ইকো-ফ্যাসিজম

“বন্যপ্রাণীদের নির্যাতন করা যাবে না

অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়া প্রাণীদের জবাই করা যাবে না

পোষা প্রাণীদের যত্ন নেয়া বাধ্যতামূলক

প্রাণীদের দিয়ে সাধ্যে অতিরিক্ত কাজ করানো যাবে না

চলচ্চিত্র বা মিডিয়ায় প্রাণীদের ব্যবহার করা যাবে না

কুকুর দিয়ে শিকার করা যাবে না

আড়াই পোচে জবাই করা নিষিদ্ধ

ভিভিসেকশন নিষিদ্ধ

এসব আইন ভঙ্গ করলে দু’বছরের জেল আর ৫ লাখ টাকা জরিমানা।”

এ আইনগুলো যেকোনো সভ্যদেশের আইন বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। এমনকি, আজকের দিনে বন্যপ্রাণী ও গৃহপালিত প্রাণী রক্ষায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এর কিয়দংশও করে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এত অসাধারণ আইন কবে কে তৈরি করেছিল?

উত্তরটা অনেককেই চমকে দেবে। দেশটা থার্ড রাইখ- নাৎসি জার্মানি

১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর পাস হওয়া Reichstierschutzgesetz তথা রাইখের প্রাণী রক্ষা আইনের কিছু অংশ, যা উপরে কোট করা হয়েছে। আইনটা এত চমৎকার যে আজ পর্যন্ত জার্মানিতে যে প্রাণী রক্ষা আইন আছে, সেটাও এই আইনের পরিমার্জিত রূপ। এই আইনের একদম প্রথম ধারাতেই আছে- প্রাণীদের ‘অস্বস্তি’ পর্যন্ত হতে পারে এমন কোনোভাবে এদের বহন করা আইনত দণ্ডণীয়।

এক ফ্রেমে বন্দী নাৎসী প্রকৃতিপ্রেমী নেতারা (বাম থেকে গোয়েবলস, হিটলার, আর্নস্ট রোম, হারম্যান গোরিং, রিচার্ড ওয়ালথার দারে’ আর হাইনরিখ হিমলার); Image Courtesy: spartacus-educational.com

নাৎসি জার্মানির অনেক হোমড়া-চোমড়া ছিল প্রাণীদের অধিকার রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ। হিটলার ছিলেন একজন পরিবেশবাদী (হিটলার ভিগান ছিল কি না তা নিয়ে দ্বিমত আছে, যদিও এর পক্ষে বহু আলাপ আছে)। হারম্যান গোরিং এমন একটা আইন প্রুশিয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়েই পাশ করেছিলেন ১৯৩৩ সালে। গোরিং তো লবস্টার সিদ্ধ করা, কাঁকড়া সিদ্ধ করা এমনকি টোপ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ব্যাঙ ধরার কারণেও মানুষকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়েছেন। গোয়েবলস ছিল প্রাণী অধিকার রক্ষায় সেকালের অন্যতম সারথি। এসএস- এর কুখ্যাত প্রধান হিমলারও ছিল প্রকৃতিপ্রেমী সংরক্ষণবাদী। এমনকি ‘ইকোলজি’ শব্দটার প্রবর্তকও একজন নাৎসি জুওলজিস্ট আর্নস্ট হেইকেল।

‘ইকোলজি’ শব্দের প্রবর্তক আর্নস্ট হেইকেল; Image Courtesy: Wikimedia Commons

এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে- কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করে, একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে আট কোটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হওয়া নাৎসি জার্মানির এহেন প্রকৃতিপ্রেম বা পশুপ্রেম এলো কোত্থেকে? এমন চরম মানব-বিদ্বেষী একটা গোষ্ঠী বন্যপ্রাণীদের জন্য জান কোরবান করে দেবে কেন? প্রশ্নটার উত্তর পেতে হলে আমাদের আরেকটু গভীরে যেতে হবে। আমাদের যেতে হবে সেই সময়ে, যখন নাৎসি আদর্শের বীজ বোনা হচ্ছিল ইউরোপের মাটিতে।

