হুমায়ূন আহমেদের একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারজয়ী সিনেমা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ –তে কমলা চরিত্রের জন্য একজন কিশোর নির্বাচন করতে হুমায়ূন আহমেদ ঢাকার একটি বয়েজ স্কুলে যান। একটি ক্লাসরুমে অডিশনের জন্য ইচ্ছুক ছাত্রদেরকে ডাকার পর সবার হাতে একটি সাদা কাগজ দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয় যে কাগজে খুব কষ্টের কোনো খবর লেখা আছে, এই ভেবে কান্না করো। তারপরে বলা হয় কাগজে অনেক হাসির কোনো কথা আছে, এই ভেবে হাসো। সবাই বিভিন্নভাবে কান্না-হাসির অভিনয় করার চেষ্টা করে, কিন্তু মাত্র একজনই অডিশনে পাশ করে, মামুন নামের একজন ছেলে। সে শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারও পায় কমলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য।
উপরের কথাগুলো অভিনয়ের একটি অংশ ‘মেথড অ্যাক্টিং’ এর উদাহরণ। অভিনয় সাধারণত দুই প্রকার। ক্লাসিক অ্যাক্টিং ও মেথড অ্যাক্টিং। ক্লাসিক অ্যাক্টিং হলো স্ক্রিপ্টনির্ভর অভিনয়। ক্লাসিক অ্যাক্টিং এ কান্নার দৃশ্যে অভিনেতা আবেগ দিয়ে কান্নার অভিনয় করেন এবং চোখে গ্লিসারিন দিয়ে চোখের পানি আনেন। চরিত্রের ভিতরে ঢুকার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না এক্ষেত্রে। কিন্তু মেথড অ্যাক্টিং ভিন্ন বিষয়। মেথড অভিনেতারা কান্নার দৃশ্যে চোখের পানি আনার জন্য অতীত জীবনের কোনো যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি মনে করার ব্যাপারে নিখুঁতভাবে মনঃসংযোগ করেন এবং আসল চোখের পানিই পড়ে চোখ থেকে। একে বলা হয় ‘সেন্স মেমোরি’। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের শারীরিক, মানসিক এবং আবেগের পরিবর্তন করাই মেথড অ্যাক্টিং এর উদ্দেশ্য। মেথড অ্যাক্টিং বা পদ্ধতিগত অভিনয়ের পুরোটাই নির্ভর করে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গিয়ে অভিনেতার বাস্তব জীবনকে ঐ চরিত্রের দৃষ্টি দিয়ে দেখার মাধ্যমে।
সিনেমায় এখন পর্যন্ত অনেক মেথড অভিনেতা/অভিনেত্রী এসেছে। মার্লন ব্র্যান্ডো, রবার্ট ডি নিরো, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, আল পাচিনো, শার্লিজ থেরন, ক্রিশ্চিয়ান বেল, হিথ লিজারসহ আরো অনেক দূর্দান্ত মেথড অভিনেতার দেখা পেয়েছে সিনেমা ভক্তরা। বলিউডের আমির খানও একজন চমৎকার মেথড অভিনেতা। কিন্তু একজন অভিনেতা মেথড অ্যাক্টিংকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। দূর্দান্ত বাস্তবধর্মী অভিনয়, প্রচন্ড পরিশ্রম করে মাসের পর মাস চরিত্রের ভিতর ঢুকে থাকা- এসবই করেছেন তিনি। বলছিলাম সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ড্যানিয়েল ডে লুইসের কথা। ব্রিটিশ এ অভিনেতাকে নিয়েই আজকের গল্প।
