রান করেন এবং ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩৫.৮৫ গড়ে ৪ সেঞ্চুরি ও ৪৯টি ফিফটির বিনিময়ে ৭৪৫৬ রান করেন যা তার অসাধারণ ব্যাটিং দক্ষতার পরিচয় বহন করে।
আর্জুনা রানাতুঙ্গা তার অবসর পরবর্তী জীবনে একজন ধারাভাষ্যকারের পেশা গ্রহণ করলেও বর্তমানে তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত রয়েছেন।

একজন অধিনায়ক হয়েও পুরো দলের মনোবল বাড়িয়ে একটি মাঝারি মানের দলকে কীভাবে বিশ্বসেরার কাতারে পৌঁছানো যায় কিংবা নিজ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিমত্তার দলের বিপক্ষে খেললেও কীভাবে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে জয় ছিনিয়ে আনতে হয় তাই ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়েছেন রানাতুঙ্গা। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার আক্রমণাত্মক ক্রিকেটের মহড়ার পর থেকেই বদলে যায় বিশ্ব ক্রিকেটের গতিপথ এবং সেই আক্রমনাত্মক ক্রিকেটের এক অনন্য কারিগর হিসেবেই পুরো ক্রিকেট বিশ্ব আজও আর্জুনাকে কিংবদন্তীর কাতারে বসিয়ে রেখেছে।
Feature Image Courtesy: khela71.com