ভিভিসেকশন নিষিদ্ধ করার পর গোরিংকে নাৎসি স্যালুট দিচ্ছে প্রাণীরা, জার্মান ক্যারিকেচার; Image Courtesy: Wikipedia

উনিশ শতকের শেষের দিকে জার্মানিতে উত্থান ঘটে জার্মান রোমান্টিসিজমের- যেখানে ডারউইনের থিওরি অব ন্যাচারাল সিলেকশনের একটা করাপ্ট ভার্শন- রেসিয়াল সুপৃমেসি বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বকে পুঁজি করে আর্যজাতির শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা নিয়ে কাজ শুরু হয়। এই আদর্শবাদের নাম ছিল ভকিশমুভমেন্ট (Volkisch Movement). এই ভকিশ মুভমেন্টের ধারণা ছিল- আর্যজাত মূলত প্রকৃতির সাথে একাত্মতা, এই একত্মতাই তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। এই ভকিশ মুভমেন্ট নাৎসিবাদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্থির ভাইমার রিপাবলিক ছিল এর উর্বরভূমি। আর এই ধারণার এক কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য ছিল Blut and Boden (রক্ত আর ভূমি)। যে ধারণাবলে নাৎসিরা বিশ্বাস করত, আর্যজাতের নিয়তিই হলো পূর্ব ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া। ফ্রান্সের মাইন নদী থেকে পোল্যান্ডের মেমেল নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূমি আর্যদের Lebensraum বা বাসভূমি- যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা বড় সময় কেটেছে পুবে যুদ্ধ করে স্লাভদের কাছ থেকে উদ্ধার করা সেসব অঞ্চলে।

রক্ত আর ভূমি প্রতীক; Image Courtesy: dagobertobellucci.wordpress.com

১৯০৬ সালে একজন জার্মান গবেষক ডক্টর উইলিবল্ড হেনৎশেল এক আইডিয়ার প্রবর্তন ঘটান। সেই আইডিয়ার মূল ভিত্তি ছিল আর্যজাতির শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা। এজন্য তিনি জাতিগত বিশুদ্ধতা আর সিলেক্টিভ প্রজননের কথা ছড়িয়ে দিতে থাকেন। তার সাথে পরিচিত হন একজন তরুণ গবেষক- রিচার্ড ওয়ালথার দারে’। ১৯২৩ সালে সমমনা নাৎসীরা মিলে গঠন করেন আর্তামান লীগ- যার লক্ষ্য ছিল নাৎসিবাদ ছড়ানো। দারে’ শুরু করে এক ‘মাটির কাছে ফিরে চলো’ আন্দোলন।

আর্তামান লীগের চিহ্ন; Image Courtesy: glfint.wordpress.com

তিনি ও তার সমমনা নাৎসিরা বলতে থাকেন, বিশুদ্ধ জার্মানদের হতে হবে কৃষিজীবী, তাদের হতে হবে প্রকৃতির সাথে একাত্ম। তাদের আদর্শের আরেকটি বড় অংশ ছিল সকল প্রাণীই গুরুত্বপূর্ণ- সব প্রাণীই পবিত্র রাইখের অংশ। তাই তাদের রক্ষা করা আর্যজাতের কর্তব্য। ১৯২৭ সাল থেকে নাৎসিরা ইহুদিদের ‘কোশের জবাই’ (আড়াই পোচে জবাই, যা ইসলামে জবাইয়ের হালাল তরীকা) নিষিদ্ধের জন্য কাজ শুরু করে। প্রথমে যা শুরু হয়েছিল এন্টাই-সেমিটিক আন্দোলন, ইহুদিরা যে কায়দায় জবাই করে তা নিষিদ্ধ করতে হবে, তা পরিণত হয় পুরোদস্তুর প্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলেন। আর ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসে নাৎসি পার্টি শুরু করে তাদের রক্ত আর ভূমি আদর্শের প্রচারণা। এই ‘রক্ত আর ভূমি’ আদর্শের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল নাৎসি জার্মানির প্রাণী রক্ষা কার্যক্রম। জলের কাঁকড়া থেকে ডোবার ব্যাঙ, বনের নেকড়ে থেকে ঘরের ইঁদুর পর্যন্ত নিরাপদ ছিল নাৎসিদের কাছে- ছিল না মানুষের জীবন।

