এই একবিংশ শতকে মানুষ যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করে প্লেন-বাস-ট্রেন-লঞ্চ, প্রাইভেট কার ইত্যাদি যানবাহন। প্রাইভেট গাড়ি গুলো বাদে অন্যান্য যানবাহনে যাতায়াতের জন্য মানুষ অর্থ ব্যয় (ভাড়া) করে। আচ্ছা এই যানবাহনগুলোতে সর্বনিম্ন ভাড়া কত হতে পারে? যদি রিক্সার কথাই ধরি, তাহলে রিক্সাতে উঠলেই ১৫/২০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। আবার যদি গণপরিবহন বাসের দিকে লক্ষ করি তাহলে এক কিলোমিটার কিংবা একবার বাসে উঠলে আপনাকে পাঁচ টাকা ভাড়া দিতে হয়। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট কিংবা মৎস্যভবন যেদিকেই যাই না কেন ভাড়া পাঁচ টাকা, আবার সিটিং সার্ভিস হলে তো ভাড়া এর দ্বিগুণ। আবার যদি ট্রেনের কথা চিন্তা করি তাহলে সর্বনিম্ন ভাড়া পাবো ৭ টাকায় টিকেট। এখন আপনাদের যদি বলি মাত্র এক কিলোমিটার না, শাহবাগ থেকে ফার্মগেট অথবা সাইন্সল্যাব না, এক্কেবারে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা রাজশাহীর মত এমন ৩০০-৪০০ কিলোমিটার দূরে মাত্র এক টাকার একটু বেশি কিছু (১ রুপি) দিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন তাহলে পাঠক হয়ত তা বিশ্বাসই করবেন না! আবার যদি বলি সেটি বিমানে করে তাহলে আপনারা বেশ চিন্তার মধ্যেই পড়ে যাবেন। আরেহ! বিমানে করে যাতায়াত, তাও মাত্র এক টাকার চেয়ে একটু বেশি দিয়ে (১ রুপি)। এটাও সম্ভব? এটা সম্ভব কি সম্ভব না তা নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন এর মধ্যে আপনাদের একটি ছবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, আসুন।

সুরারাই পট্টরু (সাহসী ব্যক্তির প্রশংসা) ছবিটি ২০২০ সালের নভেম্বরের ১২ তারিখে অ্যামাজন প্রাইম-এ রিলিজ হয়েছে। ছবিটিতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তামিল অভিনেতা সুরিয়া। তিনি ছবিতে নেদুমারান রাজাঙ্গম চরিত্রে অভিনয় করেন। নেদুমারান পেশায় বিমানবাহিনীর পাইলট। বিমানবাহিনীর ক্যাম্পে থাকাকালীন তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবাকে শেষ দেখা দেখার জন্য তাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে দ্রুত রওনা করতে হয়। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে সে বিমানে করে যেতে পারে না। পরে বিভিন্ন যানবাহনে করে অনেক দেরিতে সে বাড়িতে পৌঁছালে ততক্ষণে তার বাবা মারা যায়। তারপরেই নেদুমারান সংকল্প করে যে করেই হোক সকলের জন্য বিমানের যাতায়াতের ব্যবস্থা সে করবে। সে ও তার আরো দুজন বন্ধু মিলে চালু করে ডেকেন এয়ার। সেখানে স্বল্প খরচে যাত্রী যাতায়াতের পাশাপাশি মাত্র এক রুপির বিনিময়ে কিছু সংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করতে পারতো। ছবিটি প্রযোজনা করেন একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী গুণীত মোনগা।

আর এই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে ক্যাপ্টেন গোপিনাথের স্মৃতিকথা নিয়ে। যিনি ২০০৩ সালে ভারতে স্বল্প খরচের বিমান সংস্থা চালু করেন। যেখানে কিছুসংখ্যক যাত্রী মাত্র এক রুপির বিনিময়ে যাতায়াত করতে পারতো। ছবিটিতে দেখানো হয় কীভাবে ক্যাপ্টেন গোপীনাথ ইন্ডিয়াতে অব্যবহৃত ৫০০ টির মত এয়ারস্ট্রিপস খুঁজে পেয়েছিল এবং সেগুলো ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছিল আঞ্চলিক যোগাযোগ প্রসারিত করার জন্য। ছবিতে আরও দেখানো হয় কীভাবে তার স্ত্রী তার ছোট্ট বেকারি ব্যবসা থেকে তার স্বামীকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন যখন তিনি অর্থের অভাবে ছিলেন। এটি আরও দেখিয়েছে কীভাবে তার বন্ধুরা তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল তার এই স্বপ্ন পূরণে।

