প্রত্যেক খেলোয়াড়ের আজন্ম লালিত স্বপ্ন থাকে দেশের জার্সি গায়ে নিজের মাতৃভূমিকে প্রতিনিধিত্ব করার। আর বড় মঞ্চ হলে তো কথাই নেই। তেমনিভাবে একজন ক্রিকেটারেরও স্বপ্ন থাকে দেশের জার্সি গায়ে চাপিয়ে বিশ্বকাপে দলকে প্রতিনিধিত্ব করার। কিন্তু সবার ভাগ্যে সেই সুযোগ মেলে না। চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হওয়া এই ক্রীড়াযজ্ঞে অনেক খেলোয়াড়ই ইনজুরি কিংবা ফর্ম পড়তির দরুন ব্রাত্য থেকেছেন বিশ্বকাপ দল থেকে। আজ জেনে নেবো এমনই কয়েকজন বিখ্যাত ক্রিকেটার সম্পর্কে, যারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাঙ্গনে বেশ সফল হলেও বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি কোনো ম্যাচ।

জাস্টিন ল্যাঙ্গার (অস্ট্রেলিয়া)

বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশিবারের চ্যাম্পিয়ন দল অস্ট্রেলিয়ায় কখনোই প্রতিভাবান ক্রিকেটারের ঘাটতি ছিল না। বরং কাকে রেখে কাকে একাদশে খেলাবেন একটা সময় এই নিয়েই বিপাকে পড়তেন বিচারকরা। রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বে সেই সোনালী প্রজন্মের অস্ট্রেলিয়া তো ছিল বলতে গেলে অপ্রতিরোধ্য-ই। সেই সোনালী সময়ের তো বটেই, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ওপেনার বিবেচিত হওয়া জাস্টিন ল্যাঙ্গারেরর সৌভাগ্য হয়নি অজিদের হয়ে বিশ্বমঞ্চে খেলার।

াস্টিন ল্যাঙ্গার; Image Courtesy: ICC

এই ওপেনারের অভিষেক হয় ১৯৯৩ সালে সাদা জার্সি গায়ে। সেই থেকে এক যুগের বেশি সময় ধরে খেলে টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন ১০৫ বার। রান করেছেন ৭,৬৯৬। ২০০০ সালের শুরুর দিকে ম্যাথু হেইডেনকে নিয়ে গড়েছেন ভয়ঙ্কর ওপেনিং জুটি। কিন্তু নিজের প্রতিভার ছিটেফোঁটাও টেনে আনতে পারেননি একদিনের ক্রিকেটে। ১৯৯৪ সালে লঙ্কানদের বিরুদ্ধে অভিষেক হলেও ১৯৯৭ এর পর থেকে আর খেলতে পারেননি ওডিআই ক্রিকেট। অথচ টেস্ট খেলেছেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। অজিদের হয়ে ওয়ানডেতে জাস্টিন ল্যাঙ্গার খেলেছেন মাত্র ৮ ম্যাচ। ৩২ গড়ে করেছেন ১৬০ রান। নেই কোনো অর্ধশতকও। তাই সেই সময়ের প্রতিভাবান পাইপলাইনের কাছে জায়গা হারিয়েছেনও দ্রুতই। তাই বিশ্বকাপ খেলা স্বপ্নই থেকে যায় ল্যাঙ্গারের।

তবে মজার বিষয় হলো, খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ না খেলতে পারলেও ২০১৯ সালে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপে পা রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন ল্যাঙ্গার।  

বর্তমালে অস্ট্রেলিয়ার কোচের দায়িত্ব পালন করছেন ল্যাঙ্গার; Image Courtesy: Pinterest

ক্রিস মার্টিন (নিউজিল্যান্ড)