রিচার্ড ওয়ালথার দারে’; Image Courtesy: ww2gravestone.com

বলে রাখা ভালো- হেনৎশেল নিজেও বিশ্বাস করতেন জাতপাতে। তিনি বিশ্বাস করতেন- প্রাণিজগতের মধ্যেও আছে ‘সুপিরিয়র’ আর ‘ইনফিরিয়র’ প্রজাতি। ন্যাচারাল সিলেকশনের মাধ্যমে প্রকৃতি এই বিভাজন বজায় রাখে। ঠিক একই থিওরি তিনি প্রয়োগ করেছিলেন নাৎসি ইউজেনিক্স বা ‘উন্নত জিন’ থিওরিতে, যেখানে বলা হত আর্যজাতের জিন অনার্য অপেক্ষা উন্নত। উনার পরে এ কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন নাৎসি গবেষক ইউজিন ফিশার। এই ভদ্রলোকের কাজ নাৎসি রেসিজমকে দিয়েছে ‘বৈজ্ঞানিক’ ভিত্তি। হিটলারের মাইন ক্যাম্ফ বইয়ে রেসিস্ট ম্যানিফেস্টো লেখা হয়েছে উনার কাজের উপর ভিত্তি করে (ফান ফ্যাক্ট- এখনো মানুষের চুলের রঙ বিচার করার বৈজ্ঞানিক স্কেলের নাম ফিশার স্কেল)।

ইউজিন ফিশার; Image Courtesy: une-autre-histoire.org

দারে’ প্রভাবিত করেছিলেন হাইনরিখ হিমলারকে। হিমলার নিজেও খুবই অনুপ্রাণিত হয়ে এই ভকিশ মুভমেন্ট নিয়ে কাজ করেছেন। এসএসকে ব্যবহার করে তিনি পরিষ্কার করেছেন বনভূমি, যেখানে চাষবাস করে খেতে পারবে উন্নত জিনধারী আর্য নরনারী। দারে’ পরিবেশ সংরক্ষণবাদের একজন আদি প্রবক্তা ছিলেন। তিনি জোর দিতেন বনভূমি রক্ষা আর চাষাবাদের ওপর; অপছন্দ করতেন নগর সভ্যতা। এর প্রভাবে ১৯৩৫ সালের পয়লা জুলাই রাইখে পাস হয়েছিল পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- যা সে আমলের তুলনায় ছিল অনেক বেশি কার্যকর। ১৯৩৬ সালের ২৭ মার্চ জীবন্ত মাছ হত্যা আর সরীসৃপ হত্যার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। একই বছর শুরু হয় বনায়ন কার্যক্রম।

ভকিশ মুভমেন্টের প্রতীক; Image Courtesy: WordPress

বাকি ইতিহাস সবারই জানা। যে নাৎসিরা তাদের পাতের মাছের কষ্ট লাঘবে উদগ্রীব ছিল; তারাই হলোকাস্টে মেরেছে ৬ কোটি ইহুদি, তারাই ক্ষমতায় আরোহণের আগে-পরে হত্যা করেছে দুই লাখ আটাশি হাজার বিরোধীমতে বিশ্বাসী জার্মান, যুদ্ধে মৃত্যুর কারণ হয়েছে পাঁচ কোটি তিরিশ লাখ জার্মান ও অক্ষশক্তির সৈন্যের আর দুই কোটি ছেষট্টি লাখ সোভিয়েতসহ অসংখ্য মানুষের। একটা আদর্শ কতটা টুইস্টেড হলে এমন আয়রনি ঘটাতে পারে মানুষ!

