ব্ল্যাকহোল

রাতের আকাশের চমৎকারিত্ব ও রহস্য আদিকাল থেকেই আমাদের বিস্মিত ও আকৃষ্ট করে আসছে। আর অজানা এই মহাবিশ্বকে জানার জন্য বিজ্ঞানীরাও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারপরও তারা মহাবিশ্বের অনেক ক্ষুদ্র পরিমান অর্থাৎ মাত্র ৪% জানতে পেরেছেন, বাকি ৯৬% এখনো অজানাই রয়ে গেছে। আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার হলো ব্ল্যাকহোলের আবিষ্কার! ব্ল্যাকহোল অবশ্য দেখা যায় না। তবে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা একশো ভাগ নিশ্চিত। মহাবিশ্বের যেকোন বস্তু বিদ্যুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ বিকিরণ করে। কিন্তু ব্ল্যাকহোল বস্তু হওয়া সত্ত্বেও কোন তরঙ্গ বিকিরণ করে না। এ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে ব্ল্যাকহোল বস্তু না হলে কী? সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ব্ল্যাকহোলের ভিতরে কী ঘটছে কিংবা কেন্দ্রে কী আছে এগুলো মানুষের চিন্তাজগতের ধারনার বাইরে। সবচেয়ে রহস্যজনক ব্যাপার হলো ব্ল্যাকহোল মহাজাগতিক সব বস্তুই গ্রাস করে, এর আকর্ষণ বল ভেদ করে কোন কিছুই বের হতে পারে না।

শিল্পীর চোখে ব্ল্যাকহোল; Image Courtesy: zeenews.india.com

ব্ল্যাকহোল কী?

মহাকাশের বুকে এমন কিছু অঞ্চল আছে যেখান থেকে কোন বিকিরণ বা তথ্য বের হয়ে আসতে পারে না। স্থান কালের বুকে আত্নগোপন করে থাকা এসব মহাজাগতিক অঞ্চলকে বলা হয় ব্ল্যাকহোল।

ব্ল্যাকহোলকে বাংলায় কৃষ্ণবিবর বা কৃষ্ণ গহ্বর বলা হয়। এর নাম গহ্বর বলা হলেও আসলে এটা ফাঁকা নয়। বরং এর ভেতরে খুব ছোট একটি জায়গায় বিপুল পরিমাণ মহাজাগতিক পদার্থ জমাট বেঁধে আছে। তার ফলেই এর মহাকর্ষ শক্তি অত্যন্ত প্রবল। ব্ল্যাকহোল এমন একটা মহাজাগতিক অঞ্চল যেখান থেকে কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব না। স্বাভাবিকভাবে কোন নক্ষত্র চুপসে গেলে কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। ব্ল্যাকহোলে মহাকর্ষ বল এতোটাই প্রবল যে মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম সত্তা আলোও (গতিবেগ প্রতি সেকেন্ডে তিনলক্ষ কিলোমিটার) এর আকর্ষণ বল ছিন্ন করতে পারে না। যেহেতু ব্ল্যাকহোল থেকে কোন তথ্য বা সত্তা বের হতে পারে না তাই একে মহাজাগতিক দানব বললেও ভুল হবে না।

ব্ল্যাকহোল; Image Courtesy: banglacyber.com

ব্ল্যাকহোল থেকে আলো না আসায় একে দেখা যায় না তবে এর চারদিকের সীমানা দেখা যায়। এই সীমা কে বলে ঘটনা দিগন্ত বা Event Horizon. কোন বস্তু এই ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করলেই ব্ল্যাকহোলোর গভীরে চিরতরে হারিয়ে যায়। ব্ল্যাকহোলের আকর্ষণে মহাজাগতিক সত্তাগুলো অধিক ঘনত্বে আসতে শুরু করে এবং এক সময় সমস্ত ভর একটি ছোট্ট বিন্দুতে ভিড় করে যার নাম সিঙ্গুলারিটি।

ব্ল্যাকহোলের আবিষ্কার

ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আগে বিজ্ঞানীদের তেমন ধারণা ছিল না। তবে এখন ধীরে ধীরে এ সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানা যাচ্ছে। “ব্ল্যাকহোল হলো বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু, যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারে না”- ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে সর্বপ্রথম এই বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রদান করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন মিচেল (John Michell)। তবে ব্ল্যাকহোলের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয় ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়েরে সাইমন ল্যাপলাসকে। ১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলাস এ সম্পর্কে মতবাদ প্রদান করেন তার ‘Exposition du systeme du Monde’ বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে।

১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (General Theory of Relativity)’ থেকে ধারণা করেন মহাবিশ্বে ব্ল্যাকহোল থাকা সম্ভব। দীর্ঘদিন গবেষণার পর ১৯৯৪ সালে নভোচারীরা প্রমাণ করেন আসলেই ব্ল্যাকহোল আছে এবং এটি কোন সায়েন্স ফিকশন নয়। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড ১৯১৬ সালেই দেখান, যেকোন তারকা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে। ব্ল্যাকহোল নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাদের মধ্যে কার্ল শোয়ার্জস্কাইল্ড, কার্টার, রবিনসন, স্টিফেন হকিং প্রমুখ জ্যোতিবিজ্ঞানীর নাম উল্লেখযোগ্য।

