১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর। বেশ শীতজড়ানো এক রাত। এ রাতেই দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর- জন লেনন আর নেই। রাত এগারোটা সাত মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন।
হত্যাকারী মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেননি। সেখানেই দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্তমনে বই পড়ছিলেন! তিনি সুপরিকল্পিতভাবেই ঘটান হত্যাকাণ্ডটি। কিন্তু কেন? কেন চ্যাপম্যান করলেন এমন হীন, গর্হিত কাজ?
পাঠক, আমরা সেসব জানব। তবে চলুন, তার আগে জেনে নিই কেমন ছিলো লেননের শেষ দিনটি৷
লেনন ও তাঁর স্ত্রী ইয়োকো ওনো তাঁদের সদ্যপ্রকাশিত এলবাম ‘ডবল ফ্যান্টাসি’ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা করছিলেন। লেননের সকালটা শুরু হয়েছিল ব্যস্ততায়। তাঁর ম্যানহাটনের বাড়ি- ‘ডাকোটা’-য় এসেছিলেন সাংবাদিক এনি ল্যুভোডিস। উদ্দেশ্য একটা ইন্টারভিউ নেয়া। সাথে একটা ফটোশুট। এই ফটোশুটটা ছিলো খুব কৌতুহলোদ্দীপক। লেনন ঠিক করলেন তিনি থাকবেন নগ্ন আর ওনো থাকবেন পোশাক পরিবৃত। উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে, ভালোবাসাটা ভেতরের ব্যাপার। বাহ্যিকতা সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও দুজন মানুষ ভালোবাসতে পারে একে অপরকে, হতে পারে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। ফটোশুট হলো। লেনন আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এক রেডিয়োর সাক্ষাৎকার দিতে।

জন লেনন, Image Courtesy: Allthatsinteresting.net
এটাই ছিলো তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার। তিনি বলেছিলেন, শৈশবে মনে হতো ত্রিশটা বছর বাঁচলেই তা অনেক। কিন্ত এখন আমার মনে হয় জীবনটা আসলে ছোটো। আমার চল্লিশে এসে মনে হয় আমার আরো অনেকদিন বাঁচা দরকার। যতদিন গান সৃষ্টির সামর্থ্য থাকবে, আমি বেঁচে থাকতে চাই।’ কিন্তু কে জানত সেদিনের রাতটাই হবে তাঁর জীবনের শেষরাত?
সাক্ষাৎকার দিয়ে বিকেলে লেনন আর ওনো বেরিয়ে পড়েন বাইরে। লেননের লিমুসিন যখন অপেক্ষা করছে, তখন লেনন দেখলেন ডাবল ফ্যান্টাসি এলবাম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। খুব বিনীতভাবে লেননের অটোগ্রাফ চাইলো সে। লেননও তাড়া না দেখিয়ে আন্তরিকতার সাথে দিলেন অটোগ্রাফ। সাথে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটাই কি তোমার সবটুকু চাওয়া?’ ছেলেটি নিরুত্তর। শুধু মুখে একটু লাজুক হাসি।

লেনন আর ওনো লিমুসিনে চেপে চলে গেলেন। প্রেস কনফারেন্সে অংশ নিলেন, প্রচার-প্রচারণাতেও ব্যস্ত সময় কাটালেন। রাতে বাড়িতে ফিরে তাঁরা দেখলেন সেই ছেলেটি তখনো দাঁড়িয়ে সেখানে। তখন রাত ১০টা বেজে ৫০ মিনিট। লেনন এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ শোনা গেলো গুলির শব্দ। চারটি বুলেট ঝাঁঝরা করে দিলো তাঁর পিঠ। একটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। লেনন চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি গুলিবিদ্ধ!’
ওনো দৌড়ে এসে তাকে ধরেন। যুবকটি অর্থাৎ মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান তখনও নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সেখানে। বাড়ির গেটম্যান এসে তার হাত মুচড়ে পিস্তলটা ফেলে দেন। পুলিশ গ্রেফতার করে তাকে। পুলিশের গাড়িতেই লেননকে নিয়ে যাওয়া হয় রেইনসফোল্ড হাসপাতালে। সেখানে নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত ১১টা ০৭ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসক জানিয়েছিলেন যে, গুলিবিদ্ধ হবার পরপরই লেননের মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ডাকোটা-র সামনে ভিড় জমান লাখের বেশি মানুষ। বিটলসের সাবেক সদস্যরাসহ বহুজনই শোক জানান। ইয়োকো ওনোর ইচ্ছানুযায়ী তাঁদের পুত্র শেন লেননকে দত্তক নেন লেননের সাবেক সতীর্থ রিঙ্গো স্টার।

