বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমার দুর্দান্ত কিছু খলঅভিনয়

বাংলাদেশ কিংবা কোলকাতার বাংলা বাণিজ্যিক ছবির ভেতরে এমন কিছু ছবি আছে যেগুলোর খলচরিত্র ছিল  দুর্দান্ত। নায়কের সাথে সমানে সমান টক্কর, কোন কোন ক্ষেত্রে নায়ককেও ছাপিয়ে যাওয়া এমন কিছু বাংলা ছবির খলচরিত্রদের কথা তুলে ধরব এ লেখায়। পাঠক, আসুন দেখে নিই তেমন কিছু সিনেমা ও সেগুলোর খলচরিত্র।

দাঙ্গা (১৯৯২)

কাজী হায়াত পরিচালিত এ ছবিতে কালু চরিত্রে রাজীব দুর্দান্ত ছিলেন। ছবিতে আশীষ কুমার লোহর চোখ তুলে নেয়া কিংবা ছবির শেষে মান্নার হাত কেটে নেয়া, সুচরিতাকে হত্যা ইত্যাদির কারণে রাজীব দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ছবিটির জন্য প্রথমবারের মত খলচরিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। সাথে দুর্নীতিবাজ নেতার চরিত্রে মিজু আহমেদও খুব ভালো অভিনয় করেছিলেন। রাজীবের ‘মাইণ্ড করলাম’ সংলাপটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।  

দাঙ্গা ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন রাজীব; Image Courtesy: ekhon24.com

প্রতিশোধ (১৯৭২)

‘প্রতিশোধ’ জহির রায়হান প্রযোজিত শেষ ছবি। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন বাবুল চৌধুরী। অকালপ্রয়াত দুর্দান্ত খলঅভিনেতা রাজু আহমেদ ছিলেন ছবির মুখ্য খল। সাথে আরো কয়েকজন। রাজ্জাককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, তার মাকে গাড়িচাপায় হত্যা, প্রেমিকা সুচন্দাকে কেড়ে নেবার চেষ্টা- সব মিলিয়ে রাজু ছিলেন দুর্দান্ত।

রাজু আহমেদ (১৯৩৯-৭২); Image Courtesy: BD-pratidin.com

মাটির ঘর (১৯৭৯)

‘মাটির ঘর’ ছবিটিতে খলিল দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন গ্রাম্য মোড়লের চরিত্রটিতে। শাবানাকে ধর্ষণ করার দৃশ্যে ভয়ংকর ছিলেন তিনি। রাজ্জাকের হাতে শেষে তাকে মরতে হলেও রাজ্জাক-শাবানার প্রাণও যায়। ছবিটি পরিচালনায় ছিলেন আজিজুর রহমান।

দাপুটে অভিনেতা খলিলউল্লাহ খান; Image Courtesy: Samakal.com

বিশ্বপ্রেমিক (১৯৯৫)

শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত এই ছবিতে হুমায়ূন ফরীদি অভিনয় করেন একজন সাইকোপ্যাথের চরিত্রে। মেয়েদের হত্যা করে তাদের গলার তিল দিয়ে মালা বানাতেন তিনি! শেষমুহুর্ত পর্যন্ত ছবিটি জমিয়ে রেখেছিলেন তিনি।

অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি; Image Courtesy: banglatribune.com

বাঘবন্দী খেলা (১৯৭৫)

পীযূষ বসু পরিচালিত এ ছবিতে খলনায়ক ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। ভবেশ চাটুজ্জে নামের চরিত্রটি জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি। সুলতা চৌধুরীর সাথে তাঁর করা ‘আয় আয় আসমানি কবুতর’ (কণ্ঠ: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) ছবিটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল।

মহানায়ক উত্তম কুমার; Image Courtesy: samprotik.com.bd

অমানুষ (১৯৭৫)

‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে তো হীরক রাজ হিসেবে আমরা দেখেছি কিংবদন্তী অভিনেতা উৎপল দত্তকে। শক্তি সামন্তের ‘অমানুষ’ সিনেমাতে উত্তমের বিপরীতে উৎপলের খলচরিত্র দারুণ জমে উঠেছিল। ষড়যন্ত্র করে তাঁকে বাড়িছাড়া, সম্পত্তিহীন করা কিংবা তার প্রেমিকাকে কেড়ে নেয়া- উৎপল ছিলেন অনবদ্য।

