বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান

রাডারের নিচ দিয়ে একটি টি-৩৩ বিমান রানওয়ে থেকে ভারতের সীমান্তের দিকে উড়ে চলেছে। নিজ মাতৃভূমি রক্ষার্থে পাকিস্তানের রানওয়ে থেকে বিমানটি দখল করে নিয়ে যাচ্ছে এক অকুতোভয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। কন্ট্রোল টাওয়ার বিষয়টি টের পেয়ে বেস কমান্ডারকে জানায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই চারটি এফ-৮৬ বিমান সেই টি-৩৩ বিমানটিকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও অফিসারটি বিমান নিয়ে সীমানার দিকে চলতে থাকেন। তার লক্ষ্য ভারতের সীমানা দিয়ে বাংলাদেশ। বাইরে আরো চার শক্তিশালী বিমানের ধাওয়া, ভিতরে আরেক পাকিস্তানি পাইলটের সাথে ধস্তাধস্তি চলতে থাকে অফিসারের। প্রবল ধস্তাধস্তিতে অবশেষে টি-৩৩ বিমানটি বিধ্বস্ত হয় এবং অফিসারটি মৃত্যুবরণ করেন। হয়তো তার কাছে মৃত্যুর চাইতে দেশের জন্য কাজ শেষ করতে না পারাটাই বেশি আক্ষেপের ছিল।

বলছিলাম বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের কথা। স্বপ্ন পূরণ না হলেও তিনি মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন স্বাধীনতার স্পৃহা মানুষকে কতোটা দুঃসাহসী করে তুলে। তার এই দুঃসাহসী কাজ যোদ্ধাদের মনোবল শতগুণে বাড়িয়ে দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি

মতিউর রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকায়। পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। যা এখন মতিনগর নামে পরিচিত। তখন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার একদম বেহাল দশা করে রেখেছিলপাকিস্তানিরা। তাই ঢাকা কলেজ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণী পাশের পর, মতিউরের বাবা উন্নত শিক্ষার আশায় তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন। সারগোদার পাকিস্তানি বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন মতিউর। পাকিস্তানে শিক্ষাজীবন শেষ করে সেখানেই কর্মজীবন শুরু করেন এবং বিবাহ বন্ধনেআবদ্ধ হন।

কিশোর মতিউর রহমান; Image Courtesy: mukti-bahini.blogspot.com

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মতিউর রহমান সম্পর্কে লিখেছেন, “দশ এগারো বছর বয়স থেকে পাকিস্তানে বাস করা সত্ত্বেও ঐ অঞ্চলের প্রতি মতির কোনোরকম আকর্ষণ বাঁ মমতা জন্মায় নি। দুই দেশের জলবায়ু, ভাষা, জীবনযাপন প্রণালি, মানসিকতা ইত্যাদি সবকিছুর মধ্যেই আকাশ পাতাল তফাত, সেটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতেন। কিংবা বলা যায়, তার মতো এমন করে অন্য অনেকে হয়তো উপলব্ধি করতেন না। সুযোগ ও প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও তিনি অবাঙালি মেয়ে বিয়ে করেন নি, তাঁর বন্ধুরাও যাতে না করেন, সেদিকে মতিউরের খেয়াল ছিল। তাঁর সন্তানেরা যাতে বাংলায় সহজে কথা বলতে শেখে, তাঁর জন্য তিনি বাসায় উর্দুভাষী লোক পর্যন্ত রাখতেন না। অনেক খরচ ও হাঙ্গামা করে দেশ থেকে বাঙালি কাজের লোক নিয়ে যেতেন।

মতিউর রহমান ও তাঁর স্ত্রী মিলি; Image Courtesy: mukti-bahini.blogspot.com

আকাশে ওড়ার শুরু যেভাবে

মতিউর রহমান ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান বাহিনীর পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। বাঙ্গালি এ অফিসার ছিলেন দুর্দান্ত মেধাবী ও চৌকস। নিয়োগপ্রাপ্তির পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ার বেজ এর ২ নম্বর স্কোয়ার্ডন এ জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের উপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ৭৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। বৈমানিক কনভার্সন কোর্সের ভাল ফলাফলের ভিত্তিতে তাকে পেশোয়ারে (১৯ নং স্কোয়ার্ডন) পোস্টিং দেওয়া হয়।

