বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা সাহিত্যের অনন্যসাধারণ নাম। দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত বেগম রোকেয়া বাংলার অন্ধকারে থাকা নারী সমাজকে মুক্তির সত্য সুন্দর পথে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে তাদের জন্য একটি উজ্জ্বল আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর এই আত্মত্যাগ কেবল সমাজসেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তার চেতনার বিমূর্ত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই সাহিত্য সাধনার মধ্যেও। চিন্তার গভীরতা এবং সৃষ্টির প্রসারতা তার প্রতিটি রচনা আমাদের জাতীয় জীবনে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। বাস্তব জগতে তো অনেক দূরের কথা, যখন বাঙালি নারীর স্বপ্নের বা চিন্তার জগতেও স্বাধীনতাও ছিল না, তেমনি একটা সময়ে অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে ও নারী মুক্তির-নারী স্বাধীনতার কথা বলেছন মহিয়সী এই নারী।
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে রোকেয়ার জন্ম হয়। তার পিতা জহির মোহাম্মদ আবু আলী সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন।
পায়রাবন্দ গ্রামে সাড়ে তিনশত বিঘা জমির মাঝখানে ছিল তাঁর সুবৃহৎ বসতবাড়ি। সাবের সাহেব বিলাসী, অপব্যয়ী ও রক্ষণশীল ছিলেন। তার দুই পুত্র আবুল আসাদ ইব্রাহীম সাবের ও খলিল সাবের এবং তিন কন্যা: করিমুন্নেসা, রোকেয়া ও হোমেরা। দুই পুত্র কলকাতা সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন, তাদের মনের উপর ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার প্রচুর প্রভাব পড়ে। জৈষ্ঠ ইব্রাহীম সাহেবের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে করিমুন্নেসা ও রোকেয়া ইংরেজি শিক্ষায় অনেকখানি অগ্রসর হয়। রোকেয়া তার উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’ এই অগ্রজের নামে উৎসর্গ করতে গিয়ে বলেন, “দাদা। আমাকে তুমিই হাতে গড়িয়া তুলিয়াছ।”

বেগম রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসার জন্ম ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে এবং মৃত্যু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে। বাল্যকালে বাংলা পুস্তক পাঠের প্রতি করিমুন্নেসার অত্যধিক আসক্তি দেখে তার ‘পড়াই বন্ধ’ করে দেওয়া হয় এবং তাকে ‘বালিয়াদীতে মাতামহের প্রসাদে’ পাঠিয়ে দিয়ে তার বিবাহের আয়োজন হতে থাকে। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ময়মনসিংহের দেলদুয়ারে তার বিবাহ হয়ে যায়। দুঃখের বিষয়, বিবাহের ৯ বছর পরেই তিনি বিধবা হন। তার দুই দেশখেত পুত্র: স্যার আব্দুল করিম গজনভী ও স্যার আব্দুল হালিম গজনভী তার প্রেরণা ও তত্ত্বাবধানে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এই মহীয়সী মহিলার নামে বেগম রোকেয়া তার ‘মতিচূর’ দ্বিতীয় খন্ড উৎসর্গ করেন। তিনি উৎসর্গ পত্রে উল্লেখ করেন যে, বাল্যে তার বাংলা ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে আনুকূল্য করেছিলেন একমাত্র করিমুন্নেসা এবং ১৪ বছর ভাগলপুরে ও কলিকাতায় ১১ বছর উর্দু স্কুল পরিচালনাকালে বাংলা ভাষার পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েও তিনি যে বাংলা সাহিত্যের অনুশীলন অব্যাহত রাখতে পেরেছেন তা কেবল করিমুন্নেসার প্রেরণায়।
বেগম রোকেয়া আনুমানিক ১৬ বছর বয়সে বিহারের অন্তর্গত ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। সাখাওয়াত হোসেন তখন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তৎপূর্বে তিনি কৃষি শিক্ষার বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন এবং অনেকগুলো প্রাইজ ও মেডেল নিয়ে এসেছিলেন। স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশ ক্রমেই তিনি সেই বৃত্তি লাভ করেছিলেন। ভূদেবের পুত্র শ্রীমুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন হুগলি কলেজ (১৮৭৪-৭৫) ও পাটনা কলেজে (১৮৭৭) সাখাওয়াত হোসেনের সহাধ্যায়ী ও ঘনিষ্ঠ সুহৃদ। সাখাওয়াতের প্রথম বিবাহ হয়েছিল তার মাতার পছন্দমতো বিহারের এক আত্নীয়-ঘরে। সেই স্ত্রী অল্পবয়সেই একটি মাত্র কন্যা রেখে মারা যান।