উৎপল দত্ত, Image Courtesy: bongodorshon.com

ঝিন্দের বন্দী (১৯৬১)

তপন সিনহা পরিচালিত এ ছবিটি শরদিন্দু বন্দ্যেপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস থেকে নির্মিত। এখানে খলচরিত্রে ছিলেন গুণী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ময়ূরবাহন নামের চরিত্রটিতে হিংসা-পরশ্রীকাতরতা-কূটকৌশলের মূর্ত প্রতীকরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, Image Courtesy: pinterest.com

বহ্নিশিখা (১৯৭৬)

অগ্রদূত পরিচালিত এ ছবিতে খলচরিত্রে অভিনয় করেছে উত্তম কুমার। দীনদয়াল সেন, যিনি দিনে একজন সমাজসেবী, রাতে স্মাগলার শিরোমণি। উত্তম এই দুরকম চরিত্র দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ছবিতে।

মহানায়ক উত্তম কুমারও দারুণ ছিলেন খলচরিত্রে; Image Courtesy: pinterest.in

গাংচিল (১৯৮০)

এই ছবিতে খলচরিত্রে অভিনয় করেন গুণী অভিনেতা আহমেদ শরীফ। কৈশোরে অপবাদের শিকার হয়ে মা-র আত্মহত্যা যাকে তিলে তিলে পরিণত করেছিল একজন সাইকোপ্যাথে। ছবিটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার লাভ করেন তিনি। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন রুহুল আমীন।

শক্তিমান খলনায়ক আহমেদ শরীফ; Image Courtesy: bdnews24us.com

হারানো দিন (১৯৬১)

মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ বাংলাদেশের প্রথমদিকের সিনেমা। শক্তিমান অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা এখানে এক লম্পট জমিদারের চরিত্রে অভিনয় করেন। তাঁর ভরাট কণ্ঠ আর এক্সপ্রেশন চরিত্রটিকে অন্য মাত্রাদিয়েছিল। 

গোলাম মুস্তাফা, Image Courtesy: bd-journal.com

ত্যাগ (১৯৯২)

শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত এই সিনেমায় খলচরিত্রে ছিলেন শওকত আকবর, এটিএম শামসুজ্জামান, মিজু আহমেদ ও হুমায়ূন ফরীদি। এক ভয়ংকর কন্ট্র‍্যাক্ট কিলারের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন ফরীদি। এই সিনেমার ‘তেল গেলে ফুরাইয়া’ গানটি তাঁর চরিত্রকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল।

হুমায়ূন ফরীদি; Image Courtesy: gonews24.com

ঘাতক (১৯৯৪)

‘ঘাতক’ ছবিটি পরিচালনায় ছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকন এবং খলচরিত্রে এবারো হুমায়ূন ফরীদি। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের চরিত্র করেছিলেন তিনি। ছবিটি মুক্তির সময় ব্যাপক হুমকির কারণে প্রেক্ষাগৃহে পুলিশ মোতায়েন করে সরকার। ছবি অবশ্য সুপারহিট হয়, যার মূলে ছিলেন ফরীদি।

প্রতিশোধ (১৯৮১)

সুখেন দাসের ছবি ‘প্রতিশোধ’ এ খলচরিত্রে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। দাদা উত্তম কুমারের সব সম্পত্তি দখল ও তাঁকে হত্যাচেষ্টা করেন সৌমিত্র। ভাতিজাকে গ্রাম ছাড়া করেন মিথ্যে অভিযোগে। সৌমিত্র তাঁর অন্যতম সেরা অভিনয় করেছিলেন এ ছবিতে। বিশেষত অনামিকা সাহার সাথে ‘কী বিষের ছোবল দিবি’ গানে।

খলচরিত্রে কম যাননি শক্তিমান ভার্সেটাইল অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়; Image Courtesy: anandabazar.com

বান্ছারামের বাগান (১৯৮০)

তপন সিনহার এ ছবিকে পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ছবি বলা যায়না, এটা মূলত মিডল ফিল্ম। দীপংকর দে তাঁর জীবনের সেরা অভিনয় করেছিলেন এ ছবিতে। প্রথমে এক লম্পট জমিদার, তারপর আবার তারই ছেলের রোল। দুর্দান্ত বললেও কম হয়ে যায়। চোখের এক্সপ্রেশন আর ডায়ালোগ ডেলিভারির বৈচিত্র্য তাঁর অভিনয়কে অন্য মাত্রা দিয়েছিল।