ক্যাপ্টেন গোপীনাথ দক্ষিণ ভারতের কারনাটাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কৃষক ও শিক্ষক, মা একজন গৃহিনী। তিনি আর্মিতে যোগদান করেন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২৮ বছর বয়সে গোপীনাথ অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি চাষাবাদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসা করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ইন্ডিয়াতে একটি হেলিকপ্টার সেবা চালু করেন। এই সেবার ট্যাগলাইন ছিল এমন, “আপনি যদি মানচিত্রে আমাদের একটা জায়গা দেখিয়ে দেন, আমরা আপনাকে সেখানে পৌঁছে দেব।”
২০০৩ সালের আগস্টে তিনি এয়ার ডেকেনের যাত্রা শুরু করেন দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটি ৪৮ সিটারের টার্বো বিমান দিয়ে। এই স্বল্প খরচের বিমান সংস্থার বিশেষত্ব ছিল এখানে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি মাত্র এক রুপির বিনিময়ে যাতায়াত করতে পারতো। তবে সেটি শুধু যেসব যাত্রী আগে আসতো তাদের জন্য। আর পরে আসা যাত্রীরা তার চেয়ে বেশি দাম দিয়ে যাতায়াত করতো তবে সেটি ছিল একদমই স্বল্পমূল্যের।

এয়ার ডেকেনের সাথে ফুড কন্ট্রাক করে তার স্ত্রীও সেই বছর সাত কোটি টাকা তার বেকারি থেকে লাভ করেছিল। ২০০৭ সাল নাগাদ এই এয়ারলাইন প্রতিদিন ৬৭ টি বিমানবন্দর থেকে ৩৮০ টিরও বেশি ফ্লাইট চালনা করত। এই এয়ারলাইনের তখন ৪৫ টিরও বেশী বিমান ছিল। এয়ারলাইনটি চালু হওয়ার সময় যেখানে প্রতিদিন ২০০০ জন যাত্রী যাতায়াত করতো, সেখানে ২০০৭ নাগাদ যাতায়াত করতো প্রতিদিন প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি যাত্রী। প্রায় ৩০ লাখ যাত্রী মাত্র ১ রুপি টিকিট দিয়ে যাতায়াত করেছিল।
কিন্তু ২০০৭ সালে ক্যাপ্টেন গোপীনাথ এয়ার ডেকেন বিক্রি করে দেয়। কেননা তিনি ব্যবসায় প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন। আর এটি ক্রয় করে কিংফিশার এয়ারলাইনস। এয়ার ডেকেনের নতুন নাম দেয়া হয় কিংফিশার রেড। কিন্তু ২০১১ সালে কিংফিশার এয়ারলাইন এর মালিক মিস্টার মালায়া কিংফিশার রেড বন্ধ করে দেয়।

২০১২ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্যাপ্টেন গোপীনাথ বলেন,”মিস্টার মালায়ার কাছে কোন সময় ছিল না এই এয়ারলাইন এর জন্য, তিনি যদি এটিতে মনোযোগ দিতেন তাহলে তার থেকে ভালো এটি কেউ সামলাতে পারতো না।”
এয়ার ডেকেন বন্ধ হয়ে গেলেও স্বল্প খরচে বিমান যাতায়াতের যে আইডিয়া ক্যাপ্টেন গোপীনাথ শুরু করেছিলেন তা এখনও টিকে আছে। গোপীনাথের পর আরো অনেক কোম্পানি এই আইডিয়া গ্রহণ করে এবং নিজেদের এয়ারলাইনে তা কার্যকর করে। ২০১৮ সাল নাগাদ ভারতে প্রায় ১৪০ মিলিয়নের বেশি যাত্রী স্বল্প খরচে বিমান যাতায়াত করেছে।

ক্যাপ্টেন গোপিনাথের হাত ধরেই ইন্ডিয়াতে স্বল্প খরচের বিমান সংস্থা চালু হয় এবং তিনি প্রায় ৭০% ভারতীয় নাগরিককে আকাশে উড়াতে সক্ষম হন- যারা ছিল মধ্যবিত্ত। এর মাধ্যমে তিনি ভেঙে দিয়েছিলেন উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের মধ্যে চলমান শ্রেণী বৈষম্য। সবাইকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন এক কাতারে। ২০১৮ সালে ভারত সরকার UDAN নামে একটি প্রকল্প চালু করে যার উদ্দেশ্য হলো প্রত্যেক নাগরিককে বিমান সুবিধা দেয়া। আর এই প্রকল্পের প্রধান হলো ক্যাপ্টেন গোপীনাথ। তার হাতে গড়া এয়ার ডেকেন বন্ধ হয়ে গেলেও যে স্বপ্নে তিনি এয়ার ডেকেনের যাত্রা শুরু করেছিলেন তা এখনোও চলমান রয়েছে।
Feature Image Courtesy: bbc.com