বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ১৯৭১ সালের ১৩ ও ১৪ই ডিসেম্বর। বাঙালিকে মেধাশূন্য করার যে জঘন্য নীলনকশা পাকিস্তানি বাহিনী তৈরি করেছিল, তারই দলিল হয়ে ইতিহাসের পাতায় এ দুটো দিন স্থান করে নিয়েছে। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বেয়নেটের সামনে যে সকল বুদ্ধিজীবী এ দিন দুটিতে বলি হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সাংবাদিক সেলিনা পারভীন অন্যতম। একাত্তরে কলম সৈনিক হিসেবে যিনি পুরোটা সময় নিভৃতে যুদ্ধ করে গেছেন। সেলিনা পারভীনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৩১ শে মার্চ লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জের কল্যাণনগর গ্রামে। বাবা মৌলভী আবিদুর রহমান তৎকালীন গুরু ট্রেনিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নাম ফেনী প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। আর মা সাজেদা খাতুন ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেলিনা পারভীনের পৈতৃক নিবাস ছিল ফেনী জেলায়। নয় ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। তার ডাকনাম ছিল মনি। ছোটবেলা থেকেই বেশ চঞ্চল ছিল মনি। গানের প্রতিও বিশেষ ভালো লাগা ছিল তার। বেলী ফুল ছিল তার প্রিয়। ভালোবাসত অন্যকে সাজাতে আর নিজে সাজতে।

নির্ভীক কলম সৈনিক ছিলেন সেলিনা পারভীন; Image Courtesy: womennews24.com

ছোট্ট মনির জীবনপ্রবাহ ততটা সরল ছিল না। ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় (তৎকালীন সরলা বালিকা বিদ্যালয়) থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি শুরু হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার পরিবার ছোট কল্যাণনগরে চলে গেলে তার শিক্ষাজীবনে ছেদ ঘটে। এদিকে ১৯৪৩ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সী ছোট্ট মনিকে তার বাবা হঠাৎ বিয়ে দিয়ে দেন। নিজের মতের বিরুদ্ধে হওয়া এ বিয়েতে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে কোনোরকম আগ্রহ ছিল না মনির। তাই সংসারটা আর করা হয়ে ওঠেনি। পাঁচ বছর পর কতক নিজের ইচ্ছাতেই ইতি টেনে দেন তার প্রথম সংসার জীবনের।

জীবনে বারবার হোঁচট খেয়েছেন সেলিনা পারভীন; কিন্তু কখনো পরাজয় স্বীকার করেননি; Image Courtesy: exclusiveadhirath.com

এরই মধ্যে দেশে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। সেলিনা পারভীনের পুরো পরিবার তার জন্মস্থান রামগঞ্জে পাড়ি জমায়। দেশ ভাগের পর তারা আবার ফেনীতে চলে আসেন। আবার পড়াশোনা শুরু করেন মনি। বই পড়তে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসতেন। কখনো ছোট ভাইদের দিয়ে পাড়ার পাঠাগার থেকে বই নিয়ে আসতেন, কখনও বা নিজেই টাকা জমিয়ে বই কিনতেন। বই পড়ার পাশাপাশি কবিতা লেখার প্রতিও প্রবল আগ্রহ ছিল তার। ছোটবেলায় পারিবারিক আসরগুলোতে মা ও ভাইবোনদের বই থেকে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাত ছোট্ট মনি। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহের সেই শুরু। তবে ১৪ বছর বয়সে কলকাতার শিক্ষয়ীত্রী উমার সংস্পর্শে এসেই সাহিত্যের সুবিশাল জগতে অনুপ্রবেশের ইচ্ছা তার মধ্যে তীব্র হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা ছাড়াও নিবন্ধ ও প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল সেলিনা পারভীনের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও ১৯৪৯ সালে পরিবারের ইচ্ছাতে ছোট বোন জেবুন্নেসার সঙ্গে মেট্রিক পরীক্ষা দেন সেলিনা পারভীন। যদিও সে পরীক্ষায় তিনি পাস করতে পারেননি। এরপর আর শিক্ষাজীবনের গন্ডিতে নিজেকে আটকে রাখার চেষ্টা করেননি তিনি। ফেনীতে ছাত্র পড়ানোর মধ্য দিয়ে নিজেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করান এই মহীয়সী নারী। ১৯৫৬ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন তিনি। আপসহীন কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ী এক নারী সত্তা ছিলেন সেলিনা পারভীন। তার এ দৃঢ় মানসিকতাই কাল হয়েছিল তার কর্মজীবনে। কোন চাকরিতেই দীর্ঘদিন থিতু হতে পারেননি তিনি।

