আচ্ছা প্রথমে বলুন তো, ‘নোয়াখাইল্লা’ শব্দটা শুনলে আপনার মনে কীরকম প্রতিচ্ছবি আসে? কিংবা ‘বরিশাইল্লা’ বা আপনি কি মনে করেন “গোপালি বা গোপালগঞ্জের লোকরা সব চাকরি দখল করে ফেলছে” বা কারো বাড়ি উত্তরবঙ্গ শুনলেই কি ভাবেন “মঙ্গা এলাকার ফকির!”?
যদি না ভাবেন তাহলে ফেসবুকের এসব মজার উদ্দেশ্যে করা বুলিংয়ের স্বরূপ অথবা যদি এমন ভেবে থাকেন তাহলে নিজের স্বরূপ দর্শনের একটি চলচ্চিত্রই বলতে পারেন ২০১৮ সালে নির্মিত এবং ২০২০ সালে জনসাধারণের চোখের নাগালে আসা দেবাশীষ মাখিজা পরিচালিত সিনেমা ‘ভোঁসলে’-কে।
সিনেমাটির মুখ্য চরিত্র শ্রী গণপত ভোঁসলে। যার নামের অর্থ জনগণের অলধিকর্তা, একই নামের যে দেবতা ভোঁসলের আবাসভূমি মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্মীয় প্রতীক। সিনেমার শুরুও দুই গণপতিকে সমান্তরালে রেখে। গণেশ চতুর্থী উপলক্ষে রাজ্যব্যাপী যে অনুষ্ঠান শুরু হয় তারই সূচনালগ্নে দেবতার প্রতিমা গড়তে যখন এক এক করে তুলির পোঁচ, গলার হার, হাতের বাজু জোড়া হচ্ছিল; তখন এক থানায় হাবিলদার ভোঁসলে অবসর নেয়ার দিন হিসেবে খুলছিলেন তার পুলিশি বেল্ট, শোল্ডার, ভাঁজ করছিলেন টুপি।

অবসরের সময় আসার পরও আমরা ভোঁসলের মধ্যে দেখতে পাই তার কর্মজীবন আরেকটু বাড়ানোর জন্য কর্তাব্যক্তিদের কাছে নানারকম তদবির। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে তার এই ব্যাকুলতা সম্বন্ধে। এই সম্বন্ধে আলোকপাত করতেই যেন অনুরূপ কিছু ফ্রেমে পরপর বায়োস্কোপীয় স্লাইডের মত আমরা দেখতে পাই, অবসরের যে যাপিত জীবন, তা কী করে ভোঁসলেকে, এমনকি তার ঘরের প্রতিটি আসবাবকেও বৃদ্ধ ভঙ্গুর মৃতপ্রায় করে দিবে। এরপরের শটেই ভোঁসলের ঝাঁকানি দিয়ে জেগে ওঠা যেন এই ক্রমে এগিয়ে আসা বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করারই একটি চেষ্টা।
ভোঁসলেকে ঘিরেই অন্যান্য চরিত্রগুলো আমাদের চোখের সামনে জন্ম নেয়, বিকশিত হয়। সে যে নিম্নজীবীদের বসতিতে বাস করে তার বাসিন্দারা অর্থনৈতিকভাবে একই শ্রেণীভুক্ত হলেও উপমহাদেশের ডানপন্থী রাজনীতির সূক্ষ্ম দাগ টানায় তাদের মধ্যেও ‘ভাইয়া’ আর ‘ভাউ’ নামের দুটো শ্রেণী গজিয়ে উঠে। দুটো সম্বোধন দুটো ভিন্ন জাতির- বিহারী ও মহারাষ্ট্রের মূল অধিবাসী মারাঠা – অনেকটা যেন আমাদের ‘দাদা’ আর ‘ভাইয়া’ সম্বোধনভেদটির মতই। বসতির একজন বিলাস, জাতে মারাঠী, পেশায় ক্যাবচালক, রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ মনোযোগ পেতে এই ভেদাভেদকে আরো উস্কে দেয়। তার দাবি এসকল অন্য রাজ্য থেকে আসা বিহারীরা