এখনো নাৎসি জার্মানির প্রাণী রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে ধরা হয় ‘অশুভ উদ্দেশ্যে করা শুভ কাজের’ এক ক্ল্যাসিক উদাহরণ হিসেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বছরের পর বছর ধরে নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছে মানুষ। নব্য নাৎসিদের প্রতিহত করার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু এর উত্থান ঘটছে আবার। সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়- এই উত্থানের একটা কভার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পরিবেশ সংরক্ষণ আর প্রাণী রক্ষা আন্দোলন। পরিবেশ ও প্রাণী রক্ষার নামে এই নব্য ফ্যাসিবাদের নাম ইকোফ্যাসিজম

ভকিশ মুভমেন্টের লক্ষ্য ছিল মাটির কাছে ফিরে যাওয়া; Image Courtesy: glfint.wordpress.com

ইকোফ্যাসিজম হলো এক পলিটিক্যাল মডেল, যেখানে এক কর্তৃত্ববাদী সরকার পরিবেশ রক্ষায় ব্যক্তির আধিকার খর্ব করে পরিবেশের জন্য তাকে উৎসর্গ করবে। এর একমাত্র উদাহরণ নাৎসি জার্মানি। এই আদর্শে বিশ্বাসীরা সশস্ত্র কায়দায় ইকোফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠায় পিছপা হয় না।

অনেকেই হয়তো ভাববেন, এ আর এমন কী! সাদাদের দেশে তো কত পাগলই আছে! তাদের জ্ঞাতার্থে ছোট্ট করে জানিয়ে রাখি- ক্রাইস্টচার্চের মসজিদের হামলা চালানো ব্রেন্টন টারান্ট বা টেক্সাসের এল-পাসোতে গুলি চালিয়ে ২৩ জনকে হত্যা করা গানম্যান প্যাট্রিক ক্রুসিয়াসও ছিল ইকোফ্যাসিস্ট। আজ এই ইকোফ্যাসিজম নব্য নাৎসিবাদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও বহু জায়গায় সশস্ত্র হামলা করেছে ইকোফ্যাসিস্টরা। এমনকি ট্রাম্পের সাবেক চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট স্টিভ ব্যানন নিজেও এই আদর্শের সমর্থক।

ব্রেন্টন টারান্ট; Image Courtesy: ndtv.com

নব্য নাৎসিদের আড্ডায় বসলে আপনি দুটো বইয়ের নাম পাবেন– ‘The Lightning and Sun’ আর ‘Gold in the Furnace’। প্রথমটায় বলা হয়েছে- হিটলার ছিল হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার! আর দ্বিতীয়টায় রয়েছে নাৎসিবাদের পুর্নজন্মের আশাবাদ। বই দুটির লেখিকা সাবিত্রী দেবী মুখার্জী।

‘The Lightning and Sun’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Courtesy: Wikipedia

এখন একটু অবাক হতেই পারেন আপনি, এক বাঙালি নারী নব্য নাৎসিবাদের আদর্শিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছেন? ভ্রু কুঁচকে গাল দেবার আগে রহস্যভেদ করা যাক- সাবিত্রী দেবী একজন ফরাসি নারী। তার বাবা ছিলেন গ্রিক, মাতা ইংরেজ। ১৯০৫ সালে ফ্রান্সের লিওঁ শহরে জন্ম নেন তিনি, জন্মের সময় নাম ছিল তার ম্যাক্সিমিলি ইউলিয়া পন্টাস। তিনি নাৎসিবাদের দীক্ষা নেন ১৯২৮ সালে। দীক্ষা নেবার পর তিনি আর্য প্যাগানিজমে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আর্যদের খুঁজতে আসেন ভারতে। এখানে এসে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হন। শুরু করেন মুসলমান ও খ্রিস্টানবিরোধী প্রচারণা। ১৯৩০ সালে তিনি গড়ে তোলেন এক নাৎসি স্পাই রিং, যার কাজ ছিল ব্রিটিশ ভারত থেকে গোপন তথ্য জার্মানিতে পাচার করা। সুভাষ চন্দ্র বোসের সাথে জাপানিদের যোগাযোগও নাকি তিনি করিয়ে দিয়েছিলেন।

‘Gold in the Furnace’ বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Courtesy: Wikipedia

