নদীমাতৃক বাংলাদেশের অন্যতম নস্টালজিয়ার নাম সাঁতার। সাঁতার না জানা বাঙালি মানুষ খুব কমই আছে। কিন্তু এই সাঁতার নিয়েই আমাদের মাতামাতি খুব কম। অথচ বিশ্ব বরেণ্য সাঁতারুর তালিকা করতে গেলে একমাত্র বাঙালি হিসেবে যাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, তিনি ব্রজেন দাস। আজ গল্প হবে তাকে নিয়েই। জেনে নেব, তার সফলতার গল্প।

ব্রজেন দাস ১৯২৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার কুচিয়ামোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হরেন্দ্র কুমার দাস। কুচিয়ামোড়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ব্রজেন দাসের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে ঢাকার কে এল জুবিলী হাই স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকেই ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট ও বিএ পাস করার মধ্য দিয়ে ব্রজেনের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে।

বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলার প্রতি একটা টান অনুভব করতেন ব্রজেন। ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। স্কুল পর্যায়ে সর্বদা স্কুল ক্যাপ্টেন থেকেছেন। পাশাপাশি ক্রিকেটও ভালো লাগত তার। আর যে সাঁতার তাকে ব্রজেন দাস হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি দিয়েছিল, সেই সাঁতার তার কাছে কখনোই খেলা বলে মনে হয়নি। তিনি সাঁতারকে নিতান্ত আনন্দের উপকরণ হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। বাড়ির পাশ দিয়ে ছুটে চলা ধলেশ্বরী নদীতেই শুরু হয় তার সাঁতারের হাতেখড়ি। অফুরন্ত সময় দিকহীনভাবে সাঁতরাতে সাঁতরাতে কখন যে ঐ জনস্রোতের সাথে নিজের প্রথম প্রেম গড়ে তুলেছিলেন, তা টেরই পাননি ব্রজেন।

ভারতীয় সাঁতারু আরতি সাহার সাথে ব্রজেন দাস; Image Courtesy: thenews.com.pk

কলকাতায় কলেজ জীবনে ব্রজেনের বাড়ির কাছে কোনো ফুটবল-ক্রিকেটাদি খেলার মাঠ না থাকলেও সুইমিংপুলটা ছিল। সেই সুইমিংপুলের মায়াতেই হোক কিংবা কতকটা রিপুর তাড়নাতেই হোক, কৈশোরের প্রথম প্রেম তখন বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিল তার। পেশাদার সাঁতারের বিভিন্ন নিয়ম-কানুনের সাথে সেই সময়ই ব্রজেন পরিচিত হতে থাকেন। ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত সাঁতারু প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে তিনি এক প্রদর্শনী সাঁতারে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময়ই তিনি ঠিক করে নেন যে সাঁতারকে নিজের জীবনে স্থায়ী আসন দিবেন। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। ১৯৪৮-৪৯ সালে আন্তকলেজ প্রতিযোগিতায় জয়ী হোন তিনি। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলেও অর্জন করেন জয়ের মুকুট। এরপর ভারত থেকে নিজ দেশে ফিরে আসেন ব্রজেন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পনাগত সাঁতারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় ব্রজেনকে। ১৯৪৮ সালে পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে পাকিস্তান সাঁতার ফেডারেশনের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। অথচ মজার ব্যাপার, সেখানে কোন নদীই নেই।

সাঁতারই ছিল ব্রজেন দাসের জীবনের প্রথম প্রেম; Image Courtesy: thedailystar.net

অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাঁতারেও পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালির অধিকার হননের চেষ্টা করছিল। সে সময় ব্রজেন দাস পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া ফেডারেশনকে বার্ষিক সাঁতার প্রতিযোগিতা চালু করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশে এক বিরাট সাঁতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০, ২০০, ৪০০ ও ১৫০০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারে ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি পরপর চার বছর চ্যাম্পিয়ন হয়ে সাঁতারে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্যের স্বাক্ষর রাখেন ব্রজেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় চারটি ইভেন্টে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণ পদক লাভ করেন তিনি।

এদিকে পাকিস্তানিদের বৈষম্য দিনদিন বেড়েই চলছিল। জাতীয় ফেডারেশনের প্রথম নির্বাহী কমিটিতে কোনো বাঙালিকে স্থান দেয়নি তারা। অথচ বাঙালির ঘরের ছেলে ব্রজেনের তখন সাঁতারু হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতি। এমনকি ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে মেলবোর্নে আয়োজিত অলিম্পিক গেমসে পাকিস্তান থেকে যে সাঁতারু দল পাঠানো হয়েছিল, সেখানেও তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি সেই সময়। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য একরকম মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৮৯ সালে সাফ গেমসে স্বর্ণপদক পাওয়া সাঁতারু মোখলেসের সাথে ব্রজেন দাস; Image Courtesy: channelionline.com