শুধুমাত্র স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ও ডেনিয়েল ভেট্টোরির ঝুলিতেই রয়েছে ক্রিস মার্টিনের চেয়ে নিউজিল্যান্ডের হয়ে বেশি সংখ্যক টেস্ট উইকেট। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় সাদা পোশাকে বহুদিন ধরে কিউই বাহিনীর আস্থার প্রতীক ছিলেন এই ফাস্ট বোলার। শেন বন্ডের সাথে জুটি বেঁধে নিউজিল্যান্ডের ভরসার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ক্রিস মার্টিন।

ভেট্টোরির সাথে ক্রিস মার্টিন; Image Courtesy: Sportskeeda

কিইউদের হয়ে ৭১ টেস্ট খেলে মার্টিনের উইকেটের সংখ্যা ২৩৩টি। ১৩ বছর ধরে টেস্ট খেললেও অন্যদিকে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সময়কাল মাত্র ৭ বছর। ২০০১ সালে অভিষেকের পর মার্টিনের সর্বশেষ ওডিআই ২০০৮ সালে। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য যে, সাত বছরে তিনি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন মোটে ২১ বার। তাতে নিয়েছেন ২০টি উইকেট। শেন বন্ড, জ্যাকব ওরামদের মতো বোলাররাই জায়গা দখল করে রেখেছিলেন ওয়ানডের একাদশে। তাই ক্রিস মার্টিন সুযোগ পেয়েছেন খুবই কম। সামান্য যেসব পেয়েছেন তাতেও নির্বাচকদের খুশি করার মতো কোনো পারফরমেন্স উপহার দিতে পারেননি। তবে ২০০৭ বিশ্বকাপের সময় ড্যারেল টাফির ইনজুরিতে কপাল খুলেছিল তার। বদলি খেলোয়াড় হিসেবে নিউজিল্যান্ড দলে জায়গা পান তিনি। কিন্তু পুরো বিশ্বকাপে বেঞ্চ গরম করেই থাকতে হয় ক্রিস মার্টিনকে। মাঠে নামার সুযোগ পাননি একবারও।

ম্যাথু হগার্ড (ইংল্যান্ড)

ইংল্যান্ডের হয়ে ক্যারিয়ারটা তেমন দীর্ঘ না করতে পারলেও সাদা পোশাকে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সেরা দশ উইকেট শিকারীর তালিকায় রয়েছেন হগার্ড। ২০০০ সালে থ্রি লায়ন্সদের হয়ে টেস্ট অভিষেক ঘটে এই ফাস্ট বোলারের। এরপর থেকেই টানা পারফর্ম করে গেছেন তিনি। মাত্র ৬৭ টেস্ট খেলেই শিকার করেছেন ২৪৮টি উইকেট। ২০০৫ সালের ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অ্যাশেজ জয়ে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

ওডিআই-তে এই রুপে হগার্ডকে দেখা গিয়েছে খুব কম সময়ই; Image Courtesy: ESPN

তবে আলো ছড়াতে পারেননি রঙিন পোশাকে। ২০০১ সালে অভিষেকের পর খেলেছেন ২৬টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। উইকেট সংখ্যা ৩২টি। কিন্তু থিতু হতে পারেননি কখনোই। ২০০৩ বিশ্বকাপে দলের সাথে থাকলেও মাঠে নামতে পারেননি এক ম্যাচেও। ২০০৩ বিশ্বকাপে জায়গা না পেয়ে টেস্টেই মনোযোগ দেওয়ার জন্য রঙিন পোশাককে অনেক দ্রুতই বিদায় জানান হগার্ড। ২০০৬ সালে ভারতের বিপক্ষে খেলা ম্যাচটিই হয়ে থাকে এই ফাস্ট বোলারের শেষ ওডিআই ম্যাচ।

এলিস্টার কুক (ইংল্যান্ড)