মানুষের তোলা প্রথম ব্ল্যাকহোলের ছবি; Image Courtesy: livescience.com

২০১৯ সালের ১০ ই এপ্রিল বিজ্ঞানীরা প্রথম বারের মতো কোন ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। ব্ল্যাকহোলের স্পষ্ট ছবি তুলতে পৃথিবীর মতো বড় টেলিস্কোপের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তা অসম্ভব হওয়ায় এ্যান্টার্কটিকা, স্পেন ও চিলি সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসানো আটটি Event Horizon টেলিস্কোপের এক নেটওয়ার্ক দিয়ে ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবি তুলতে সক্ষম হয়। এর আগে প্রদর্শিত ছবিগুলো বিজ্ঞানীদের কল্পনা ও শিল্পীর নৈপুন্যে আঁকা। ব্ল্যাকহোলের প্রথম ছবিটি তুলতে ২০০ জন বিজ্ঞানী প্রায় ২০ বছর ধরে চেস্টা করে গেছেন।

ব্ল্যাকহোল কীভাবে সৃষ্টি হয়?

নক্ষত্র চুপসে গেলেই কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয় না। কোন নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বর হবে কিনা তা নির্ভর করে তার ভরের উপর। ভারতীয় বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর গানিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছেন সেক্ষেত্রে সূর্যের ভরের তিনগুণ বা তার অধিক ভর থাকতে হবে। কৃষ্ণগহ্বর হতে হলে নক্ষত্রে বা বস্তুর একটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধও থাকতে হবে। জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল শোয়াল্ডসিল্ড ১৯১৬ সালে ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের সেই সমীকরণ প্রদান করেন।

ব্ল্যাকহোলের বৈজ্ঞানিক মডেল; Image Courtesy: wikipedia

ব্ল্যাকহোল তত্ত্ব ও বিভিন্ন মডেল

স্টিফেন হকিং ও রজার পেনরোজ গবেষণা থেকে দেখান যে ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরে অসীম ঘনত্ব ও স্থান কালের বক্রতার অনন্যতা রয়েছে। ব্ল্যাকহোল তত্ত্বে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মডেলের ধারণা দেন। স্টেলার ব্ল্যাকহোল ও সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি আছে।

স্টেলার ব্ল্যাকহোল: সুর্যের ভরের ২০-৩০ গুন বেশি ভরের নক্ষত্রগুলো সংকুচিত হয়ে স্টেলার ব্ল্যাকহোলে রুপান্তরিত হয়। আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গায় (Milky Way Galaxy) প্রায় দশলক্ষের অধিক স্টেলার ব্ল্যাকহোল আছে।

সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল: সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল সুর্যের ভরের চেয়েও কয়েকগুণ বড় হয়। বড় বড় ছায়াপথের কেন্দ্রে এই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল দেখা যায়। ব্ল্যাকহোলগুলো ঘুর্ণায়মান অথবা ঘুর্ণনহীন হতে পারে।

স্টেলার ব্ল্যাকহোল; Image Courtesy: ABC News

পৃথিবী ও মহাবিশ্বের পরিনতিতে ব্ল্যাকহোলের ভূমিকা

সৌর জগতের আশেপাশে কোন ব্ল্যাকহোল নেই। আর পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম ব্ল্যাকহোলটির নাম V 4641 Sgr যা ১৬০০ আলোকবর্ষ দূরে। অর্থাৎ আলোর গতিতে চললেও ১৬০০ বছর লাগবে। এই ব্ল্যাকহোলটি বেশ দূরে হওয়ায় পৃথিবী সূর্যের সাথে মহাকর্ষ বল ছিন্ন করে যেতে পারবে না। আবার শক্তি বিকিরণ করে সূর্যের মৃত্যু হলেও ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে না। ফলে আমাদের পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহের কোন ক্ষতি হবে না।

সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল; Image Courtesy: innovationnewsnetwork.com

মহাবিশ্বের শেষ পরিণতিতেও ব্ল্যাকহোলের ভূমিকা নেই। কারণ মহাবিশ্বের সংকোচন প্রসারণ নির্ভর করে গড় ঘনত্ব বা সংকট ঘনত্বের ওপর। মহাবিশ্বের সংকোচনের চাপে গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল সব মিশে একাকার হয়ে যাবে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের সংকোচনে ব্ল্যাকহোলের কোন ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নেই। বরং মহাবিশ্ব সংকুচিত হচ্ছে বলেই ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি।

Feature Image Courtesy: space.com

References:

1. Prothomalo.com
2. Ekushey-tv.com
3. Science.nasa.gov
4. ব্ল্যাকহোল; শিশিরকুমার ভট্টাচার্য