পিআইবির শহীদ সাংবাদিক স্মৃতিফলক এ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন এর ছবি; Image Courtesy: banglatribune.com

১৯৫৭ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে (তৎকালীন মিটফোর্ড হাসপাতাল) নার্সিং এর ওপর প্রশিক্ষণ নেন সেলিনা পারভীন। ১৯৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে পরিচালক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। আজিমপুরে বেবিহোমে ১৯৬০-৬১ সালে শিক্ষকতা করেন। এরই মধ্যে ১৯৬২ সালে আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। ১৯৬৩ সালে একটি পুত্র সন্তান হয় তার। কিন্তু কর্মজীবনের মতো সংসার জীবনেও বেশিদিন স্থায়ী হতে পারলেন না। ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয় বারের মতো বিচ্ছেদ ঘটে তার বৈবাহিক জীবনের। কিছুদিন সলিমুল্লাহ এতিমখানাতে চাকরি করলেও পরে সব ছেড়ে অসুস্থ সন্তান আর নিজের স্বপ্নকে সঙ্গী করে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেন সেলিনা পারভীন। লেখালেখিই ছিল সেলিনা পারভীনের একমাত্র বন্ধু। আর এ বন্ধুকে কখনো নিজের থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে দেননি তিনি। ১৯৬৬ সালে তার যে নবযাত্রা শুরু হয়েছিল সেখানে লেখালেখিকেই প্রধান হাতিয়ার করে সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকায় সম্পাদিকার সহকারী হিসেবে যোগদান করেন তিনি। তখন থেকেই নিয়মিত নিবন্ধ, প্রতিবেদন ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে মস্তিষ্কের খুরধার তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে তার। পাশাপাশি ‘ললনা’ নামের আরেকটি পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন সেলিনা পারভীন এবং আমৃত্যু এ পত্রিকার হয়ে তিনি কাজ করে গেছেন।

‘শিলালিপি’ পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে সেলিনা পারভীন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন; Image Courtesy: barta24.com

পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে তৎকালীন ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলে অনেকের সাথেই ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে সেলিনা পারভীনের। এ সময় ‘শিলালিপি’ নামের একটি পত্রিকা বের করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। মূলত দেশের খ্যাতনামা লেখকদের লেখা প্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে জাগরণ তৈরির একটি প্রচেষ্টা ছিল এ পত্রিকা। নিজের সামান্য বেতন দিয়ে পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজ করতে থাকেন তিনি। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আর প্রকাশিত হওয়ার পরপরই বাঙালি বিশিষ্ট মহলের নজর কেড়েছিল এ পত্রিকা। এদিকে ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পত্রিকাটির কাজ চালিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল।


স্বাধীনতার স্বপক্ষে লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে পত্রিকাটির ক্রমাগত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। এছাড়াও পত্রিকাটির কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন কিনা তা নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। তবে সেলিনা পারভীন ছিলেন এক লড়াকু নারী। হার মানতে তিনি নারাজ ছিলেন। অবশেষে একাত্তরের আগস্টে বের হয় পত্রিকার আরেকটি সংখ্যা। আর এ সংখ্যা দিয়েই পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর কুনজরে পড়ে যান খ্যাতনামা এই নারী সাংবাদিক। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো ও শিল্পী হাশেম খানের আঁকা প্রচ্ছদের স্বাধীনতার বার্তাই তার জীবনে কাল হয়ে এসেছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পত্রিকাটির প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। অথচ ‘শিলালিপি’ পত্রিকা বিক্রির টাকা দিয়েই সেলিনা পারভীন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, কাপড়, ঔষধ ইত্যাদি সংগ্রহ করতেন। এছাড়া লেখিকার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত আনাগোনার খবরও পৌঁছে যায় পাকিস্তানি শাসকদের কাছে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করেছে সেলিনা পারভীন; Image Courtesy: somewhereinblog.com

