আজকাল এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি চা পান করেন না। অধিকাংশ শহুরে মানুষের সকালটা শুরু হয় চা পানের মধ্য দিয়ে। অফিসের কাজ শুরু হয় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিংবা দীর্ঘক্ষণ অফিসে কাজ করার ফলে শরীর ক্লান্ত হলে, শরীরকে সতেজ করতে কর্ম বিরতিতে চা যেন অপরিহার্য। কিংবা বাসায় মেহমান আসলে, চায়ের আপ্যায়ন তো হবেই।
আপনি অবসর সময় কাটাচ্ছেন, হাতে চায়ের কাপ। রাজনেতিক আড্ডা দিচ্ছেন, হাতে চায়ের কাপ। শহরের বড় বড় হোটেল থেকে শুরু করে গ্রামের ছোট্ট টঙ দোকানেও চা। গ্রাম এলাকায় সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় হোটেলে গিয়ে চা আর টেলিভিশন না দেখলে অনেকের দিনটাই মাটি হয়ে যায়।

আমরা কি চায়ের বিকল্প পেয়েছি? কিংবা বিকল্প কি আদৌও খোঁজার চেষ্টা করছি? উত্তর হচ্ছে, না। কারণ, চা সর্বাপেক্ষা পছন্দের পানীয়।
আচ্ছা এই যে চায়ের এত চাহিদা, এই চাহিদা মেটাচ্ছেন কারা? চায়ের মালিকরা নিজে কি এগুলো করছেন? উত্তর তো সবারই জানা। এই পছন্দের পানীয়টির মূল উপাদান চা পাতা উত্তোলন কাজ থেকে শুরু করে প্যাকেজিং ও বাজারজাতকরণে চায়ের শ্রমিকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। চা শ্রমিকদের ছাড়া চা এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।

চা প্রক্রিয়াজাতকরনের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের চা পাতা আলাদা করে চা শ্রমিকেরা। সাধারনত, চা প্রক্রিয়াজাতকরণ বলতে চা গাছের তাজা পাতাকে বিভিন্ন ভাবে জারণ করে, শুকিয়ে চা-পাতা তৈরিকে বুঝায়। প্রতিদিন একজন শ্রমিক ২০ থেকে ৩০ কেজি চায়ের পাতা উত্তোলন করতে পারেন। কিছুদিন আগে ৫০ কেজি সর্বোচ্চ ছিল।
আচ্ছা এই যে শ্রমিকদের বাগান থেকে চা পাতা তোলার কাজ, এর ফলে চা শ্রমিকেরা কি পাচ্ছেন? বস্তা বস্তা টাকা? চায়ের পাতা উত্তোলন করলেই টাকা? উত্তর টা হয়ত আপনাদের আর অজানা নেই। চা পাতা তোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন তাদের মজুরি ছিল দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা।

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চায়ের বাজারের মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫শ কোটি টাকা। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। বাংলাদেশ চা বোর্ডের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসেবে দেশের ১৫৯টি চা বাগানে প্রায় ৪ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক রয়েছেন। দুই-বছর অন্তর শ্রমিকদের মুজুরি বৃদ্ধির চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালের পর শ্রমিকদের মুজুরি বৃদ্ধি করা হয় নি। ফলে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নামতে হয় চা-শ্রমিকদের। মূলত মে-অক্টোবর মাস হলো চায়ের পাতা তোলার মূখ্য সময়। কিন্তু চলতি বছর মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করায় এ সময়ে তারা দীর্ঘদিন মজুরিও পায়নি।

দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকায় উন্নীত করার লক্ষ্যে চা শ্রমিকেরা বহুদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এরই প্রেক্ষিতে চা মালিক সমিতিকে চলতি বছরের পহেলা আগস্ট ৭ দিনের সময় বেধে একটি স্মারকলিপি দেয়। কিন্তু এতেও মালিক সমিতি মজুরি বৃদ্ধি করতে নারাজ হলে ৯ আগস্ট থেকে কর্মবিরতি ঘোষণা করে এবং আন্দোলন চালিয়ে যায়।
শুরুতে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করলেও, ১৩ আগাস্ট থেকে চা বাগানের দেড় লাখ শ্রমিক অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেন। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কুড়ি দিনের মতো আন্দোলন চলার পর প্রধানমন্ত্রী ১৭০ টাকা নতুন মজুরি ঘোষণার পর চা শ্রমিকেরা তাদের কাজে ফিরেন।

চা শ্রমিকদের আবাসস্থল বলতে একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া একের পর এক খুপড়ি ঘর। সামনে হাত কয়েক খালি জমিন। গতর খাটিয়ে ওরা খুপড়িগুলি যতই পরিস্কার রাখুক না কেন, পর্যাপ্ত আলো আর বাতাসের অভাবে সেখানকার পরিবেশ মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। আর বৃষ্টির দিনে স্যাঁতস্যাতে কাদা আর শেওলা মিলে যে এঁদো পরিবেশের তৈরি হয়, সেখানে সহজে রোগ-ব্যারাম বাসা বাঁধে। নেই ভালো শৌচাগার। চা শ্রমিকদের খাবারে পুষ্টিমান খাবার নেই বললেই চলে। সকালে রুটি, চা কিংবা আলুভাজি, দুপুরে রুটির সঙ্গে আলুসিদ্ধ, পেয়াজ ও কচি চা পাতার মিশ্রণে ভর্তা, রাতে ভাতের সঙ্গে চানার ডাল বা অন্যকিছু। যে টাকা মুজুরি পায় সে টাকায় মাছ, মাংস এমনকি ডিম কিনে খাওয়াও অসম্ভব। বর্তমান বাজারে তারা ভাত, ডাল আর ডিম খেয়ে বেঁচে থাকলেও মাসিক খরচ আসে একজনের আড়াই হাজারেরও বেশি। আর তাদের মুজুরি সাড়ে তিন হাজারের মত। একজনের খরচ এমন হলে পরিবারের বাকিদের কি হাল? শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা ফ্রি দেওয়ার কথা থাকলেও নেই কোন বাস্তবতার ছাপ।