তাদের সব কর্মসংস্থান দখল করে ফেলছে। সচেতন পাঠক মাত্রেই মনে করতে পারেন এর সাথে সম্পর্কিত আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় উপমহাদেশীয়দের সাথে বর্ণবাদী আচরণের ঘটনাগুলো। সেই একই বর্ণবাদ এখানে মারাঠা বিহারী দ্বন্দ্ব, দেশে হিন্দুরা সব উচ্চপর্যায়ের সরকারি চাকরি পাচ্ছে ইত্যাদিভাবে রঙ পাল্টিয়ে একইভাবে আবর্তিত হয়। এই যে নিজস্ব সুপেরিয়রিটির এক ধারণা থেকে তৈরি হওয়া আরেকপ্রকার ইনফেরিওরিটি, এটি বিষাক্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে বসতির বিহারী অধিবাসীদের মধ্যেও। বিলাসের কাউন্টার হিসেবে তৈরি হয় বিহারী ভ্রাতৃত্ববোধে এক হওয়া রাজেন্দ্র ও তার অনুচরশ্রেণী।

একদিকে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ভোঁসলেকে দলে ভেড়াতে বিলাসের টানাহেঁচড়া আর নতুন আসা হাসপাতালের নার্স বিহারী সীতার ছোট ভাই লালুর মগজ ধোলাইয়ের জন্য রাজেন্দ্রের চেষ্টা, ভোঁসলে আর লালুকে একই সুতোয় বাঁধা শুরু করে পরস্পরের নিজস্ব বয়সোচিত নিস্পৃহতার অভিব্যক্তি দিয়ে। আর ক্রমে এই বন্ধন আরো শক্ত হয় সীতাদের অসুস্থ ভোঁসলের সেবা এবং ভোঁসলের লালুকে কিছু কাজে সহযোগিতার মাধ্যমে।
কিন্তু তাহলেই বা ভেদাভেদের রাজনীতি টিকবে কেন? আপনারা যদি ইতিহাসের যুদ্ধ থেকে সাম্প্রতিক গ্রাম্য বিবাদের প্রতিবেদনও পাঠ করেন, দেখবেন যেকোন সহিংসতার সহজ শিকার নারী ও শিশুরাই হয়। এখানেও যখন ক্রমশ ভেদাভেদ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়া বিলাস ভোঁসলে কর্তৃক চরমভাবে অপমানিত হয়, তখন তার সব ক্ষোভ গিয়ে বিস্ফোরিত হয় সীতার শরীরে। এই বিহারী নারীকে ধর্ষণ করে সে তার মারাঠা গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
এই সিকোয়েন্সগুলো থেকেই মূলত সিনেমার শুরু থেকে অস্পষ্ট শুনতে পাওয়া ভোঁসলের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হতে শুরু করে। তার ধীর পদক্ষেপ হয় দ্রুত৷ বসতিতে গণপতির পূজাকে কেন্দ্র করে বিলাস যে বিভেদের বিষবাষ্প ছড়ানো শুরু করেছিল, হিন্দুধর্মীয় রূপকানুযায়ী সমাজে সাম্যবস্থার প্রতীক ইঁদুরবাহন দেব গণেশের বিসর্জনের দিনই গণপত ভোঁসলে বিলাসের এই দুরাচারের অবসান ঘটায়। সেই একই পৌরাণিক রীতিতে দেবতার হাতে অসুরের বধের মত, বিলাসকে প্রতিশোধমূলক খুন করে। তারপর সমুদ্রে বিসর্জিত গণেশ প্রতিমার সমান্তরালে শুরুর সিকোয়েন্সটির মতই আমরা গণপত ভোঁসলেরেও দেবতার মত এক মৃত্যু দেখি।