মুকুন্দদেব লিখেছেন-
“সখাওয়াত সেই কন্যার একটি বি.এ. পাশ করা ছেলের সহিত বিবাহ দিয়াছিল; সে কন্যাটিও এখন আর জীবিত নাই।” [১৯১৬]
“বিপত্নীক হইয়া সখাওয়াত দ্বিতীয়বার রংপুরে সম্ভ্রান্ত ঘরে সুশিক্ষিতা বাঙ্গালি মুসলমান কন্যা বিবাহ করেন। …দ্বিতীয় বিবাহে কোন সন্তান জীবিত থাকে নাই। কিন্তু দ্বিতীয় পত্নী ইংরাজী ও বাঙ্গালায় বিশেষ ব্যুৎপন্না এবং সুগৃহিণী এবং ধীর গম্ভীর সখাওয়াত পারিবারিক জীবনে সুখী হইয়াছিল।”
“মিতব্যয়ী সখাওয়াতের সত্তর হাজার টাকা সুঞ্চিত হইয়াছিল। তিনি পত্নীর দ্বারা একটি মুসলমান বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ১০ হাজার টাকা দিবেন। পত্নীকে দশ হাজার দিবেন এবং বাড়ী এবং অধিকাংশ টাকা কন্যাকে জীবদ্দশায় লিখিয়া দিবেন এইরূপ পরামর্শ স্থির করিয়াছিলেন এবং সেইরূপই অনেকটা করিয়াছিলেন বলিয়া শুনিয়াছি। কলিকাতায় চিকিৎসাৰ্থ গিয়া সখাওয়াতের দেহান্ত হয়। সুশিক্ষিতা মিসেস রোকেয়া হোসেন এইরূপ ইংরাজী শিখিয়াছিলেন যে, সখাওয়াতের কথামত ইংরাজীতে লিখিয়া তাঁহার সরকারী কার্যের অনেকটাই সাহায্য করিতে পারিতেন এবং বাঙ্গালাতে মহরম সম্বন্ধে একখানি ও মতিচূর নামে আর একখানি পুস্তক লিখিয়াছিলেন! পত্নীর সাহায্যে তাহার পারিবারিক জীবন সুখের হইয়াছিল বলিয়া তিনি মুসলমানদের বহু – বিবাহ, নাচ মুজরা প্রভৃতির প্রকৃত প্রতিষেধক ভাবে স্ত্রীশিক্ষার একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁহার অসামান্য এবং পতিব্রতা পত্নী স্বামীর সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য কলিকাতায় বালিকা – বিদ্যালয় পরিচালনা করিয়া পৰিত্ৰাত্মা স্বর্গীয় সখওয়াতের স্মৃতির পূজা করিতেছেন।” (আমার দেখা লোক, ১৩-৩৪ পৃঃ)

বেগম রোকেয়া তাঁর ‘বায়ুযানে পঞ্চাশ মাইল’ লেখাটিতে বলেছেন যে, ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে ‘Sultana’s Dream’ রচিত হয়। ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দেই তাঁর ‘মতিচূর’ প্রকাশিত হয়। তার বিজ্ঞাপন- এ বলা হয়: “মতিচুরের প্রবন্ধসমূহ পূর্বে ‘নবপ্রভা’, ‘মহিলা’ ও ‘নবনূর’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল।” তাতে অন্তর্ভুক্ত সাতটি প্রবন্ধের মধ্যে ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’, ‘নিরীহ বাঙ্গালী’, ‘অর্ধাঙ্গী’, ‘বারেকা ও গৃহ’ যথাক্রমে ১৩১১ ভাদ্রে, ১৩১০ মাঘে, ১৩১১ আশ্বিনে, ১৩১১ বৈশাখে ও ১৩১১ আশ্বিনে নবনূরু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম প্রবন্ধ: ‘পিপাসা’ ১৩২৯ সালের ১৬ ভাদ্র তারিখে কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদিত ১ম বর্ষের ৭ম সংখ্যক (বিশেষ ‘মোহররম সংখ্যা’) অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধুমকেতু’তে পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে ‘মতিচূর’ দ্বিতীয় খণ্ড আত্মপ্রকাশ করে। তাতে ১০ টি প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তন্মধ্যে ‘নূর – ইসলাম’ ১৩২২ জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ়ের আল-এসলামে, ‘সৌরজগৎ’ ১৩১২ ফাগুন ও চৈত্রের নবনূরে, ‘নারীসৃষ্টি’ ১৩২৫ পৌষের ও ‘নার্স নেলী’ ১৩২৬ অগ্রহায়ণের সওগাতে, ‘শিশুপালন’ ১৩২৭ কার্তিকের, ‘মুক্তিফল’ ১৩২৮ শ্রাবণের ও সৃষ্টিতত্ত্ব ১৩২৭ শ্রাবণের বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য – পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩১৬ বৈশাখের তৃতীয় সপ্তাহে রোকেয়ার স্বামী লোকান্তরিত হন। অতঃপর ৫/৬ বৎসর কাল রোকেয়ার লেখনী প্রায় স্তব্ধ ছিল এবং এক ‘সৌরজগৎ’ ছাড়া ‘মতিচূর’ গ্রন্থের অবশিষ্ট লেখাগুলো পরবর্তী পর্যায়ে রচিত। এই পর্যায়ে তাঁর রচনায় তীব্রতা হ্রাস হয়ে ‘হিউমার’ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
১৯০৮ খ্রীস্টাব্দে ‘Sultana’s Dream’ পুস্তিকা-আকারে বের হয়; লেখিকাকৃত তারই বঙ্গানুবাদ: ‘সুলতানার স্বপ্ন’। বেগম রোকেয়া ‘অবরোধবাসিনী’ শিরোনামে ‘অবরোধের’ বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা পাঠিকা ভগিনীদিগকে উপহার দেন ১৩৩৫ কার্তিক, ১৩৩৬, ভাদ্র, ১৩৩৭ শ্রাবণ ও ১৩৩৭ ভাদ্রের মাসিক মোহাম্মদীতে।