১৯৫৭ সালে সচ্ছল ব্রিটিশ পরিবারে জন্ম ড্যানিয়েল ডে লুইসের। বাবা ছিলেন কবি, মা অভিনেত্রী। ছোটবেলা থেকেই শিল্পীসত্ত্বা নিয়ে বেড়ে ওঠেন তিনি। কিশোর বয়সে ব্রিস্টল থিয়েটারে অভিনয় শেখা শুরু করেন। কয়েক বছর সেখানে অভিনয় শিখে ও অনেক মঞ্চনাটকে অভিনয় করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। প্রথম বড় পর্দায় অভিনয়ের সুযোগ পান ১৯৮২ সালের বিখ্যাত সিনেমা ‘Gandhi’’ তে ছোট একটি চরিত্রে। এই ছোট চরিত্রেই তিনি মেথড অভিনয় করে নিজের গুণের জানান দেন। এরপর বেশ কয়েকটি সিনেমায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় ও নিয়মিত মঞ্চনাটক করতেন। এই মঞ্চনাটকে অভিনয়ের সময়টিতেই মূলত তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকেন নিজেকে বহুমাত্রিক একজন অভিনেতা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। ১৯৮৮ সালে প্রথম ‘The Unbearable Lightness of Being’সিনেমায় প্রধান চরিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এই সিনেমায় ডাক্তার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আট মাস তিনি চরিত্রের মত জীবনযাপন করেন। সম্পূর্ণভাবে রপ্ত করেন চেক ভাষা। একটি চরিত্রের জন্য নতুন একটি ভাষা শেখা, ভাবা যায়? প্রথম সিনেমায়ই এমন দূর্দান্ত মেথড অ্যাক্টিং দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন হলিউডে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কী পরিমাণ আত্মোৎসর্গ করবেন তিনি। এরই ফলশ্রুতিতে ভবিষ্যতে খুব ভালোভাবেই নিজের পরিশ্রমের ফল পান তিনি।
ড্যানিয়েল নিজের জাত চেনান ১৯৮৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘My Left Foot’ সিনেমার মাধ্যমে। ক্রিস্টি ব্রাউন নামক একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী শিল্পীর বায়োপিক এটি। ক্রিস্টি ব্রাউন সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত ছিলেন। এটা এক ধরনের পক্ষাঘাত রোগ যার কারণে ক্রিস্টির শরীরের বাম পা বাদে বাকি সকল অঙ্গ অচল ছিল। শুধু মাত্র বাম পা দিয়েই তিনি ছবি আঁকতেন, লিখতেন। ক্রিস্টির চরিত্র মেথড অ্যাক্টিং এর মাধ্যমে অবিশ্বাস্যভাবে ফুটিয়ে তুলেন ড্যানিয়েল। বাম পা দিয়ে লেখা-আঁকা ও টাইপ করা শিখার চেষ্টাও করেন। সেরেব্রাল হাসপাতালে আক্রান্ত রোগীদের সাথে অনেক সময় কাটান তাদের মতো করে কথা বলা এবং চলাফেরা শেখার জন্য। বিশেষভাবে মুখ বাঁকিয়ে কথা বলা শিখেন। পর্দার চরিত্রে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতেন তিনি। কিন্তু শুটিং শেষ হলেও ড্যানিয়েল হুইলচেয়ার থেকে উঠতেন না। সেভাবেই থাকতেন চরিত্রের ভিতর থাকার জন্য। শুটিং এর ক্রু মেম্বারদের বলতেন তাকে খাইয়ে দেয়ার জন্য। কারণ বাস্তবের ক্রিস্টি ব্রাউন ও নিজ হাতে খেতে পারতেন না। এমনকি নিজের পাঁজরে নিজেই আঘাত করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত চরিত্রের কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলেন। এমন অসহনীয় পরিশ্রম বৃথা যায়নি। এই সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার এবং বাফটা অ্যাওয়ার্ড জেতেন তিনি।
হলিউডে ড্যানিয়েলের রাজত্ব শুরু হলো। ১৯৯২ সালে ‘The Last of Mohicans’’ সিনেমায় আবারো বাজিমাত করেন তিনি। চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য কাঠ ও বাঁশ দিয়ে নিজ হাতে ক্যানু (ছোট নৌকা) বানানো শেখেন। ব্যবসাসফল এই সিনেমা পায় দর্শকদের ও প্রশংসা। ড্যানিয়েল দ্বিতীয় অস্কার মনোনয়ন পান ১৯৯৪ সালে ‘In the Name of The Father’সিনেমার জন্য। এই সিনেমায় জেলে থাকা চরিত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে দুই রাত জেলখানায় আসামীদের সাথে কাটান তিনি। স্বেচ্ছায় পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চের দু’জন কর্মকতাকে অনুরোধ করে টানা নয় ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের মধ্য দিয়ে যান রিমান্ডে থাকা চরিত্রের মানসিক অবস্থা নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার জন্য। এরপর টানা ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিতে থাকেন দর্শকদেরকে।‘The Crucible’’ সিনেমায় নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য মাসের পর মাস গোসল না করে ছিলেন তিনি।
‘The Boxer’ সিনেমায় পেশাদার বক্সারের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য টানা দুই বছর, সপ্তাহে সাতদিন দুই বেলা করে সাবেক বক্সিং বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্যারি ম্যাকগাইগেনের কাছে বক্সিং শিখেন তিনি। ২০০২ সালে মার্টিন স্করসিজের সিনেমা ‘Gangs of New York’ এ আবারো দূর্দান্ত অভিনয় করেন। কসাই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কসাই এর কাজ শেখেন। সিনেমায় ১৮৬০ সালের চরিত্রে থাকার জন্য ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও গরম কোট পড়েননি তিনি। যার ফলে সিনেমার সেটেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যান। সে অবস্থাতেই কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। তৃতীয় অস্কারের মনোনয়ন পান এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য।
১৯৮৯ সালে প্রথম অস্কারের পর ২০০৭ সালে দ্বিতীয় অস্কার পান তিনি।‘There Will be Blood’ সিনেমায় চোখ ধাঁধানো অভিনয় করে হলিউডের মন জয় করে নেন ড্যানিয়েল। এই সিনেমার জন্য তেল খনন করা শিখেছিলেন তিনি। প্রায় দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নেন নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে। নিয়মিত সিনেমা কখনো করেননি তিনি। বিরতি নিয়ে, প্রস্তুতি নিয়ে ও বিচক্ষণতার সাথে সিনেমা সাইন করতেন ড্যানিয়েল।
ড্যানিয়েলের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সিনেমা ছিল ২০১৩ সালে করা ‘Lincoln’। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের বায়োপিকে অভিনয় করার জন্য স্টিভেন স্পিলবার্গ বেছে নেন ড্যানিয়েলকে। বলা বাহুল্য, ড্যানিয়েল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেন এই সিনেমাতেই। প্রস্তুতি হিসেবে আব্রাহাম লিংকনের উপর লেখা প্রায় ১০০টি বই পড়েন তিনি। সিনেমার সেটে শুটিং শেষ হওয়ার পরেও পরিচালকসহ সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন যেন তাকে ‘মিস্টারপ্রেসিডেন্ট’ বলে সম্বোধন করা হয়। এতে করে সবসময় চরিত্রের ভিতরে থাকার সুযোগ পেতেন তিনি। সিনেমা দেখে সমালোচকরাও বিস্মিত হয়েছেন, এ যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা বাস্তবিক লিংকনের অবয়ব! দাড়ি, চুল বা হাঁটা-চলা, সব ক্ষেত্রেই ড্যানিয়েল হয়ে ওঠেন প্রেসিডেন্ট লিংকনের আয়না প্রতিবিম্ব।