১৯৫৭ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকা স্টেডিয়ামে ১৫ ঘন্টা ২৮ মিনিটে ২৬ মাইল সাঁতার কেটে রেকর্ড তৈরি করেছিলেন ব্রজেন দাস। একই বছর নভেম্বরে তীব্র শীতের দরুন সুইমিং ক্লাবগুলো যেখানে প্র্যাক্টিস বন্ধ করে দিয়েছে, সে সময় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তরুণ ব্রজেন টানা ৫০ ঘন্টা প্র্যাক্টিস করে গেছেন। তার এই অদম্য প্রচেষ্টা নজর কেড়েছিল সবার। শুধু এখানেই শেষ নয়। ১৯৫৮ সালের মার্চ মাসে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা থেকে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী-পদ্মা ও মেঘনা নদী হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত প্রায় ৪৫ মাইল তিনি সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু এসবেও যেনো মানসিক শান্তি পাচ্ছিলেন না ব্রজেন। আরও বড় কিছু করে দেখানোর সুযোগ খুঁজছিলেন। একসময় তা পেয়েও গেলেন।

ইংলিশ চ্যানেল। ফ্রান্স এবং বৃটেনকে পৃথককারী পশ্চিম ইউরোপের এই সংকীর্ণ সাগর উত্তর সাগরকে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে যুক্ত করেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬২ কিলোমিটার এবং প্রস্থ অবস্থানভেদে সর্বোচ্চ ২৪০ কিলোমিটার থেকে সর্বনিম্ন ৩৪ কিলোমিটার হতে পারে। কলকাতার একটি পত্রিকা থেকে সর্বপ্রথম এর সন্ধান পান ব্রজেন দাস। পত্রিকাটিতে ভারতের এক সাঁতারুর কথা বলা হয়েছিল যিনি চারবার প্রচেষ্টার পরও ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

সন্তানদের সঙ্গে ব্রজেন দাশ; Image Courtesy: prothomalo.com

খবরটা ব্রজেনের মনে বেশ দাগ কেটেছিল। তখনই ঠিক করে নেন এই অসাধ্যকে তিনি সাধন করবেন। অথচ ইংলিশ চ্যানেল কি তা তিনি তখন অবধি জানতেনই না। কিন্তু ঐ যে কথায় বলে, “ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।” যেই ভাবা সেই কাজ। খুঁজে বের করলেন সেই ভারতীয় সাঁতারুকে। তার থেকেই এই চ্যানেল সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলেন। এরপর তদানীন্তন ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তি এস এ মহসিনকে ব্রজেন তার ইচ্ছার কথা জানালেন। শুনে তিনি বেশ অবাক হলেন। ব্রজেনকে আরও কিছুদিন চিন্তা করতে বললেন এই নিয়ে। কিন্তু যার হৃদয়ে নিজেকে আর নিজের মাটিকে প্রমাণ করার তীব্র নেশা একবার জেগেছে, তাকে কি আর টলানো সম্ভব!


শেষ পর্যন্ত মহসিন সাহেবও রাজি হয়ে গেলেন। ব্রজেনকে চ্যানেল অতিক্রমের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিতে কাজও শুরু করলেন। এদিকে ব্রজেন চাইছিলেন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার আগে নিজেকে একবার ঝালিয়ে নিতে। তাই ১৯৫৮ সালে ‘বিলি বাটলিন’স চ্যানেল ক্রসিং সুইমিং কম্পিটিশন’ এ তিনি নাম লেখান। ইংল্যান্ডের নেপেলস থেকে ক্রাপি আইল্যান্ড পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটারের এই দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি তৃতীয় স্থান অর্জন করেন।

ছয়বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন বাংলার কিংবদন্তি ব্রজেন দাস; Image Courtesy: BrojenDas. com


