‘আমার মনে হয় এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চেয়ে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে একটু বেশি‘ -প্রমথ চৌধুরী।
আজ থেকে বহু যুগ পূর্বে প্রমথ চৌধুরীর করা এই উক্তিটির সাথে সচেতন পাঠকমাত্রই একমত হবেন।
তবে আমাদের দেশের পাবলিক লাইব্রেরিগুলোর অবস্থা কেমন? বাংলাদেশে পাবলিক লাইব্রেরি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীর্ণ-শীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা, সংগ্রহের দৈন্য-দশা নিয়ে ধুঁকতে থাকা এক অতি পুরাতন স্থাপনা, যার ব্যবস্থাপনা দুর্বল, মান হতাশাজনক এবং পরিবেশ নোংরা। দেশের লাইব্রেরিগুলোর হাল যদি হয় এই, তাহলে তা শক্ত ভিতের মজবুত মানুষ কীভাবে গড়ে তুলবে?
দেশে প্রচলিত লাইব্রেরিগুলোর এই বেহাল দশা ভাবিয়ে তুলেছিল একজন স্বপ্নবান মানুষকে। যিনি স্বপ্ন দেখেন দেশের প্রতিটি মানুষকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার, মানব মনের ভালো গুণাবলির সর্বোচ্চ বিকাশের, জীবনের বহুবিচিত্র কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উচ্চতর মনুষ্যত্ব বিকাশ করে পূর্ণ মানবসত্তার জাগরণের। কিংবদন্তিতুল্য মানুষটির নাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
বিগত শতকের ষাটের দশকে বাংলাদেশে শুরু হওয়া নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রনায়ক। সম্পাদনা করেছেন সাহিত্য পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’ যা প্রধান ভুমিকা রেখেছিল সেকালের নব-সাহিত্য যাত্রায়।
তিনি ভেবেছিলেন একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার এমন কিছু আলোকিত মানুষ যাদের থাকবে উচ্চ মূল্যবোধ, আলোকিত চিত্ত, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে প্রভেদ করার ক্ষমতা, অসাম্প্রদায়িক উদার দৃষ্টিভঙ্গি। থাকবে দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা, যাদের দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে।
এরই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সারা দেশে সবখানে যথেষ্ট পরিমাণে আলোকিত, চিত্তের সামগ্রিক আলোকায়ন ঘটানো শক্তিমান এক প্রজন্ম গড়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান -বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।

১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সমগ্র বঙ্গ জনপদে জ্ঞানের আলো বিতরণের মহান কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ বাংলাদেশে একটি সফল সামাজিক আন্দোলনের নাম।
এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে শুরু হয় দেশ ভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের মাধ্যমে। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মনের পূর্ণ বিকাশ ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে কেন্দ্রের প্রথম বড় কর্মসূচি এটি। ১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া এই কর্মসূচিটি মোট দুটি ধাপে পরিচালিত হয়েছে ২০০২ সাল পর্যন্ত। প্রায় ১১০০টি শাখায় বিভক্ত ছিলো এটি।
পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সবচেয়ে সফল, বড় ও চমৎকার একটি উদ্যোগ হলো পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি। এই কার্যক্রমের শুরুটা ২০১০ সালে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্টটির (সেকায়েপ)-এর আওতায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এটি পরিচালনা করছে। দেশের ২৫০টি উপজেলার ১২১১৭টি স্কুল ও মাদ্রাসায় এই কার্যক্রম চলমান যেখানে মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৩৩%। ২০১৮ সাল নাগাদ এই ব্যাপক শিক্ষা-কার্যক্রমে প্রায় ২১ লাখ শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত হয়েছেন যার মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য বিভিন্ন স্কুল-মাদ্রাসায় প্রায় ১ কোটি বইয়ের কপি সরবরাহ হয়েছে।
পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি এই মুহূর্তে কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় কার্যক্রম, যেখানে একজন শিক্ষার্থী প্রতি শ্রেণিতে ১০ টাকা সদস্য ফি এর বিনিময় পড়তে পারে ২০টির মত বাংলা ও ইংরেজি বই। প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে একজন সাহিত্যপ্রেমী দক্ষ শিক্ষক এই বইপড়া কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। একজন সদস্য প্রতি সপ্তাহে পড়ার জন্য একটি করে বই বাসায় নিতে পারে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের তালিকায় আছে চমৎকার সব বই। সেখানে যেমন আছে ‘আম আঁটির ভেপু’, ‘কপালকুণ্ডলা’ ‘পল্লিসমাজ’ এর মতো ধ্রুপদী বাংলা সাহিত্য, তেমনি রয়েছে ‘টুনটুনির গল্প’, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘বাঙালির হাসির গল্প’, ‘রাশিয়ার রূপকথা’-র মত হাসির এবং মনমাতানো সব রূপকথা আর গল্পের বই। এছাড়া বিশ্ব সাহিত্যের সেরা বইগুলোর অসাধারণ অনুবাদ তো রয়েছেই।

বছরব্যাপী এই বইপড়া কর্মসূচির সমাপ্তি পর্বে রয়েছে বিশেষ মূল্যায়ন পরীক্ষা যেখানে ভালো ফলাফল করে বই পুরস্কার পাওয়ার সাথে সাথে রয়েছে সেরা পাঠক হওয়ার সনদপত্র ও গৌরব অর্জন করার দুর্লভ সুযোগ!
আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সাধারণত আর্থিক কারণসহ আনুষঙ্গিক নানা কারণে ভালো বই পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকতো। সেখানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই বিশ্বমানের বইগুলো তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে।
এক্ষেত্রে, একদিকে শিক্ষার্থীরা যেমন তাদের অবসর সময় বিনামূল্যে এসব বই পড়ে কাটাতে পারছে, যুগপৎভাবে নিজেকে হয়তো নিজের অজান্তেই গড়ে তুলছে আগামীর যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে, মানসিকতা গড়ে উঠছে ভিন্নভাবে। কিশোর বয়সে পড়া সেসব গ্রন্থাবলি একজন কিশোর বয়সী ছেলে বা মেয়ের মনুষ্যত্ব গঠনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে আর তার চলার পথকে করে মসৃণ। বইয়ের সাথে অবসর কাটানোর মত চমৎকার জিনিস কমই হয়, সেখানে বইগুলো যদি পড়া যায় বিনামূল্যে, তাহলে তো তা সোনায়-সোহাগা।

ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি
লেখার শুরুতে লাইব্রেরির গুরুত্ব এবং বাংলাদেশের লাইব্রেরিগুলোর বেহাল অবস্থা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করেছি।
দেশের বিদ্যমান লাইব্রেরিগুলোর অবস্থা যখন ত্রাহি মধুসূদন, তখন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে, অভিনব পন্থায় ‘ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি‘ নামক ধারণা নিয়ে আসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। পাঠক হয়তো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি দেখে থাকবেন।
দেশের ৫৮টি জেলার ২৫০টি উপজেলায় বিস্তৃত এর কার্যক্রম। এই উদ্যোগে বই পৌঁছে যাচ্ছে পাাঠকের দোরগোড়ায়। দেশভিত্তিক উৎকর্য কার্যক্রম, পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচির সাথে সাথে গড়ে তোলা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি মূলত গাড়িতে করে চলমান বৃহৎ বইয়ের সমষ্টি। এই প্রকল্পে মোট সাত ধরনের অনিন্দ্য সুন্দর নান্দনিক ডিজাইনের গাড়ি রয়েছে যেখানে যথাক্রমে চার হাজার, ছয় হাজার, আট হাজার, ১১ হাজার, ১৭ হাজার বই আছে। প্রতিটি গাড়ি প্রতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে আধঘন্টা থেকে দু’ঘন্টা পর্যন্ত সদস্যদের মধ্যে বই আদান-প্রদান করে।

১৯৯৯ সালে দেশের চারটি বড় শহর -ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কার্যক্রম শুরু হলেও ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়ছে। ২০১৪ সাল নাগাদ দেশের ২৫০ টি উপজেলার ১৯০০ লোকালয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। এর উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ ৩০ হাজার।
আলোর পাঠশালা
আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রও। প্রতিষ্ঠানটি ছাপা বইয়ের পাশাপাশি অনলাইনে বই পড়া কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে যেটি আলোর পাাঠশালা নামে পরিচিত। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের একটি বেসরকারি টেলিকম কোম্পানির সহায়তায় ২০১৪ সালে শুরু হয় ‘আলোর পাঠশালা’র যাত্রা।
পাঠক, আপনিও অংশ হয়ে উঠতে পারেন তাদের এই চমৎকার উদ্যোগের। আলোর পাঠশালার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রায় ৫০০ উন্নতমানের বই আপলোড করা আছে। তাছাড়া প্রতি চারটা বই পড়ে একটি করে বই পুরস্কার জিতে নেওয়ারও সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে।

কেন্দ্র লাইব্রেরি ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড
ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচির মত সফল প্রকল্প সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে। তবু রাজধানী ঢাকায় একটি বৃহদাকার লাইব্রেরি গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যালয়ে প্রায় দুই লক্ষ বইয়ের বিশাল সংগ্রহ নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ-সুবিশাল কেন্দ্র লাইব্রেরি। প্রতিবছর প্রায় ১০০০০ পাঠক এই লাইব্রেরি ব্যবহার করে উপকৃত হন।
নির্ধারিত নিরাপত্তা অর্থ জমা দিয়ে মাসিক ২০ টাকা চাঁদার বিনিময়ে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন এই বৃহৎ লাইব্রেরির একজন গর্বিত সদস্য।
এছাড়াও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ আধুনিক প্রকাশনা বিভাগ, যারা বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভাষার সেরা বইগুলো প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের ব্যাপক বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের বইপড়া কর্মসূচি, আলোর স্কুল, শ্রবন-দর্শন, বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বই বিক্রয় কেন্দ্র, জাতীয় জীবনে নানা প্রতিযোগিতা আয়োজনসহ আরো অনেক কর্মসূচি।

পুরস্কার–অর্জন
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এমন এক প্রতিষ্ঠানের নাম যেটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নীরবে-নিভৃতে একটি জ্ঞানের আলোয় দেদীপ্যমান প্রজন্ম গড়ার কাজ করে যাচ্ছে। যাদের চিত্তের দীপ্তি, মেধা ও মননের সমন্বিত উৎকর্ষ সাধন দ্বারা দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সাফল্যের শিখরে।
শত-সহস্র ছাত্র-ছাত্রী ও ব্যক্তিবিশেষের জীবনে উচ্চতর মূল্যবোধ ও জেগে ওঠার শিক্ষা দিতে পারাটাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই প্রতিষ্ঠান মানুষ গড়ে তোলার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘জ্যান অ্যামোস কমিনিয়াস পদক-২০০৮’– যা শিক্ষাক্ষেত্রে ইউনেস্কো কর্তৃক প্রদত্ত সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার।

নবীন প্রজন্মকে বিশ্বের ও বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইয়গুলোর সাথে পরিচয় করে দিয়ে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পেয়েছেন ‘র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার –২০০৪‘।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার ইতিবাচক ফল জাতি পেতে শুরু করেছে। সমাজের শুভ পরিবর্তনের এই ধারা বয়ে চলুক নিরন্তর।
Feature Image Courtesy: alorpathshala.org