আকাঙ্খিতভাবেই, সে বছর তৃতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার ওঠে ড্যানিয়েলের হাতে। ড্যানিয়েল ডে লুইস ইতিহাসের একমাত্র অভিনেতা যিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করে তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পেয়েছেন।
মেথড অ্যাক্টিং এর জন্য ড্যানিয়েল ডে লুইস অনবদ্য, কারণ তার করা প্রতিটা ভিন্ন চরিত্রের জন্য তিনি ভিন্ন ভিন্ন গলার স্বরে কথা বলেছেন। তার মতে, ‘Voice is the fingerprint of Soul’ আর এ কারণেই তার করা চরিত্রগুলোর গলার স্বর একটার সাথে অন্যটা একবিন্দু ও মিলে না। সিনেমাগুলো যে এলাকার উপর ভিত্তি করে বানানো হতো, তিনি সে অঞ্চলের উচ্চারণভঙ্গী রপ্ত করে নিতেন। মেথড অভিনয়ের সর্বোচ্চ চূড়া বোধহয় এটাই, এবং এ চূড়া ড্যানিয়েল ছাড়া কেউ জয় করতে পারেনি। নিম্নে তার কিছু সিনেমায় তিনি যেসব অঞ্চলের উচ্চারণভঙ্গী বা একসেন্ট (Accent) রপ্ত করেছিলেন তার ক্ষুদ্র তালিকা দেয়া হলো-
• Gandhi (1982)- সাউথ আফ্রিকান একসেন্ট
• My Beautiful Laundrette (1985)- নিম্নবিত্ত ব্রিটিশ একসেন্ট
• A Room with a View (1985)- বিশ শতকের উচ্চবিত্ত ব্রিটিশ একসেন্ট
• The Age of Innocence (1993)- উনিশ শতকের উচ্চবিত্ত আমেরিকান একসেন্ট
• In the Name of the Father (1993)- আইরিশ একসেন্ট
• The Crucible (1996)- সতেরো শতকের ব্রিটিশ একসেন্ট
• The Boxer (1997)- দক্ষিণ আইরিশ একসেন্ট
• Gangs of New York (2002)- উনিশ শতকের নিউইয়র্ক একসেন্ট
• The Ballad of Jack and Rose (2004)- স্কটিশ একসেন্ট
• There Will be Blood (2007)- বিশ শতকের ক্যালিফোর্নিয়ান একসেন্ট
• Nine (2009)- ইতালিয়ান একসেন্ট
• Lincoln (2012)- উনিশ শতকের কেন্টাকি/ইন্ডিয়ানা একসেন্ট
ড্যানিয়েল ডে লুইস একজন জীবন্ত অভিনয় প্রতিষ্ঠান। তাকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বলা হলেও কোনো বাড়াবাড়ি হবে না। কারণ এই সম্মান তার প্রাপ্য। ‘পরিশ্রম করলে একদিন সফল হবেই’– এই নীতিবাক্যের জলজ্যান্ত উদাহরণ ড্যানিয়েল ডে লুইস। তিনটি অস্কার ছাড়াও চারটি বাফটা ও দুইটি গোল্ডেন গ্লোব পান তিনি। ২০১৪ সালে পান সর্বোচ্চ ব্রিটিশ সম্মাননা, নাইটহুড। নামের আগে যুক্ত হয় স্যার। ৪৭ বছরের ক্যারিয়ারে স্যার ড্যানিয়েল ডে লুইস প্রায় ১৪০টি অ্যাওয়ার্ড পান। ২০১৭ সালে ‘Phantom Thread’ সিনেমার পরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে অভিনয় থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। এই সিনেমার জন্যও অস্কারের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার মনোনয়ন পেয়েছিলেন ড্যানিয়েল। অবসর জীবন পরিবারের সাথে কাটাচ্ছেন ড্যানিয়েল ডে লুইস। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভক্তদেরকে উপহার দিয়েছেন একের পর এক অসাধারণ পারফর্ম্যান্সের সিনেমা। মেথড অ্যাক্টিংকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়।
জীবনে মাত্র ২০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ড্যানিয়েল ডে লুইস। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, “মেথড অ্যাক্টিং এর সংজ্ঞা কি?”
নির্দ্বিধায় উত্তর দেয়া যায়, “ড্যানিয়েল ডে লুইস!”
Feature Image Courtesy: Pinterest.com
References:
- Imdb.com
- Britannica.com
- Theguardian.com