দীপংকর দে, Image Courtesy: tumblr.com

ফরিয়াদ (১৯৭১)

বিজয় বসুর এই ছবিতে সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেন উৎপল দত্ত। লম্পট এক ব্যবসায়ী, যিনি নিজের স্ত্রীকে বারড্যান্সার হিসেবে ব্যবহার করেন! উৎপল দত্তের এই অভিনয় খলচরিত্রের প্রথা ভেঙে দিয়েছিল।

ভয় (১৯৯৬)

চিরঞ্জিত পরিচালিত এ ছবিতে খলচরিত্রে ছিলেন দুলাল লাহিড়ী ও সৌমিত্র ব্যানার্জী (চ্যাটার্জী নয়)। সৌমিত্র ব্যানার্জী নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে চান স্ত্রী দেবশ্রী রায়কে, কিন্তু পালিয়ে যান দেবশ্রী। সৌমিত্রের চরিত্রটির এপিয়েরেন্সই ছিলো ভীতি জাগানিয়া, কিছুটা ভিন্নধাঁচের, আলাদা মাত্রার।

৪২ (১৯৫০)

হেমেন গুপ্ত পরিচালিত এ ছবিতে খ্যাতিমান অভিনেতা বিকাশ রায় খলচরিত্রে ছিলেন। ছবিটি পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক নয়, তবে ভারত ছাড় আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত এ ছবিটিতে বিকাশ রায়ের অভিনয় দেখে পর্দায় জুতো ছুঁড়েছিলেন দর্শক!

বিকাশ রায়, Image Courtesy: anandabazar.com

নয়নমণি (১৯৭৬)

এটিএম শামসুজ্জামান খল অভিনয়ের নতুন ধরণ নিয়ে আসেন এ ছবিতে। ব্ল্যাক কমেডিনির্ভর গ্রাম্য মোড়লের খলচরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন তিনি। পরিচালনায় ছিলেন গুণী পরিচালক আমজাদ হোসেন।

গুণী অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান; Image Courtesy: dhakatribune.com

পালাবি কোথায় (১৯৯৭)

আরো একবার পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন ও খলচরিত্রে হুমায়ূন ফরীদি। ফরীদির প্রযোজিত এ ছবির মূল কাহিনী ছিলো হলিউড ছবির। ফরীদি অভিনয় করেছিলেন একজন লম্পট কারখানা ম্যানেজারের চরিত্রে। এটিও ব্ল্যাক কমেডি নির্ভর একটি চমৎকার অভিনয়।

শত্রু (১৯৮৪)

অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত ব্লকবাস্টার হিট এই ছবিটির মূল অস্ত্র ছিলো ডায়ালগ। আর সেই ডায়ালগে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন শক্তিমান অভিনেতা মনোজ মিত্র। ছবিটি বলিউডেও রিমেক হয়েছিল।

হীরা চুনি পান্না (২০০০)

মালেক আফসারীর এই ছবিতে খলচরিত্রে ছিলেন ডিপজল। মিথ্যে একজন হিজড়া সেজে প্রতারণা করেন তিনি। ছবি সুপারহিট হলেও ডিপজলের চরিত্রটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয় বেশ। তবে চরিত্রটিতে নতুনত্ব এবং ডার্ক হিউমার ছিলো। তার অভিনয়ের ধরণ একধাঁচের হলেও গিমিক, ডার্ক হিউমারাস ডায়লগ, চেহারা ও চোখের এক্সপ্রেশনের কারণে ছবি সুপার-ডুপার হিট করে।

ডিপজল, Image Courtesy: daily-bangladesh.com

দোস্তদুশমন (১৯৭৭)

দেওয়ান নজরুল পরিচালিত এই ছবিটি ছিলো বলিউডের ‘শোলে’ ছবির রিমেক। এখানে গাফফার নামের ডাকাত চরিত্রে অভিনয় করেন জসীম। অরিজিনাল গাব্বার চরিত্রে অভিনয় করা আমজাদ খান পর্যন্ত জসীমের খলঅভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।

Feature Image Courtesy: bp.blogspot.com