“How the billionaire CEO of SpaceX and Tesla is shaping our future” লাইনটি অ্যাশলি ড্যান্সের বিখ্যাত বই ‘Elon Musk’ বইয়ের মোড়কে লেখা। বর্তমানে তো তাই দেখা যাচ্ছে! বাস্তবের আয়রনম্যান টনি স্টার্ক বললেও যেন কম বলা হবে এমন একজন ব্যক্তি তিনি। সফল ও পাগলাটে উদ্যেক্তা, মঙ্গলে বসতি গড়তে চান, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটির উৎক্ষেপনকারী প্রতিষ্ঠানটি তার। প্রথম বেসামরিক বা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে সফলভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে পৌছায় তার স্পেস এক্সের ফ্যালকন রকেট। বৈদ্যুতিকভাবে চালিত বিশ্বখ্যাত গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি টেসলা তাঁর। হাইপারলুপের চিন্তা তার মাথায়। স্বপ্ন দেখছেন কয়েক ঘন্টার মাঝেই পৃথিবী ঘুরে বেড়াবে মানবজাতি। তিনি আর কেউ নন, তিনি পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যাক্তি ইলন রীভ মাস্ক।
ইলন মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। বাবা দক্ষিন আফ্রিকান, মা কানাডিয়ান। ছোটবেলা থেকেই ইলনের বইয়ের নেশা। দৈনিক ১০ ঘন্টার করে পড়তেন সায়েন্স ফিকশনের বইগুলো। মাত্র নয় বছর বয়সেই পড়ে শেষ করেন এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটিনিকা। কোডিং করতেন সেই ছোটবেলা থেকেই। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তৈরি করেন ‘ব্লাস্টার‘ নামের ভিডিওগেম। গেমটি পরে ৫০০ ডলারে বিক্রি করে দেন একটি অফিস টেকনোলজি ম্যাগাজিনের কাছে। এখান থেকেই শুরু অন্যতম সফল উদ্যোক্তা ইলন মাস্কের।
প্রাথমিক জীবন দক্ষিন আফ্রিকায় কাটালেও দক্ষিন আফ্রিকান আবশ্যিক সামরিক জীবন সহ্য না হওয়ায় ইলন মাস্ক চলে যান তার মায়ের দেশ কানাডায়। সেখানে কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। মাস্ক তার প্রথম স্নাতক সম্পন্ন করেন ইউনিভার্সিটি অফ পেনিসিলভিনিয়া থেকে ইকোনোমিক্সে। পরে দ্বিতীয় স্নাতক করে বসেন প্রযুক্তিপাগল মাস্ক পদার্থবিজ্ঞানে। এনার্জি ফিজিক্সে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হলেও তা শেষ করেন নি। এরপরেই লেগে পড়েন একজন সফল উদ্যেক্তা হওয়ার সংকল্পে।
সময়টা ইন্টারনেটের শুরুর দিকের। বিল গেটসের ভাষ্যে, ‘Internet is a new big thing’ তখন। এ সম্ভাবনাই ইলনকে ‘Zip2’ নামক সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরিতে অনুপ্রেরণা দেয়। বাবার কাছ থেকে মাত্র ২৪ হাজার ডলার নিয়ে ১৯৯৫ সালের দিকে ছোটভাই কিমবাল মাস্ক ও এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন এ কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি প্রযুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্য খুঁজে নেয়ার সুযোগ করে দেয়। এটি প্রযুক্তির নির্দেশনা ও ম্যাপিংয়ের সুবিধা দিত। জিপ টু কিছুদিন পরে সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্পের জন্য ‘সিটি গাইড’ নামে সফটওয়্যার উদ্ভাবন ও বাজারজাত করে। এ কোম্পানিটি তখন নিউইয়র্ক টাইমস ও শিকাগো ট্রিবিউনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। ১৯৯৯ সালের দিকে ইলন তার কোম্পানিটিকে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘Cচম্পাক‘ এর নিকট বিক্রি করে দেন। চেম্পাক তার এ প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় নগদ ৩০৫ মিলিয়ন ডলার ও ৩৪ মিলিয়ন স্টক শেয়ারের বিনিময়ে। মাস্ক পান ৭% শেয়ার অর্থাৎ ২২ মিলিয়ন ডলার।