১৯৬৩ সালে নতুন পাইলট অফিসার হিসাব নিয়োগপ্রাপ্তগণ (মতিউর রহমান, সামনের সারিতে ডান থেকে দ্বিতীয়); Image Courtesy: Wikipedia

১৯৬৫ তে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লায়িং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ১৯ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে হঠাৎ সেটা বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে ভূমিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সন্মানে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙ্গালী পাইলট। ১৯৭০ সালে মতিউর রহমান বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।

স্বাধীনতা নিয়ে উপলব্ধি

পুরান ঢাকার আগা সাদেক লেনের ছেলে মতিউর রহমানকে তার বাবা শৈশবেই পাঠিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তাকে পড়াশুনার সময় বাঙ্গালি হওয়ার জন্য নানা রকম বৈষম্য মূলক আচরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৯৬৮ সালে বাঙ্গালি মেয়ে মিলি রহমানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। মিলি রহমান জানান “বিয়ের পর থেকেই উনি আমাকে বলতেন আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে, তুমি আমার পাশে থেকো।” ১৯৭১ সালে মতিউর রহমান ছুটিতে ঢাকায় তাঁর স্ত্রী ও ছোট ছোট দুই কন্যা সহ বেড়াতে আসেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তিনি মনে করেন এই বৈষম্য অনন্ত কাল চলতে পারে না, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তিম দিন ঘনিয়ে আসছে।

স্ত্রী ও দুই কন্যার সাথে মতিউর রহমান; Image Courtesy: pinterest.com

এদিকে ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার পরও পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। দেশে বড় ধরণের কোনো উলটপালট ঘটতে চলেছে কি না তাঁর অপেক্ষা করতে থাকেন। মার্চের ১ তারিখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে ঢাকাসহ সারা দেশে যে প্রবল বিক্ষোভ শুরু হয়, তা লক্ষ্য করে মতিউর রহমানের মনে হয়, তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া ঠিক হবে না। অসহযোগ আন্দোলনের একটা বড় সময় তিনি ঢাকায় অবস্থানরত বাঙ্গালি বিমান বাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করেন। বিমানবাহিনীর গ্রুপক্যাপ্টেন এ. কে. খোন্দকার ছিলেন বাঙ্গালি অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজৈষ্ঠ। তাঁর নেতৃত্বে বিমানবাহিনীর বাঙ্গালি অফিসাররা সংঘবদ্ধ হন। উইং কমান্ডার এম. কে. বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার এম. সদরুদ্দীন, ফ্লাইট লেফটটেন্যান্ট এম. হামিদুল্লাহ সহ বিমানবাহিনীর আরো কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী গোপনে নিয়মিত মিলিত হয়ে বৈঠক করতেন। মতিউর তাদের অন্যতম সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করতেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন বিমানবাহিনীর ১৮ জন বাঙ্গালি অফিসার ও প্রায় ৫০ জন টেকনেশিয়ান ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন, ভারতে চলে যাবেন এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। এভাবে তাঁরা প্রস্তুত হতে থাকেন স্বাধীনতার জন্য।

যুদ্ধে অকুতোভয়

২৫ শে মার্চ কালরাতে তিনি ছিলেন নরসিংদীর তাঁর পৈতৃক নিবাসে। পাকিস্তানিদের অপারেশন সার্চলাইটএর জন্য মতিউর রহমান আর ঢাকায় ফিরতে পারেন নি, আটকা পড়ে যান গ্রামে। যেখানে তিনি দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে শুরু করেন যুদ্ধের প্রস্তুতি। তিনি নিজ গ্রাম সহ আশেপাশের এলাকার তরুণ যুবকদের সংঘটিত করা শুরু করেন। যুদ্ধে দক্ষ মতিউর রহমান তাদের প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করেন। তিনি ঐসব মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র চালনা, পরিখা খনন, নিয়মিত শরীর চর্চা, শৃংখলা ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দিতেন। আরো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন, যেমন:  মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করা, সাহস জোগানো, দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করা ইত্যাদি।

