প্রত্যেকেরই শৈশবের বেশ সুন্দর কিছু স্মৃতি থাকে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার লেলাং ইউনিয়নে জন্ম নেয়া তকিব তৌফিকেরও ছোটবেলা ছিল গল্পের মত সাজানো। রমজানের ঈদ এলে যার বাড়ির বেলকনিতে ঈদকার্ড এর দোকান বসতো, মেজবোন জাকিয়াত জাহানের সাথে। এইসব গল্প একদিন ফাগুনের কৃষ্ণচূড়া হয়ে ঝড়ে পড়ে জীবন থেকে। তকিব তৌফিক বেড়ে উঠে৷ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ – এ ‘নিদাস্তিয়া’ উপন্যাসের হাত ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার আগেও তকিব তৌফিকের বই প্রকাশ পেয়েছে আরও তিনটি। এখন তার বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। নতুন প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘ক্যাকটাস’। সবাইকে চমকে দিয়ে গল্প উপন্যাসের কাতার থেকে বের হয়ে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, পুস্তক প্রকাশন থেকে। তকিব তৌফিকের লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাকটাস’ নিয়েই আজকের বিস্তর আলোচনা।
‘ক্যাকটাস’ তকিব তৌফিকের লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন সাহাদাত হোসাইন। পুস্তক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত প্রথম বইটি এই ‘ক্যাকটাস’। যাদের পুরো একটা জীবন ক্যাকটাস মগ্নতায় যাপিত হয়েছে, তাদের কবিতাগুলো সবাইকে ‘প্রথমবার’ এর অনুভূতি দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, এটা অসম্ভব চমৎকার একটা বিষয়।

‘চোখের দেখায় ক্যাকটাস নিদারুণ সুন্দর, অথচ ছুঁতে গেলেই কাঁটা বিঁধে যায়’ লাইনটি দিয়ে ফ্ল্যাপের লেখা শুরু। মোট ৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটি পড়া শেষ করে যখন পিছনের ফ্ল্যাপে লেখক সম্পর্কে পড়তে নিবেন, মনটা আঁতকে উঠবে, আচমকা সব ঝাপসা হতে শুরু করবে। গলাটা ভার হয়ে আসবে। অনেকটা সময় চুপচাপ কেটে যাবে। জীবন কতোটা অদ্ভুত, তা ‘ক্যাকটাস’ গ্রন্থের কবিতা পড়তে পড়তে ধারণা নিতে নিতে যখন শেষ ফ্ল্যাপে জাকিয়াত জাহানের সঙ্গে পরিচয় ঘটবে, তখন মন খারাপের সময় শুরু হবে।
মোট ৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটিতে কবিতা আছে ৬৬ টি। রঙ-বেরঙের শত অনুভূতির কবিতা। পাওয়া না পাওয়ার কতো শত কথা সেসব কাব্যে। মান অভিমানের এক জীবন বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায় যেন। শত মাইল বিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে সচরাচর কিছুই যখন চোখে পড়ে না, তখনও যা চোখে পড়ে সেই কাঁটাযুক্ত গাছটার নাম ‘ক্যাকটাস’। কী সুন্দর সবুজ উদ্ভিদ! ছুঁতে গেলেই কাঁটা বিঁধে প্রকাশ পায় আসল রূপ। আঘাত পেয়ে পিছু হটে স্পর্শকারী। তারপরেও কাছে আসে, আবার ছুঁতে চায়, একটাবার। এই মাইলের পর মাইল মরুভূমিতে যেমন এই ক্যাকটাস ছাড়া কিছু পাওয়া যায়না, জীবনেও এমন সাতরঙা কিছু অনুভূতি, স্মৃতি বাসা বাঁধে, এক জীবনে যেই স্মৃতি ছাড়া পথ চলা হয়ে উঠে না। সেসব দুঃখগাঁথাকে সাদরে বরণ করে পথচলা ক্যাকটাস প্রেমিদের জন্যেই তকিব তৌফিকের লেখা এই কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যাকটাস’।

বইটি সেই সকল প্রেমিক প্রেমিকাদের নামে উৎসর্গ করা যাদের একতরফা প্রেম ক্যাকটাস হয়ে বুকে বিঁধে আছে। অবশ্য কবিতাগুলোকে পড়ে মনে হতে পারে প্রেমিক পক্ষের কবিতাই ঢের বেশি জায়গা পেয়েছে বইটিতে। হারিয়ে ফেলার আঘাত ঠিক কতোটা বড়, সেই সংশয় ব্যক্ত করেই শুরু হয়েছে কবিতাদের পথচলা।
“হারিয়ে ফেলার চেয়ে ___
হারিয়ে ফেলবো সেই শঙ্কা গুরুতর।
হারিয়ে ফেলা না জানি ___
আঘাত হিসেবে কতটা বড়সড়!”
ঠিক এভাবেই মন্ত্রমুগ্ধ ছন্দ সাজিয়ে পাঠকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন লেখক তকিব তৌফিক। ক্যাকটাস কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাই ‘ক্যাকটাস’। এরপ পর্যায়ক্রমে সুক্ষ্মদর্শী ছন্দ সাজিয়ে লেখা ‘আমি ক্যাস্পার’, উন্মাদ অনুভূতি জড়ানো ‘চিরকুট সংলাপ’, অভাব অনটনের ‘সংসার’, ছোট ছোট গল্পে মোড়ানো ‘বেপজা গেইট’ হয়ে একে একে লিখা আছে ৬৬ টি কবিতা। কোনোটা ছোট, কোনোটা আবার বেশ বড়। অনুভূতির প্রখরতা বলি কিংবা গভীরতা, কোন কবিতায় কম আর কোন কবিতায় বেশি তা বুঝে উঠা সামান্য এক পাঠক হিসেবে হয়ত অচিন্তনীয়। কিন্তু প্রতিটি কবিতার মধ্যে যেই গল্প বোনা রয়েছে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মান-অভিমানের যেই ছন্দ সাজানো আছে, তা যে নিতান্তই এক মহান সৃষ্টি, এক নিমিষেই বুঝে উঠা যায়।