একই বছরে জিপ টু বিক্রীত প্রাপ্ত অর্থের ১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন মাস্ক প্রতিষ্ঠা করেন অনলাইনে আর্থিক সেবা প্রদানভিত্তিক কোম্পানি এক্স ডট কম। ২০০০ সালে ‘Confility’ নামক আরেক কোম্পানির সাথে মার্জ করে ‘PayPal’ নামে প্রতিষ্ঠানটির পথচলা শুরু। পরবর্তীতে কোম্পানি পরিচালনায় মতভেদ উপস্থিত হওয়ায় মাস্ক PayPal বিক্রি করে দেন আরেক কোম্পানি ‘E-ber’ এর কাছে। কোম্পানির বিক্রিত অর্থ ১.৫ বিলিয়ন ডলার। কোম্পানিতে মাস্কের ছিল ১১.৭% শেয়ার। মাস্ক এখান থেকে পান ১৬৫ মিলিয়ন ডলার।
জিপ টু ও এক্স ডট কম বা PayPal থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বাকি জীবনটা বেশ আরাম আয়াশেই কাটিয়ে দিতে পারতেন মাস্ক। কিন্তু পৃথিবীকে তখনও তাঁর অনেক কিছুই দেওয়ার বাকি যে! এবার মাস্কের ইচ্ছা আন্তঃমহাদেশীয় রকেট নিয়ে। মাস্ক চান রকেট দিয়ে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে মহাকাশে পণ্য সরবরাহ করবেন। এ উদ্দেশ্য নিয়ে মাস্ক ২০০১ এর অক্টোবরে পাড়ি জমান রাশিয়ায়। কিন্তু মাস্ক এ বিষয়ে একেবারে নতুন থাকায় তাকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়। এসময় তিনি রকেট সায়েন্স এর উপর প্রচুর বই পড়ে রীতিমত রকেটবিজ্ঞানী হয়ে যান। মাস্ক ২০০২ এ আবার তার দল নিয়ে রাশিয়া সফর করেন। এবার সঙ্গে নেন সিআইএও নাসার প্রকল্পে কাজ করা মার্ক গ্রিফিনকে, যিনি একজন স্যাটেলাইট ও স্পেস ক্রাফট নির্মাতা। মাস্ক কসমোট্রাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু সেখানে তিনি দেখেন একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম এর দাম প্রায় ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তা একবারই ব্যাবহারযোগ্য। এটি শুনে মাস্ক হতাশ হয়ে পড়েন এবং বাড়ি ফেরার পথেই ঠিক করেন যে স্বল্পমূল্যে সে রকেট বানাবে যা পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে পাড়ি দিতে সক্ষম এবং একইসাথে তা পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এ সম্পর্কে মাস্কের উক্তি,
“এটা পাগলাটে যে, আমরা এসব অত্যাধুনিক রকেট বানাই এবং প্রতি অভিযানের শেষে এগুলো ধ্বংস করে দেই। এটা সত্যিই হাস্যকর।”
মাস্ক হিসাব করে দেখেন একটি রকেট তৈরির উপাদানসমূহের মূল্য তার বাজারমূল্যের মাত্র ৩%। তার বিশ্বাস জন্মে সফটওয়্যার ইঞ্জিন এর দুটো সূত্র ব্যবহার করে রকেট নির্মাণ ব্যয় ১০ ভাগে নামিয়ে আনা যায়, তারপর লাভের পরিমাণ থাকে ৭০%। এ বিশ্বাস থেকেই জুন ২০০২ সালে ইলন মাস্ক প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান বিশ্বের ব্যাক্তিমালিকানাধীন সবচেয়ে বড় মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা ‘SpaceX’ বা স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজি কর্পোরেশন।
আজকের অন্যতম সফল স্পেসএক্স শুরুটা যে খুব সহজ ছিল তা কিন্তু না। বরং স্পেসএক্সের প্রথম ৩ টি উৎক্ষেপণই ছিল ব্যার্থ অভিযান। কিন্তু ইলন হাল ছাড়ার মত লোক নয়। তার শতভাগ আস্থা ছিল যে তিনি এ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাকাশ পাড়ি দিতে সক্ষম হবেন। শত বাধা এড়িয়ে অবশেষে ইলনের ‘Falcon-1’ এর উৎক্ষেপণ সফল হয়।