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলেন। যুদ্ধ করতে আসা বাঙ্গালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন। তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান। মুক্তিযুদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ বাহিনী। পাক সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট পি আর এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরী করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ ৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাদের ঘাটির উপর বোমা বর্ষণ করে। মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন। তাই ঘাটি পরিবর্তন করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর বাহিনী।

বিমান বাহিনীতে দায়িত্বরত অবস্থায় মতিউর রহমান; Image Courtesy: tanzimhasan18.blogspot.com

বৃহত্তর উদ্দেশ্যে এরপর তিনি ২৩ এপ্রিল ঢাকায় ফিরে আসেন। অভিভাবকদের চাপ ও প্রবল নিরাপত্তাহীনতা উপেক্ষা করে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিবেন বলে চিন্তা করেন। কিন্তু তার আগে একটা কাজ করা বাকি। পাকিস্তান থেকে বিমান ছিনতাই করে ভারতে যাবেন এবং বিমান নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করবেন। তিনি ৯ ই মে পুনরায় কর্মস্থলে যোগদান করেন। তিনি সপরিবার পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। কিন্তু তখন পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত সব বাঙ্গালি সামরিক অফিসার ও সৈনিকদের উপর কড়া নজরদারি করা হচ্ছিল। এর মধ্যেই তিনি পাকিস্তান এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু জানাজানি হয়ে গেলে সেই পরিকল্পনা ফলপ্রসু হয় না। অবশ্য কারা এই পরিকল্পনা করেছে তা সামরিক কতৃপক্ষ জানতে পারেন নি। তা সত্ত্বেও তারা সব বাঙ্গালি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের গ্রাউন্ডেড করে। বিমানবাহিনীর সকল বাঙ্গালি অফিসারের জন্য বিমান চালানো নিষিদ্ধ করা হয়। তখন মতিউর রহমানকে বিমানের সেফটি অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মতিউর রহমান; Image Courtesy: mukti-bahini.blogspot.com

তিনি বিমান দখলের জন্য টার্গেট করেন রাশেদ মিনহাজ নামের একজন শিক্ষানবিশ পাইলটের উড্ডয়নের দিন (২০ আগস্ট শুক্রবার)। ঐ সময় কন্ট্রোল টাওয়ারের দায়িত্বে ছিলেন বাঙ্গালি অফিসার ফরিদুজ্জামান ও একজন পাকিস্তানি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মতিউর রহমানের পরিকল্পনা ছিল মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলেই তিনি তার থেকে কন্ট্রোল নিজ হাতে নিবেন। বিমানটি ২৭ নাম্বার রানওয়ে তে ঢোকার জন্য ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্র্যাক দিয়ে এগিয়ে যায়। মতিউর রহমান তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে দ্রুত সেখানে পৌছে যান এবং রাশেদ মিনহাজ কে থামার সংকেত দেন। কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পাওয়ার পরেও সেফটি অফিসার বিমান থামানোর সংকেত দিলে তা থামানোই নিয়ম। মিনহাজ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি (জঙ্গি বিমানের বৈমানিকের বসার স্থানের স্বচ্ছ আবরণ) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান। এসময় মতিউর রহমান দ্রুত ককপিটে চড়ে বসে রাশেদ মিনহাজ কে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলেন। তিনি বিমানটি চালিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে উড়ে যেতে থাকেন। প্রায় ভারতের সীমানায় পৌছে যাওয়ার পর রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান। দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয় এবং বিমানটি একাত ওকাত হয়ে আকাশের দিকে উড়ে যেতে থাকে। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বিমানটির পাখা দুটি অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে দেখে রাশেদ মিনহাজ কে জিজ্ঞাসা করা হয়, কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। কিন্তু মিনহাজের থেকে কোনো উত্তর আসে না। বিমানটি খুব নিচু দিয়ে যাচ্ছিল, ফলে তা রাডারে ধরা পড়লে কন্ট্রোল টাওয়ারের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষনের মধ্যে চারটি (মতান্তরে ২ টি) এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান সেই টি-৩৩ প্রশিক্ষন বিমানের খোঁজে আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু সেটির কোনো হদিশ তারা পায় না।