‘মতিচূর’ ১ম ও ২য় খণ্ড, ‘Sultana’s Dream’, ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধবাসিনী’ প্রভৃতি কয়েকখানা গ্রন্থে তাঁর জীবনের ঐকান্তিক স্বপ্ন অভিনব রূপ লাভ করিয়া আছে। ‘মতিচূর’ ২য় খণ্ডে সৌরজগৎ, ডেলিশিয়া – হত্যা, জ্ঞান – ফল, নারী – সৃষ্টি, নার্স নেলী; মুক্তি – ফল প্রভৃতি গল্প ও রূপকথা আছে। মেরী করেলির Murder of Delicia উপন্যাস হইতে সঙ্কলিত গল্পটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে, পুরুষশাসিত সমাজে সভ্যদেশেও নারীর দুঃখের কমতি নাই আর ‘নার্স নেলী’তে গৃহের অভ্যন্তরীণ পবিত্রতার দিকে দৃষ্টি দিতে তিনি ইঙ্গিত করেছেন। অন্যান্য গল্পগুলোতে নারীর মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে। ‘জ্ঞান – ফল’ রূপকথাটি আদম – হাওয়ার কাহিনী নিয়া রচিত; আদি – পুরুষ বলিতেছেন: “কি আপদ। আমি রমণীকে রাখিতেও চাহি না, ফেলিতেও পারি না।” তদবধি নারী অভিশাপরূপে পুরুষের গলগ্রহ হইয়া রহিয়াছে- তার এই cynical মন্তব্য দুঃসহ বেদনা হতেই উদ্ভূত।
মতিচূর ১ম খণ্ডে ‘বারেকা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: “অবরােধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই।… এই অবরোধ প্রথা না থাকিলে মানুষ ও পশুতে প্রভেদ কি?… অবরোধপ্রথা স্বাভাবিক নহে – নৈতিক। …বারেকা জিনিসটা মোটের উপর মন্দ নহে। …উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই।… পর্দা কিন্তু শিক্ষার পথে কাটা হইয়া দাড়ায় না। এখন আমাদের শিক্ষয়িত্রীর অভাব।”