সবগুলো কবিতার মাঝে সবচাইতে আলোচিত, পাঠকপ্রিয় দশটি কবিতা–
১. সংসার
২. বেপজা গেইট
৩. সাবলেট
৪. বিচ্ছেদের বর্ষপূর্তি
৫. কাঁচের চুড়ির অপরাধ ছিলো
৬. দুর্লেখ্য
৭. প্রত্যাশা
৮. চিঠি
৯. নিবন্ধিত প্রেম
১০. হৃদয় ম্লান
এছাড়াও ১৬টি অনুকাব্যের সমন্বয়ে সাজানো ‘ভয়ঙ্কর প্রেমানুভূতি’ কবিতাটিও ভীষণ রকমের সুন্দর। যেখানে আপনার হুট করে মন ভালো হবে, হুট করে পুরানো স্মৃতি এসে মন খারাপ করাবে। কিংবা কখনও বেশ জেদ চেপে বসবে মনের মাঝে। মিশ্রিত সেসব অনুভূতির গল্প জানতে, ছন্দের ফাঁকফোকর গলিয়ে নিজের স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে এই ‘ক্যাকটাস’ যে কতোটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে তা নিজেও আঁচ করতে পারবেন না হয়তো।

“হুট করে আঁধারকে হারিয়ে পুলকিত হয় চারপাশ!
আগুনের আলো চারিপাশে ___
আহা, বটের ডালে সর্বনাশ!
ঝুলছে এক উজবুক প্রেমিকের লাশ। “
~ বটের ডালে সর্বনাশ [ পৃষ্ঠা ৯৫ ]
শেষ কবিতা টা হতে পারতো ‘বটের ডালে সর্বনাশ’; কিন্তু লেখক কেন এই কবিতার পরেও ‘প্রাক্তন প্রিয় হাত’ লিখলেন তা হয়তো বিঁধে থাকা ক্যাকটাসের কাঁটা-ই বলতে পারবে। বটগাছের ডাল যখন শেষ সর্বনাশের সাক্ষী হয়, তখন কাব্যগ্রন্থটির ইতি টেনে দিলে পাঠক নিদারুণ ঘোরের মধ্যে পড়ে যেত, যা থেকে উঠে আসতে কেউ কেউ হয়ত অনেক দিন লাগিয়ে দিতে পারে। সম্পূর্ণ বই মন দিয়ে পড়লে প্রত্যেকটা পঙতিই গেঁথে যাবে মনের ভেতর। এরপরেও ভীষণভাবে গেঁথে যাওয়া কিছু ছন্দের অস্তিত্ব জুড়ে দিলাম নীচে-

১.
“বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলেছি
অবরোধ ডেকেছি চৌ–রাস্তার মোড়ে,
শহরের কোথাও তুমি কেন নেই!
দাবি একটাই ফিরে এসো জীবন জুড়ে।“
~ ভয়ঙ্কর প্রেমানুভূতি [ পৃষ্ঠা ৯১ ]
২.
“যে হারিয়ে ফেলে সে জানে __
হারানোর বয়ান কতোটা ব্যাথাতুর
প্রিয় হারালেই যেনো জীবনের পায়ে বেড়ি
অল্প দূরত্বটাও তখন হাজার মাইল দূর।“
~ নিজেকে ধোঁকা [ পৃষ্ঠা ৮৯ ]
৩.
“এত এত ভিড়
কত শত মুখ প্রাণ
আমার একটা মানুষ নাই কোথাও
মনের মানুষের অভাব ভীষণ __ হৃদয় ম্লান।”~ হৃদয় ম্লান [ পৃষ্ঠা ৮৭ ]

৪.
“সব আজ আলাদা আলাদা
চাঁদনী রাত, সোনালী প্রভাত
এমন কি __ দু‘জনের এখন আলাদা দুটো ছাদ।“
~ পৃথক [ পৃষ্ঠা ৫২ ]
৫.
“বিঁধে থাকা কাঁটার অসহনীয় ব্যথা, আবার সেই আভাস
এতো আমার পুরোনো সর্বনাশ __ সাবলেটে ক্যাকটাস।“
~ সাবলেট [ পৃষ্ঠা ১৬ ]
এমন সব চমৎকার ছন্দের আয়োজনে মুখরিত সমগ্র কাব্যগ্রন্থটি। কাব্যগ্রন্থটি পড়ে কখনো মন খুশির কারণ হবে, কখনোবা হারিয়ে যেতে হবে পুরোনো সর্বনাশের স্মৃতিতে। তবে এই পেয়ে উঠা কিংবা হারিয়ে যাওয়ার মাঝে ‘ক্যাকটাস’ কাব্যগ্রন্থ যে আপনার দারুণ এক সঙ্গী হয়ে উঠবে সেই কথা নাহয় লিখেই দিলাম৷
Feature Image Courtesy: তকিবের তপস্যা Facebook Group