আসন্ন মৃত্যুর হাতছানিতেও মতিউর রহমান বিচলিত নয়, বরং ভারতীয় সীমান্তের দিকে চলতে শুরু করেন প্রবলবেগে। বিমানের নিয়ন্ত্রন নিয়ে ধস্তাধস্তি ও চারটি বিমানের ধাওয়া সাথে নিয়েই মতিউর রহমান ভারতীয় সীমান্তের একদম কাছাকাছি চলে যান।

“ইধার শো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার”!!

এক পর্যায়ে রাশেদ মিনহাজ বিমানের সিটের ইনজেক্ট বাটন প্রেস করলে মতিউর রহমান বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। সাথে কোনো প্যারাস্যুট না থাকায় বাঁচার কোনো আশাই থাকে না। এভাবেই শেষ পর্যন্ত লড়ে দেশের জন্য প্রাণ দেন মতিউর রহমান। বিমানের উচ্চতা কম থাকায় বিমান বিধ্বস্ত হয় এবং রাশেদ মিনহাজ ও মৃত্যুবরণ করেন।

বিকেলের দিকে খবর পাওয়া যায় ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে তালাহার থাট্টা এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে উভয় আরোহী নিহত হয়েছেন। মতিউর রহমানের মৃতদেহটি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়।

মতিউর রহমান তাঁর ছাত্রকে হত্যা না করে অজ্ঞান করেছিলেন। কিন্তু মিনহাজ মানবতার বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের দ্বারা ইতিহাসের নৃশংস হত্যাকান্ড ও অত্যাচারের সমর্থনে মতিউর রহমানকে হত্যা করে। এ জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে ‘নিশান-ই-হায়দার’ উপাধিতে ভূষিত করে। আর তারা মতিউর রহমানের মৃতদেহ করাচির মাসরুর ঘটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে সমাহিত করেন। তাঁর সমাধির সামনে লিখে দেয় “ইধার শো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার”!!

এভাবে প্রায় ৩৫ বছর ওখানে ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ সরকার তাকে “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান; Image Courtesy: legendsofbangladesh.com

বাংলাদেশে বিমান বাহিনীর যশোর ঘাটি তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিমান বাহিনী তার নামে একটি ট্রফি চালু করেছে। বিমান প্রশিক্ষনে সেরা কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীকে এটি প্রদান করা হয়।

মতিউর রহমান কে বলা হয় বাংলার ইকারুস। ২০০২ সালে তাঁর অসামান্য বীরত্বের কাহিনী নিয়ে “অগ্নিবলাকা” নামের একটি ডকুড্রামা ও ২০০৭ সালে “অস্তিত্বে আমার দেশ” চলচ্চিত্র নির্মান করা হয়। এছাড়াও শিশুদের দেশপ্রেম ও বীরত্বে উৎসাহিত করতে পাঠ্যবইয়ে এ বীরশ্রেষ্ঠের জীবনী  যুক্ত করা হয়।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মতিউর রহমানকে পুনঃসমাহিত করা হয়; Image Courtesy: Wikipedia

২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁকে পূর্ণ মর্যাদায় বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মতো মহাবীর যুগে যুগে একবার আসেন, মহাবিপ্লব মহাপ্রলয়ের মত জাগিয়ে তোলে দেশকে, সারিয়ে তোলে দেশকে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে বাংলাদেশ কোনোদিন ভুলবে না, ভোলা সম্ভব না।

Feature Image Courtesy: ekushejournal.com


References:

১. Manik, Julfikar Ali. Dhaka Tribune.

২. দৈনিক প্রথম আলো, “তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না”
৩. “President Parade held at BAF Academy”, The Independent, Dhaka

৪. বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান জাদুঘর

৫. “মতিউর হামিদুরের লাশ দেশে এসেছিল যেভাবে”, দৈনিক সংগ্রাম