১৯৩৬ সালে তিনি এক বই লিখেন– ‘A Warning to the Hindu’s, যাতে হিন্দুদের উদ্দেশ্য আহবান জানানো হয় মুসলমান ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ভারত পুনরুদ্ধারের জন্য। তিনি লেখেন, যেহেতু মুসলমানদের জন্মহার অনেক বেশি, তাই শীঘ্রই তারা ভারতে হিন্দুদের সংখ্যালঘু বানিয়ে ফেলবে। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি কলুষিত করে ফেলছে মুসলমান আর খ্রিস্টানরা। এখন বিজেপি যেসব এন্টি-ইসলামিক বা এন্টি-ক্রিশ্চিয়ান প্রচারণা চালায়- সবই মোটামুটি এই বইয়ের কথাতেই চালায় (বিজেপি তাদের প্রোপাগান্ডার কথাবার্তাও ধার করে এক ফরাসি-গ্রিক-ইংরেজ নারীর লেখা থেকে, কি আশ্চর্য!

সাবিত্রী দেবী; Image Courtesy; Wikipedia

১৯৪৯ সালে তিনি জার্মানিতে ফিরে পুনরায় শুরু করে নাৎসিবাদ ছড়ানোর কাজ। তাকে আট মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যেখানে তিনি মিলিত হন কারাবন্দী নাৎসিদের সাথে। তাদের সাথে কথা বলে ঋদ্ধ হয়ে আট মাস পর ছাড়া পেয়ে পুর্ণ উদ্যমে শুরু করেন নাৎসিবাদ ছড়ানোর কাজ। তিনি কলকাতায় আশ্রয় নেন এবং ইংল্যান্ডের এক ছোট্ট শহরে তার এক বান্ধবীর বাসায় মৃত্যুবরণ করেন।

একটা অবাক করার মত তথ্য হলো- প্রাণী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের একজন পাইওনিয়ার ছিলেন সাবিত্রী দেবী। তিনি একজন ভিগান ছিলেন এবং নন-ভিগানদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য প্রচারণা চালাতেন। অ্যানিমেল ফার্ম ও ল্যাবরেটরিতে হামলা করতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসী অধিক্রৃত ইউরোপ; Image Courtesy: Wikipedia

আরেকজন ইকোফ্যাসিস্ট ছিলেন টেড ক্যাকজিনস্কি। আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল ও কমপ্লেক্স ম্যানহান্ট চালানো হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। টেড ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ম্যাথ জিনিয়াস। তিনি পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হন। ১৯৭১ তিনি জঙ্গলে চলে যান এবং সেখানেই প্রকৃতির সাথে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭৮ সাল থেকে তিনি শুরু করেন বোমা হামলা। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, এয়ারলাইন্সে তিনি মেইল বোমা পাঠানো শুরু করেন। হাতে বানানো এসকল বোমা ছিল অত্যন্ত সফিস্টিকেটেড; এসব সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে বানানো হয়েছিল। এফবিআই তাকে ‘ইউনিভার্সিটি অ্যাণ্ড এয়ারলাইন্স বোম্বার’ বা উনাবোম্বার বলে আখ্যায়িত করত। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি বোমা হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যা আর তেইশজনকে আহত করেন- যাদের বেশিরভাগই ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর শিক্ষার্থী। তার লক্ষ্য ছিল, বোমা হামলা করে মানবজাতিকে তিনি আদিমযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। বর্তমানে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।

টেড ক্যাকজিনস্কি; Image Courtesy: bostonglobe.com

২০১৭ সালে নেটফ্লিক্সে ‘ম্যানহান্ট: উনাবোম্বার’ নামের এক সিরিজ প্রচার করে, যাতে নতুনভাবে ইকোফ্যাসিজমের ওপর আলো পড়ে। অনেকেই বলেছেন- এতে ইকোফ্যাসিস্টদের ইতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে।

ইকোফ্যাসিস্টদের সন্ত্রাসবাদ ততটা মারাত্মক হয়নি এ কয়টা ঘটনা ছাড়া। কেবল ১৯৮২ সালে এক সুইস ইকোফ্যাসিস্ট ফ্রান্সের সুপারফেনিক্স নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে পাঁচটা আরপিজি সেভেন রকেট লঞ্চার নিয়ে হামলা করেছিল- যাতে অল্পের জন্য নিউক্লিয়ার কোর রক্ষা পায়। আর্থ লিবারেশন ফ্রন্ট আর অ্যানিমেল লিবারেশন ফ্রন্ট এমন ইকোফ্যাসিস্ট সংগঠন। তারা সশস্ত্র পন্থায় প্রাণীদের রক্ষায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

‘ম্যানহান্ট: উনাবোম্বার’ সিরিজের পোস্টার; Image Courtesy: idmb

ইকোফ্যাসিস্টরা কী চায়?