এই বাড়িতেই থাকতেন লেনন; Image Courtesy: Allthatsinteresting.net
কিন্তু এই খুনের মোটিফ কী ছিলো? কেন এই যুবক খুন করলো লেননকে?
তার ভাষায়, “আমি একসময় লেননকে আইডল মানতাম। কিন্তু তার ও বিটলসের ওপর থেকে মন উঠে গেলো, যখন শুনলাম লেনন বলেছেন যে তারা যীশুর চেয়েও বেশি জনপ্রিয়! লেনন স্পষ্টভাবেই যীশুর প্রতি অবমাননা করেছেন!”
লেনন যখন চ্যাপম্যানকে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন, তখন লিমুসিনে অপেক্ষা করছিলেন একজন প্রযোজক। তাঁর কথা থেকে জানা যায়, তাদের প্রেস মিটিংয়ের জন্য তাড়া ছিলো। লেনন যখন এগিয়ে আসছেন তখন হঠাৎই একজন যুবক তাঁর অটোগ্রাফ চেয়ে বসেন। যুবকের হাতে ধরা ছিলো ডবল ফ্যান্টাসি-র একটা কপি। কাজের তাড়া থাকা সত্ত্বেও লেনন খুব আন্তরিকভাবে সেই যুবকের সাথে কুশল বিনিময় করেন। অটোগ্রাফ দিয়ে জানতে চান যে, তার আরো কিছু চাই কি না।

২০১০ সালে খুনী মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান; Image Courtesy: Allthatsinteresting.net
চ্যাপম্যান নিজেও ধরা পড়ার পর এ সবকিছুই স্বীকার করে। সে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত ছিলো। সে জানায় যে লেনন এত ব্যস্ততার মাঝেও সময় নিয়ে আন্তরিকতার সাথে তাকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। কিন্তু লেননের অবমাননাকর (!) আচরণ সে মেনে নিতে পারেনি। সে তাকে হত্যার সংকল্প করে এবং নিজ উদ্দেশ্য হাসিলে সে ছিলো বদ্ধপরিকর। তাই হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিউ ইয়র্ক আসে সে! তার চাকরির শেষদিনে সে খাতায় নিজের নাম লিখেছিল জন লেনন!

বিচারে প্রথমে বিশ বছরের সাজা হয় চ্যাপম্যানের। এরপর ১১ বার তার জামিনের আবেদন করা হলেও প্রতিবারই ইয়োকোর আবেদনের প্রেক্ষিতে তা স্থগিত হয়েছে। এখনও জেল খাটছে মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নামের এই কুখ্যাত খুনী। তবে এখন নিজেকে একজন নির্বোধ, পশু বলে স্বীকার করে সে। তার মতে, সে চেয়েছিল লেননকে হত্যা করে একজন নায়ক বা আইকন হয়ে উঠতে! সে ভেবেছিল যীশুর সম্মানরক্ষা প্রচেষ্টার জন্য মানুষের সমর্থন পাবে সে। কিন্তু খুনীরা আইকন নয়, মানুষ সম্মান করেনা, ভালোবাসেনা তাদের- এ কথা তখন তার মাথায় আসেনি। তাই ৪০ বছর ধরে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে তাকে। হয়তো এর শাস্তি তাকে ভোগ করতে হবে আমৃত্যু।
Feature Image Courtesy: jayasherlevine.com