একটা দিন। ২৪ ঘণ্টার ব্যাপ্তি। এর ভেতর ঠিক কী কী ঘটে মানুষের জীবনে? কখনো কখনো দিন চলে যায় নিস্তরঙ্গভাবে, আবার কখনো কখনো একটা দিন পুরোপুরি বদলে দেয় মানুষের জীবনকে।
‘একদিনে’ উপন্যাসটিও এমন একদিনেরই কাহিনী। নবীন লেখক সায়ন্তন সৈকত রায়ের লেখা এই উপন্যাসটি অমর একুশে বইমেলায় এনেছে পেন্ডুলাম।
কাহিনীর নায়ক বিজয় পাল ওরফে বিজু তার জীবন নিয়ে আছে মহা গ্যাঁড়াকলে। বন্ধু-বান্ধবদের সবাই প্রতিষ্ঠিত৷ এদিকে সে এখনও কাজ করছে নীলক্ষেতে মোস্তফা চাচার বইয়ের দোকানে। কর্পোরেট কোন কাজ করে মাসে বিশটি হাজার টাকা পেলেও হয়ত সমাজে তার একটা তথাকথিত ‘সম্মান’ থাকত। কিন্তু নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানে বসে আয় যদি বেশিও হয়, সামাজিক সম্মানটা মেলেনা সেভাবে।

বিজয়কে কাতর করে রাখে তিথিকে হারোনোর বেদনা। আরো অনেক প্রেমের মতই তাদের প্রেমও পরিণতি পায়নি। অবশ্য এটা কি আসলেও প্রেম ছিলো? নাকি বিজু একতরফে ভালোবাসত তিথিকে?
বিজু সমাজের দেখানো সাফল্যের প্রচলিত পথে হাঁটেনি। সে চাইতো সাহিত্য চর্চা করতে, চলচ্চিত্র বানাতে, অভিনয় করতে।
টিএসসি-র এক মঞ্চনাটক থেকেই তিথির সাথে তার পরিচয়। তিথির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আর চমৎকার কণ্ঠ শুনেই প্রথম তার প্রেমে পড়া।
কিন্তু হায়! পরিণয় তো হলো না আর। চার বছর তেরো দিন পেরিয়ে গেলো। জীবন থেকে চলে গেলো এতগুলো দিন। চলে তো গেছে তিথিও। কিন্তু বিজুর মন তো পড়ে আছে সেই স্বাপ্নিক বাস্তবতায়। এখনো স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে তিথি, সঙ্গীতভবনের সামনের সেসব অপেক্ষার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।

বিজু তার আশেপাশের মানুষের চোখে হতে থাকে অপাংক্তেয়। একবার ‘জাতে’ ওঠার জন্য চোদ্দ লাখ টাকা ঘুষ দেয়ার চেষ্টা, আরেকবার তুলনামূলক অভিজাত বুকশপ এন্ড ক্যাফেতে চাকরি- এসবের দোলাচলেই তার দিনটা যেতে থাকে।
সবকিছু হয়ত তেমনভাবেই চলত। কিন্তু তিথির দেওরের সাথে দেখা তার হিসেব নিকেশ ওলটপালট করে দিলো।
চার বছর ১৩ দিন পরের এই ‘একদিনে’ এরপর এমনকিছু ঘটনা ঘটে, যাতে বিজয় পাল অথবা ‘বিজু’-র জীবনটা বদলে যায় চিরদিনের মত।
সেই জীবনটা আসলে কেমন? তার উত্তর পাঠকেরা পাবেন উপন্যাসের শেষে।
বিজু চাকরি পেলো কি পেলোনা, ‘জাতে’ ওঠা আর বন্ধু নামধারী নিপুণ অভিনেতাদের আসরে আবার জায়গা পেলো কিনা, আর বিশেষত তিথির সাথে তার কীভাবে দেখা হলো – সেসব প্রশ্নের উত্তর পাঠক পাবেন একেবারে শেষে।

তবে একটা বিষয় লেখাটা থেকে পরিষ্কার- ‘তবুও কিছু মন সারাটি জীবন রয়ে যায় কাছাকাছি।’ ইত্যাদির জনপ্রিয় একটি গান ‘আমি আগের ঠিকানায় আছি’-র লাইন এটি৷
সব কিছু আমরা পাইনা তো জীবনে, কিন্তু আবার সেসবকে অনুভব করি অন্যকিছুর মাধ্যমে।
দিনশেষে সম্ভবত আমাদের প্রতিষ্ঠা, পয়সা-কড়ির যাবতীয় হিসেব-নিকেশের বাইরেও আপন একজন মানুষ লাগে৷ যাদের সেরকম কেউই থাকেনা, তাদের থেকে যায় স্মৃতি। পোড়ায়, ভাবায়, কাঁদায়৷
সায়ন্তন সৈকত রায় তার এই উপন্যাসে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করেছেন। যেমন- ফ্ল্যাশব্যাক৷ এখানে অনেক ঘটনা এভাবে ফিরে এসেছে, পরম্পরা বজায় রেখে।
বর্ণনার ধরণে একরকম ইনফর্মালিটি রাখলেও ভাষায় বেশ প্রমিত ছিলেন তিনি। কিছু ক্ষেত্রে কাহিনীর সাথে সঙ্গতি রেখে স্ল্যাং ব্যবহার করলেও নিজস্ব বক্তব্যে তিনি একরকম কেতা বজায় রেখেছেন।

লেখক তার পরিচিত অনেক নাম উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন। যেমন- মোস্তফা চাচা বা তার বইয়ের দোকান। এর মাধ্যমে উপন্যাসটিকে পাঠক আরো কাছের মনে করবেন।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদারের গল্পবলা বা কাহিনী-নির্মাণের ছাপ আছে লেখকের লেখনীতে। তরুণ বাবুর সিনেমায় আমরা ভালোবাসার যে চিরায়ত প্রকাশ, পারিবারিক যে ঘটনাদি দেখি; সায়ন্তন তার এই উপন্যাসে সেই ধাঁচে এগিয়েছেন।
আপনি যদি কিছু সময়ের জন্য আপনার হৃদয়নদী খুঁড়ে কিছু জল বের করে আনতে চান, কিছুটা সময়ের জন্য ডুবে যেতে চান নস্টালজিয়ার গহীন অরণ্যে; তাহলে পড়ে নিতে পারেন সিনেম্যাটিক এই উপন্যাস- ‘একদিনে।’
Feature Image Courtesy: Writer’s Facebook Profile