ইকোফ্যাসিজমটা আসলে ভিগানিজম, এন্টিই-মাল্টিকালচারালিজম, হোয়াইট সুপ্রিমেসি, এন্টি-সেমিটিজম নব্য নাৎসিবাদের আর একটা ককটেল। এদের সবার কমন আদর্শিক গুরু দারে’ আর তার লেবেনস্রম আইডিয়া। মাল্টিকালচারালিজম বা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যেকোনো হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টেরই মাথাব্যথা। ইকোফ্যাসিস্টরা এখানে এক কাঠি সরেস- তারা বলে, সাংস্ক্রৃতিক বৈচিত্র্য নষ্ট করছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য! ইকোফ্যাসিস্টদের একটা বড় চিন্তার বিষয় এশিয়ান ও আরব অধিবাসীদের কারণে নষ্ট হচ্ছে ইউরোপ আর আমেরিকার পরিবেশ। তাদের বক্তব্য- পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলছে মানুষ; কাজেই ‘প্রাণীদের প্রতি সচেতন নয়’ এমন ‘ইনফিরিয়র’ জাতের মানুষের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর জন্য পাইকারি হত্যাযজ্ঞ চালানো আবশ্যক- যেমনটা করেছে ব্রেন্টন টারান্ট। এদের সবার রোল মডেল হিটলার আর নাৎসির দল। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক- এরা র‍্যাডিকাল ভিগান।

ইকোফ্যাসিস্টদের কাছে পরিবেশ দূষণ আর জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যার সমাধানও আছে, আর সেগুলো হাত-পা ঠান্ডা করে দেবে যেকোনো সভ্য মানুষের। তাদের বক্তব্য- সমস্ত অভিবাসীদের মেরে ফেল, নন-হোয়াইটদের সন্তান উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বসাও, মেরে-কেটে আদিযুগে ফেরাও পৃথিবীকে। ২০১১ সালের নরওয়ের অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক যখন ৭৭ জন তরুণকে হত্যা করেছিল এক ইয়ুথ ক্যাম্পে- তখন তার মাথাতেও ঘুরছিল সেই চিন্তা। আমেরিকার নব্য নাৎসি ওয়েবসাইট ’দ্য ডেইলি স্টর্মার’ এর শ্লোগান- Save Trees, not Refugees. জার্মানির উগ্র ডানপন্থীদের শ্লোগানDon’t vivisect animals, use Turks instead.

অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক, Image Courtesy: Reuters

ইউরোপের দেশগুলোতে অভিবাসীবিরোধী প্রচারণার এক বড় অংশ জুড়ে আছে পরিবেশ। হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট থেকে ফ্রান্সের ডানপন্থী ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি পার্টি- সবাই বলছে অভিবাসীরা পরিবেশ ধ্বংস করছে। তবে যুদ্ধটা থামানোর চেষ্টা করা উচিত তাদের। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ হলেই তো আর অভিবাসীদের নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। উহু, সেটা না- কেননা সেখানে রয়েছে তেলের রাজনীতি।

একটি ইকোফ্যাসিস্ট মিম; Image Courtesy: hominibus.asia

সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের পর ইকোফ্যাসিস্টদের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর ভোগবাদী জীবনযাত্রার মত যৌক্তিক চিন্তাগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে গণহত্যা আর ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে। এখন ইন্টারনেট মিমের মাধ্যমে এসব প্রচারণা চলছে- আর এসব থামানোর রাস্তা খুবই সংকীর্ণ।