রোকেয়ার অবরোধবাসিনী গ্রন্থে ৭ টি অবরোধ- সম্পর্কিত দুর্ঘটনার উপাদেয় কাহিনী আছে অতুলনী শ্লেষের সঙ্গে তিনি সেগুলি বর্ণনা করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে নারী Humorist বিরল, সেদিক দিয়ে ‘অবরোধবাসিনী’ উল্লেখযোগ্য কিছু নিশ্চয়। তিনি পর্দা চেয়েছেন, কিন্তু তার বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন নাই; বলেছেন: “ঐ সকল কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে।” তার মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দামতার চাইতে এই যে সংযম ও মর্মবোধের প্রাচুর্য্য, তার মূলে রয়েছে তাঁর নারীপ্রকৃতি। অবশ্য পর্দা বলতে যে তিনি নারীর সবল ব্যক্তিত্বই বুঝিতেন তার ইঙ্গিত নিম্নোক্ত ছত্রটিতে আছে: “বর্তমান যুগে ইউরোপীয় ভগ্নিগণ সভ্যতার চরম সীমায় উঠিয়াছেন, তাঁহাদের পর্দা নাই কে বলে?”
রোকেয়ার Sultana’s Dream এ স্বাধীন স্বনির্ভর নারী- সমাজের যে রম্য fantastic কল্পচ্ছবি ধ্যানদৃষ্টিতে তুলে ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে পরবর্তীকালে Anthony M. Ludovici- র লেখা Lysistrata or Woman’s Future and Future Woman পুস্তকের প্রতিপাদ্য ভবিষ্যৎ নারীজীবনের দৃশ্যাবলী। তা থেকেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রোকেয়া ছিলেন সুদূরদৃষ্টির অধিকারিণী। কিন্তু শুধু জ্ঞানের দৃষ্টিতে ভাস্বর নয়, প্রেমের মাধুর্যেও তাঁর অন্তর ছিল সদা স্নিগ্ধ। পবিত্রতা ও মানবিকতা তাঁর মনোলোকে অনাহত রেখেছিল আনন্দ ও সৌন্দর্যের সচ্ছ সঞ্চার, তারই বলে তাঁর ব্যক্তিত্ব হ’তে পেরেছিল দৃঢ়মূল ও অনমনীয়। শুধু তাঁর রচনাবলীতেই নয়, তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমরিয়াল গার্লস্ স্কুল পরিচালনার ব্যাপারেও তাঁর এই প্রবল ব্যক্তিত্ব ও মধুর চরিত্রের উজ্জ্বল পরিচয় পাওয়া যায়।

বেগম রোকেয়ার স্বামী খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দের ৩ মে লোকান্তরিত হন। তার পাঁচ মাস পরে রোকেয়া মাত্র পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে প্রথম সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ভিত্তিপত্তন করেন। কিন্তু সেখানে তিনি বেশীদিন থাকতে পারেননি। সাখাওয়াতের প্রথম পক্ষের কন্যা ও জামাতা তাঁর ঘর বাড়ী ও বিষয় সম্পত্তির অধিকার নিয়ে এমন অশোভন আচরণ শুরু করে যে, রোকেয়া অতিষ্ঠ হয়ে অগত্যা ১৯১০ খ্রীস্টাব্দের শেষ ভাগে চিরদিনের জন্য সাধের স্বামীর ভিটা ত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৯১ খ্রীস্টাব্দে ১৬ই মার্চ কলকাতায় অলিউল্লাহ লেনের একটি ছোট বাড়ীতে আটজন ছাত্রী নিয়ে নুতনভাবে স্কুল আরম্ভ করেন। পরে ৮৬/এ, লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে তা স্থানান্তরিত হয়। রোকেয়ার অক্লান্ত সাধনায় স্কুলটি একটি প্রথম শ্রেণীর শিক্ষা- প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হয়েছে। ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর প্রত্যুষে অকস্মাৎ হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে প্রায় ৫৩ বৎসর বয়সে তাঁর তিরোধান ঘটে; তার পূর্বরাত্রেও প্রায় এগারোটা পর্যন্ত তাঁকে স্কুলের কাগজপত্রের নথির মধ্যে কার্যনিরত দেখা গিয়েছিল।

তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই, ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দের ২৫শে ডিসেম্ভর তারিখে কলকাতা এলবার্ট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মেলনের পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অভ্যর্থনা- সমিতির সভাপতির অভিভাষণে সৈয়দ এমদাদ আলী বলেন, “সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস্ স্কুল আজও দাঁড়াইয়া আছে কিন্তু রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আর নাই। যে নারী অবলীলায় সকলের আক্রোশ সহ করিয়া, সমাজের নানা মলিনতার কথা, নারীর নানা দুঃখের কথা তীব্র ভাষায় প্রকাশ করিবার সাহস রাখিতেন, তিনি আর নাই। ….তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অপরিসীম ছিল, কারণ তিনি একটা মহৎ উদ্দেশ্যের প্রেরণা লইয়া কাজ করিতে; সে কাজের ভিতরে আমরা যে সুমঙ্গল নিহিত দেখিতাম তাহার ফলেই তাহার দেওয়া আঘাত আমাদের তখনকার ক্ষুদ্র সাহিত্যিক-সংঘের প্রত্যেকের মনে ফুল হইয়া ফুটিয়া উঠিত। মৃত্যু আজ তাঁহাকে অমর করিয়া দিয়াছে। তাঁহার স্মৃতির উপরে আজ বাংলার মুসলমান সমাজ যে- শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতেছেন, বাংলার কোন মুসলমান পুরুষের মৃত্যুতে সেরূপ করিয়াছেন বলিয়া জানি না। ইহা শুধু যুগ- লক্ষণ নহে, ইহা আমাদের জাগরণের লক্ষণ।”
Feature Image Courtesy: shariatpurbarta.com
Reference: রোকেয়া রচনাবলী