এ খবর জানতে পেরে সশরীরে লেখিকাকে তলব করেন। কতকটা দিশেহারা হয়েই প্রবল চাপের মুখে সেলিনা পারভীন দেখা করেন রাও ফরমান আলীর সাথে যিনি ছিলেন পরবর্তী সময়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান হোতা। পত্রিকাটি প্রকাশের ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শর্ত ছিল শিল্পী হাশেম খানের আঁকা প্রচ্ছদটি পরিবর্তন করতে হবে। একই সাথে পত্রিকায় যে সকল লেখা ছাপা হয়েছিল তা নিয়েও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। মূলত সেদিনই পাকিস্তানিদের নৃশংস হত্যাকান্ডের তালিকায় সেলিনা পারভীনের নাম যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর। সেলিনা পারভীন সেই সময় তার ছেলে সুমন, ছোট ভাই উজির ও মাকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরীর ১১৫ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে তার বাড়িতে থাকতেন। সেদিন সকালে তাঁরা সবাই ছাদে ছিলেন। ছেলের গায়ে তেল মাখিয়ে দিয়ে সেলিনা পারভীন ছেলেকে খেলতে বলে লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এরই মধ্যে মুখে কাপড় বাঁধা কিছু লোক তার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। সবগুলো লোকই একই রঙের পোশাক পরা ছিল। লোকগুলো প্রথমে লেখিকাকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তারপর কিছুক্ষণ লেখিকার সাথে কথা বলে এবং তাকে তাদের সাথে যেতে বলে।

মগবাজার মোড় থেকে মৌচাক মোড় পর্যন্ত সড়কটির নাম করা হয়েছে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক’; Image Courtesy: prothomalo.com

কিন্তু বাইরে তখন কারফিউ চলছিল। সেলিনা পারভীন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে তাদের সাথে গাড়ি আছে। লেখিকার ছোট্ট ছেলেটি তাকে জড়িয়ে ধরে বলে সেও তার সাথে যেতে চায়। উত্তরে লেখিকা বলেন, “না, বাবা। তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিয়ো। আমি যাব আর আসব।” এই ছিল তার ছেলেকে বলা জীবনের শেষ কথা। এরপর লোকগুলো কাপড় দিয়ে চোখ ও হাত পিছমোড়া করে বেঁধে তাকে নিয়ে যায়। এরপর আর প্রিয় মানুষদের কাছে ফেরা হয়নি তার।   
১৪ ডিসেম্বর অন্যান্য সকল বুদ্ধিজীবীর সাথে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকেও নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালাল আল-বদর বাহিনী। তাকে এতটা পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছিল যে তার চেহারা চেনার কোনো উপায় ছিল না। তার মুখ ও নাক নরপিশাচেরা থেঁতলে দিয়েছিল। পুরো শরীরে ছিল ক্ষতের চিহ্ন। সারা শরীর দগদগে জমানো রক্তে ভেজা ছিল। শীতকাতুরে এই লেখিকার পায়ের সাদা মোজা দেখেই তার স্বজনেরা রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তার লাশ শনাক্ত করে। ১৮ ডিসেম্বর তাকে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে সমাহিত করা হয়।

রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের নৃশংস মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল; Image Courtesy: somewhereinblog.net

বাংলার ইতিহাস যতদিন থাকবে ততদিন সেলিনা পারভীনের মতো দেশপ্রেমিক সৈনিকদের নাম ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর হয়ে থাকবে। বেয়নেটের গুলির আঘাতে পাক বাহিনী হয়ত সেলিনা পারভীনের দেহকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল কিন্তু বাংলা মায়ের বুক থেকে তার সূর্য সন্তানের অস্তিত্বকে মুছে দিতে পারেনি। যে লাল-সবুজের পতাকা অর্জনের জন্য এ আত্মত্যাগ করেছিলেন সেলিনা পারভীন, আজও সেই পতাকার প্রতিটি বুনন তাকে স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধায়।


Feature Image Courtesy: jaijaidinbd.com