আমেরিকান রিপাবলিকান পার্টির আছে পরিবেশ দূষণ অস্বীকার করার এক লম্বা ইতিহাস, কিন্তু এখন তাদের একাংশ এর মধ্যে থেকে বের করে আনছে সিস্টেমেটিক জেনোফোবিয়া। কোভিড-১৯ কে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলে আখ্যা দিয়ে এশিয়ান আমেরিকানদের ওপর দৈনিক গড়ে ১০০ হেইট ক্রাইম হচ্ছে আমেরিকায়। ইকোফ্যাসিস্টদের ভাষ্য- গরিব নন-হোয়াইট মানুষেরা পরিবেশ দূষণ করছে; কিন্তু তাদের চাইতেও হাজারো গুণ বেশি পরিবেশ দূষণ করা বড় বড় কর্পোরেশনের ব্যাপারে তারা চুপ। এখানেই এই ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষ্য পরিষ্কার হয়ে যায়- এরা যতটা না পরিবেশ চায়, তার চেয়ে বেশি চায় সকল নন হোয়াইট জাতির মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে। ‘মানুষই আসল ভাইরাস’ বলে যারা গণহত্যাকে জায়েজ করতে চায়, তারা পরিবেশকে কেবল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য। বুড়িগঙ্গায় ডলফিন ফিরে এসেছে, ভেনিসের খালের পানি এখন স্বচ্ছ টলটলে, আমেরিকার সমুদ্র সৈকতে নেই আবর্জনা- আমরা এমন বিশ্ব চাই। কিন্তু এসব ছবি দেখিয়ে কেউ যদি এমন প্রচারণা চালায়- মানুষ না থাকলে সুস্থ হয়ে যাবে পৃথিবী, সে ফ্যাসিস্ট।

‘উই আর দ্য ভাইরাস’ পোস্টের একটি নমুনা; Image Courtesy: grist.org

তাই এখন সবার সচেতন হওয়া উচিত। পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনা উঠলেই কয়েকটা প্রশ্ন খতিয়ে দেখা উচিত।।

কাদের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে এসব কথা? কোনো প্রান্তিক গোষ্ঠী (অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ বা এশিয়ান) এর ওপর কি দায়ভার পড়ছে?

এসকল আলোচনা কি কোনোভাবে ঘৃণা ছড়াচ্ছে?

এসকল আলোচনা কি কোনোভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করছে?

এসকল আলোচনা কি যুদ্ধ বা সহিংসতার ভিকটিমদের দোষারোপ করছে?

এসকল আলোচনা কি ফ্যাসিবাদ বা নাৎসিবাদের গুণগান করছে?

এসকল আলোচনা কি কোনোভাবে জোনোফোবিয়া ছড়াচ্ছে?

কারণ এটা কেউই চায় না, পরিবেশের নাম নিয়ে কেউ মানুষকে ঠেলে দিক আরেকটা হলোকাস্টের দিকে।

কাজেই কোরবানির ঈদের আগ দিয়ে গবাদিপশু হত্যা করার উৎসব বর্বরদের কাজ’  টাইপ কথা বলে লো-প্রোটিন কনজ্যুমিং বাঙালিদের মাঝে গোলমাল লাগাতে চাইলে, একটু ভেবে দেখা দরকার তারা কোন পারপাস সার্ভ করছে কিনা। আপনি শান্তিতে রেস্তোরাঁয় বসে বিফ স্টেক বা ভিগান বার্গার খাবেন, সেটা আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার। আপনার খাদ্য, আপনার সংস্কৃতি নিয়ে কেউ শেমিং করলে, তার প্রতিবাদ করা উচিত। মাদার আর্থের নামে ঘৃণার চাষবাস করা আর যাই হোক- কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না।

Feature Image Courtesy: reddit.com

References:

  1. What is Eco-fascism- David Orten
  2. The Threat of Eco-fascism- Michael H. Zimmerman
  3. Grist.org
  4. Newstatesman.com
  5. Teenvogue.com
  6. GQ.com/story
  7. Euronews.com
  8. Usfblogs.usfca.edu/
  9. Bitchmedia.org
  10. Eenews.net
  11. BBC.com
  12. iheart.com
  13. Indiatoday.in
  14. Radicalrightanalysis.com
  15. Theatlantic.com
  16. Washingtonpost.com
  17. Nymag.com
  18. wired.co.uk
  19. Nytimes.com
  20. Dailycal.org