একটা সময়ে ভাবা হতো টেন্ডুলকারের টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৮,০০০ হাজার রানের মাইলফলক টপকানোর সাধ্য আছে একমাত্র এলিস্টার কুকেরই। যদিও গত বছরেই ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন এই কিংবদন্তী ইংলিশ ওপেনার। তবে যাওয়ার আগে ইংল্যান্ডের হয়ে গড়েছেন টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান করার কীর্তি।

২০০৬ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পর থেকে কুক ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন ১৬১টি ম্যাচ। তাতে সংগ্রহ করেছেন ১২,৪৭২ রান, যেটি কি না ইংল্যান্ডের হয়ে সাদা পোশাকে সর্বোচ্চ রানের পাশাপাশি একমাত্র দশ হাজার রানের রেকর্ড। ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছেন কয়েক বছর ধরেই। কুকের হাত ধরে কয়েকটি অ্যাশেজও জয় করেছে ইংলিশ বাহিনী।

বিশ্বকাপ না খেলা আরেক গ্রেট খেলোয়াড় কুক; Image Courtesy: Sportskeeda

তবে দুঃখের বিষয় হলো, এই কিংবদন্তী খেলোয়াড়ের বিশ্বকাপ খেলার সৌভাগ্য হয়নি। একদিনের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ৯২ ম্যাচ খেললেও ধারাবাহিকতার অভাবে কখনোই থিতু ছিলেন না মূল দলে। ২০০৬ সালে অভিষেক হওয়ার পর সর্বশেষ ওডিআই ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৪ সালে। তবে একেবারেই ফেলনা ছিল না কুকের পরিসংখ্যান। ৫টি শতকের সাথে ৩৬ এর উপর গড় নিয়ে করেছেন ৩,২০৪ রান। তারপরও ২০০৭ ও ২০১১ দুটি বিশ্বকাপেই উপেক্ষিত থেকে গেছেন সম্প্রতি নাইটহুড পাওয়া এই ক্রিকেটার।

ভিভিএস লক্ষ্মণ (ভারত)

টেন্ডুলকার, গাঙ্গুলি, দ্রাবিড়ের সাথে মিলে লক্ষ্মণ জন্ম দিয়েছিলেন ভারতের সাদা পোশাকের ‘ফ্যাবুলাস ফোর’ এর। এই স্টাইলিশ হায়দ্রাবাদী খেলোয়াড় ভারতের হয়ে খেলেছেন ১৩৪টি টেস্ট। সংগ্রহে রয়েছে ৮,৭৮১ রান। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেই মহাকাব্যিক ২৮১ রানের ইনিংস ছাড়াও মনে রাখার মতো অসংখ্য মূহুর্ত উপহার দিয়েছেন লক্ষ্মণ।

বিশ্বকাপ খেলার সৌভাগ্য হয়নি লক্ষ্মণের; Image Courtesy: India Times

টেস্ট ক্যারিয়ারের সাথে তুলনা করলে লক্ষ্মণের ওডিআই ক্যারিয়ার অতটা আহামরি না হলেও বেশ কিছু দারুন ইনিংস রঙিন পোশাকেও উপহার দিয়েছেন। ভারতের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন ৮৬টি। ৬টি শতক ও ৩০ গড়ে করেছেন ২,৩৩৮ রান, যেখানে ৬টি শতকের ৪টিই সেই সময়ের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কিন্তু শুরু থেকে টেস্ট খেলোয়াড় খেতাব পেয়ে যাওয়ায় বড় টুর্নামেন্টে উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন তিনি। ২০০৩ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত থাকার পরও শেষ মূহুর্তে নির্বাচকমণ্ডলীর চমকে বাদ পড়েন লক্ষ্মণ। তার জায়গায় সেবার দলে জায়গা পান দীনেশ মঙ্গিয়া। তাই বিশ্বকাপ মঞ্চে ভারতের হয়ে জার্সি গায়ে চাপানোই হয়ে ওঠেনি এই কিংবদন্তী ব্যাটসম্যানের।

Feature Image Courtesy: newsviews.media