১৯৫৮ সালের ১৮ আগস্ট। রাত পৌনে দু’টা। ২৩ টি দেশের ৩৯ জন সাঁতারুকে সঙ্গে নিয়ে ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল জয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ২১ মাইলের সে পথে জোয়ার ভাটার জন্য তাকে তাকে পাড়ি দিতে হবে ৩৫ মাইল। সহজ ছিল না এ যুদ্ধ। একে তো কুয়াশার চাদরে চারপাশ মুড়ে রয়েছে, তার ওপর সাগরের পানিও ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা। তবে ভাগ্য সহায় ছিল ব্রজেনের। আবহাওয়া কিছুটা অনুকূলে থাকায় সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে পেরে উঠতে ততটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে দোভার বন্দরের কাছে এসে সামুদ্রিক স্রোতের সাথে ভালোই লড়াই চালাতে হয়েছে।

উপকূল থেকে মাত্র তিন মাইলের দূরত্ব অতিক্রম করতে তার তিন ঘন্টা সময় লেগে গিয়েছিল। ১৪ ঘন্টা ৫২ মিনিটের জল যাত্রা শেষে প্রথম দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তি হিসেবে ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার মুকুট অর্জন করেন। এবার কিন্তু পাকিস্তান সরকার ঠিকই ব্রজেনের এ সাফল্যকে নির্দ্বিধায় নিজেদের বলে প্রচার করতে থাকে। তৎকালীন বঙ্গ গভর্নর আজম খান তো তাকে ‘বাঙাল কা সের’ বলতে শুরু করে দেন। এরপর আরও পাঁচবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন ব্রজেন। এর মধ্যে একবার তো কোনোরকম বিরতি না দিয়েই ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-ইংল্যান্ড হয়ে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন।

সাঁতারে অসামান্য অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার ও ইংল্যান্ডের রাণীর কাছ থেকে পুরস্কৃত হোন ব্রজেন; Image Courtesy: The News International

সর্বশেষ ১৯৬১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে কম সময়ে (১০ ঘন্টা ৩৫ মিনিট) চ্যানেল পাড়ি দিয়ে রেকর্ড গড়েন ব্রজেন দাস। এই রেকর্ড ২০০৭ সাল পর্যন্ত তার অধিকারেই ছিল। তার কৃতিত্ব স্বরূপ ইংল্যান্ডের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে পুরস্কৃত করেন। পুরস্কার প্রদানের সময় তিনি মজা করে ব্রজেনকে বলেন, “তুমি তো ইংলিশ চ্যানেলকে নিজের বাথটাবে পরিণত করেছ।” এছাড়াও ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে ইতালির ক্যাপ্রি দ্বীপ হতে নাপোলি পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটারের দূরপাল্লার সাঁতারে তিনি তৃতীয় স্থান অর্জন করেন।

ব্রজেন দাস জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স আ্যাওয়ার্ড’, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কতৃর্ক ‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার’, ১৯৯৯ সালে ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ (মরণোত্তর) ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়াও ‘চ্যানেল সুইমিং আ্যসোসিয়েশন অফ ইউনাইটেড কিংডম’ ১৯৮৬ সালে তাকে ‘কিং অফ চ্যানেল’ উপাধি প্রদান করে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন সুইমিং’ এর হল অফ ফেমে ১৯৬৫ সালে তিনি সম্মানীয় সাঁতারু হিসেবে নিজের নাম লেখান।

‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন সুইমিং’ এর হল অফ ফমে বাংলার কৃতি সন্তান ব্রজেন দাস; Image Courtesy: sarabangla.net

ব্রজেন দাস তার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মধু চন্দ্রাকে। এক ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। ১৯৯৭ সালে মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হোন তিনি। কিছুদিন কলকাতায় চিকিৎসা গ্রহণ করলেও তা খুব একটা কাজে দেয়নি। ১৯৯৮ সালের ১ জুন, কলকাতায় ৭০ বছরের জীবনের অবসান ঘটান বাংলার এই কৃতী সন্তান।
ব্রজেন দাস ভালোবাসতেন এ দেশকে। তাই খ্যাতি বা অর্থের মোহে কখনোই শিকড় ছেড়ে যাননি। কিন্তু বঙ্গবাসী কতটা মনে রেখেছে তাকে তা নিয়ে সন্দেহ হয় বৈকি! আজকের প্রজন্মের এক-তৃতীয়াংশও হয়ত ব্রজেন দাসকে চেনে না। ইতিহাসের পাতা তার কৃতিত্বকে সশ্রদ্ধায় স্বরণ করলেও, বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ী আসন পাননি তিনি। ‘দ্য কিং অফ ইংলিশ চ্যানেল’ আজ তাই হারিয়ে যেতে বসেছেন কালের গর্ভে।

Feature Image Courtesy: prohor.in