এসব সরল বয়ানের পাশাপাশি আমাদের খেয়াল করতে হয় বসতির মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া নোংরা নালার দিকে, যার প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু দেয়ালের দলীয় শ্লোগানে কে কালি ছিটিয়ে দিল সেজন্য পা কেটে ফেলার মত ক্রোধে মানুষ ফেটে পড়ে। এ যেন হুমায়ূন আজাদের বলা সেই প্রবচনটি – “কোন নারীর নগ্ন বাহু দেখলে আমরা সংস্কৃতি গেলো রব তুলি অথচ পথেঘাটে ভিখারিণীর নগ্ন দেহ আমাদের ন্যূনতম বিচলিত করে না।”
তেমনি ভোঁসলে চরিত্রটির নিঃসঙ্গতার রঙ আরো গাঢ় করে শহুরে প্রকৃতিতে বহু সংখ্যায় থাকা কাক ও কুকুরেরও একক উপস্থাপন।
সিনেমাটোগ্রাফিতে ফ্রেমে চরিত্রগুলোর উপস্থাপনও লক্ষণীয়। যখন ভোঁসলে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে যায় আর কাট টু কাটে আমরা বিলাসকেও দেখি তার উর্ধ্বতন নেতার সাথে মোলাকাতের অপেক্ষায় থাকতে তখন প্রথম ক্ষেত্রে ভোঁসলেকে দেখা যায় ফ্রেমের মধ্যভাগে, একটি গুরুত্ব বহন করেছে যেন; অন্য ক্ষেত্রে বিলাস প্রতিবারই ফ্রেমের এক কোণে; হীন, তুচ্ছ একটি বিষয় হিসেবে যেন দর্শকের চোখে ধরা পড়ে। তেমনি ভোঁসলের রিপোর্ট হস্তান্তরের সময় ফ্রেমের দূরতম প্রান্ত থেকে সীতার প্রবেশ ও ক্রমে অপর প্রান্তে বসা ভোঁসলের দিকে এগিয়ে যাওয়াও চলচ্চিত্রের ভাষা প্রয়োগের দৃষ্টিনন্দন উদাহরণ। জিগমেট ওয়াঙচুকের ক্যামেরা যেন কখনো কখনো আমাদের সেই বসতির বদ্ধ পরিবেশ আর বাসিন্দাদের বদ্ধ মনকে একত্রে স্পষ্ট করে দিচ্ছিল। একই জিনিস আরো রূপ পেয়েছে মঙ্গেশ ধাড়কের গণপতি পূজাকে আবহ হিসেবে রেখে করা সঙ্গীতায়োজনে।

অভিনয়ের কথা সবার শেষে বলছি কারণ এর সমৃদ্ধ কাস্টিং প্যানেল। নন্দিত ও জনপ্রিয় মনোজ বাজপেয়ী চলচ্চিত্রটি প্রযোজনার পাশাপাশি নামভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন৷ হাবিলদার গোছের চরিত্র তিনি পূর্বে ‘ট্রাফিক’ সিনেমাতেও করেছেন। কিন্তু এই সিনেমার বাড়তি অনুষঙ্গ যেটি, একইসাথে ঋজুতার সাথে দৃঢ়তাকে ফুটিয়ে তোলা, সেটি তার প্রতিভার গুণে ভোঁসলে চরিত্রকে সমুজ্জ্বল করে তুলেছে। তেমনি বিলাস চরিত্রে মারাঠী মঞ্চনাটকের জনপ্রিয় মুখ সন্তোষ জুভেকরও প্রয়োজনীয় অভিব্যক্তি দিয়ে অভিনয়ে সুবিচার করেছেন। সীতার ভূমিকায় ইপ্সিতা চক্রবর্তী আর লালু চরিত্রে বিরাট বৈভবকে দেখেও বোঝার উপায় নেই যে তারা তাদের চরিত্র থেকে আলাদা কিছু।
সব মিলিয়ে দেবাশীষ মাখিজার এই চলচ্চিত্রটি যেমন নিজেদেরই অস্বস্তিকর এক আত্মদর্শন, তেমনি পরিবর্তনের তাড়না দেয়া চিন্তার জন্মদায়ীও। এমন সৎ চলচ্চিত্রের আরো প্রসার হওয়া উচিত।
Feature Image Courtesy: indianexpress.com