২০ মে ঐতিহাসিক ‘চা-শ্রমিক হত্যা দিবস’ পালন করা হয়। ব্রিটিশদের মিথ্যা প্রলোভনে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে চা শ্রমিকরা বাংলায় আসে ১৮৩৪ সালের দিকে। চা-শ্রমিকরা তখন ব্রিটিশ চা-বাগান মালিক কর্তৃক অত্যাচার-নিপীড়ন, অবহেলা-নির্যাতন সহ্য করতে না-পেরে ১৯২১ সালের এই দিনে নিজ মুল্লুকে (আবাসভূমিতে) ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে ‘মুল্লুকে চলো আন্দোলন’ সংঘটিত হয়েছিল।
তৎকালীন সময়ে চা শ্রমিকদের কাছে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। তাই হেঁটেই সিলেট থেকে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাঁট পর্যন্ত আসে। এখানে ব্রিটিশরা তাদেরকে ফিরে যেতে বাধা দেয়। বাধা অতিক্রম করে চা-শ্রমিকরা মেঘনা নদী পার হয়ে নিজের মুল্লুকে যেতে চায়। কিন্তু ব্রিটিশ গুর্খা বাহিনী তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং হাজার হাজার চা-শ্রমিককে পেট কেটে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। চা-শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনা নদীর পানি। চা-শ্রমিকদের রক্তেমাখা এই ইতিহাসকে স্মরণ করার জন্য প্রতিবছর ২০ মে পালিত হয় ‘চা-শ্রমিক হত্যা দিবস’।

১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে চা-চাষ। বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধনকৃত মোট চা-বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। নিবন্ধন ছাড়াও আরো অনেক চা-বাগান বিদ্যমান।
বেশিরভাগ চা শ্রমিকের পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারের অধিক। পরিবারে ৫/৬ জন সদস্য হলে দৈনিক একজন চা শ্রমিকের ১৭০ টাকায় কি হবে? তাদের ভরণপোষণ চলবে? তাদের শিক্ষা লাভ হবে? মৌলিক অধিকারটুকু থেকেও চা শ্রমিকেরা বঞ্চিত হচ্ছে। চা-শ্রমিকের ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ আয়নার মত স্বচ্ছ। ঐ যে চা শ্রমিকের ছেলে মেয়ে চা শ্রমিক হবে। আর না হয়ে কি উপায় আছে?

একজন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে হলে চা শ্রমিকদের এনজিও থেকে ঋণ করতে হয়। সেখানে ৩/৪ জন সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া আদৌও কি সম্ভব! যেখানে তারা বছরে দুই বার মাংস কিনতে পারছে না, ভালো খাবার কিনতে পারছে না সেখানে তারা তারা কীভাবে সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন। বড়জোর টেনেটুনে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করাতে পারে। আর সেটা দিয়ে কিইবা হবে! এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা! সিলেটের হেলেনা খাতুনের (প্রতীকী নাম) ছেলে রফিক (প্রতীকী নাম) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। সেটা কীভাবে হয়েছে? ঐ যে এনজিও। এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নিয়ে ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন হেলেনা খাতুন। ফেসবুকের এক পোস্টের বদৌলতে রফিকের মায়ের কষ্ট টা কিছু লোকের সামনে আসে। তারপর রফিকের চাকরির ব্যবস্হা করেন একটি কোম্পানি।

এটাতো একজন রফিকের গল্প, এটাতো একজন রফিকের মায়ের গল্প। কিন্তু বাকি রফিকদের কি হবে? চা শ্রমিকেরা হলো ‘আধুনিক যুগের ক্রীতদাস’। এদের এসব কষ্ট দেখলে ভারতবর্ষের ঐ ব্রিটিশ শাসনের কথা মনে পড়ে যায়। যখন তারা নীল চাষিদের বাধ্য করে নীল চাষ করাতো; কিইবা করার ছিল তাদের। নীল চাষিরা বাধ্য ছিল করতে। বর্তমানে চা শ্রমিকদের পার্থক্য এই যে, তখন নির্যাতনের ভয় ছিল আর এখন বেঁচে থাকার লড়াই।
অনেক আন্দোলনের পর ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা দৈনিক মজুরি করা হলো। তাতে কি আর হলো! নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে তাদের বাড়ির পাশের ঐ শাকপাতা খেয়ে বাঁচাই মুশকিল। তাদের কষ্ট দেখার কে আছে!

পাহাড়ি এলাকা একদিকে অনেক প্রতিকূল অবস্থা পার হয়ে চা বাগানে যেতে হয়। ব্যাপারটা এমন যে, একদিন ভালো করে বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে স্বপ্নের মত। ভবিষ্যৎ বলতে তাদের কিছু নেই। তবুও চা শ্রমিকেরা বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। জীবনযুদ্ধে তারা পিচু হটেনি। অন্যদিকে চা শ্রমিকদের এত সংগ্রামের জীবনকে সহজ করার প্রচেষ্টা না করে আমরা জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছি চায়ের কাপে তাদের ‘রক্ত’ পান করে।
Feature Image Courtesy: ittefaq.com