ইলন মাস্কের চিন্তাভাবনা ছিল সব সুদূরপ্রসারী। তিনি মনে করতেন মানবজাতির পদচারণা শুধু পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত না। কেননা অচিরেই কোন মহাবিপর্যয় নেমে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ইলন তাই নিকট ভবিষ্যতেই মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপনের চিন্তা শুরু করলেন। মাস্ক মনে করেন পৃথিবী থেকে ৫৪.৬ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার খরচ যোগানের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রকেট পুনর্ব্যবহারযোগ্য। স্পেস এক্স এজন্য তৈরি করল ‘Falcon-9′, ’Falcon Heavy’। প্রয়োজনে ‘BFR’ এর মত অত্যাধুনিক স্পেসক্রাফট তৈরির কথাও তারা জানায় এবং তারা যার নাম দিয়েছেন ‘ড্রাগন‘। সেপ্টেম্বর ২০০৮ ফ্যালকন-১ ব্যক্তি উদ্যোগে প্রথম তরল জ্বালানি ব্যবহার করে পৃথিবীর কক্ষে একটি স্যাটেলাইট স্থাপন করে। মে ২৫, ২০১২ স্পেস এক্স ড্রাগনের একটি যান আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে সফলভাবে অবতরণ করে প্রথম বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবে ইতিহাস গড়ে। ২০১৩ সালে স্পেস এক্স কোম্পানি মহাকাশে মালামাল পরিবহনের বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডিসেম্বর ২৩ নাসার সঙ্গে যে বাণিজ্যিক চুক্তির আর্থিক মূল্যমান ১.৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যায় যখন ২০১৫ এর ২২ ডিসেম্বর ফ্যালকন সফলভাবে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করে। কারিগরি জটিলতার বিবরণ এড়িয়েও যদি বলা হয়, পৃথিবীর কক্ষে প্রেরিত কোন রকেটের এই সফল অবতরণ রকেট পুনর্ব্যবহারের সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে যা মহাকাশ ভ্রমণ ব্যয় কমিয়ে আনবে, মহাকাশে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে মানুষের জন্য; যেটি এলেন মাস্কের স্বপ্ন। এ ছাড়াও তার সাগরকেন্দ্রিক প্লাটফর্মে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে ইতোমধ্যে।
মাস্ক ২০২০-২৪ সালের মধ্যেই মিশন মঙ্গলের স্বপ্ন সত্যি করতে চান। ফ্যালকন-৯, ফ্যালকন হেভি বা স্পেসক্রাফট ড্রাগন এসবই প্রমাণ দেয় যে ইলনের স্বপ্ন সত্যি হতে বেশি দেরি নেই। ইলন মাস্ক ২০১১ সালে স্বপ্ন দেখেছিলেন ২০৪০ এ মঙ্গলে ৮০ হাজার মানুষের বসতি স্থাপনের। সেই সাথে মহাকাশ ভ্রমণ ব্যয় সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসতে নিজ অর্থ বিনিয়োগে ঝুঁকি নিয়েছেন অনিশ্চিত সম্ভাবনায়। মাস্ক তার স্বপ্ন সম্পর্কে এতটাই আশাবাদী যে তিনি নিজের মৃত্যুবরণ কামনা পৃথিবীতে নয়, মঙ্গলে কামনা করেন।
স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার ২ বছর পর ইলন ঠিক করলেন, পৃথিবীতে জ্বালানীর ঘাটতি কমাতে বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত গাড়ির বিকল্প নেই। তাই টেসলা ইনকর্পোরেটেড প্রতিষ্ঠান, যা সৌর ও বিদ্যুৎ শক্তি চালিত মোটরগাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান। ইলন নিশ্চিত করেন যে, ক্যালিফোর্নিয়ায় টেসলার ফ্যাক্টরি থেকে বের হওয়া প্রতিটি গাড়ি যেন ১০০% পরিবেশবান্ধব বা জ্বালানী সাশ্রয়ী হয়।
প্রতিটি পন্যের আইডিয়া সৃষ্টির থেকে শুরু করে ডিজাইন, প্রকৌশল ইত্যাদি সবই মাস্ক নিজে তত্বাবধান করেন। প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় টেসলা বিশ্বের সেরা একটি স্পোর্টস কার ‘রোডস্টার’ বাজারে নিয়ে আসে। মাত্র ৩.৭ সেকেন্ডের মধ্যেই রোডস্টার ০ থেকে এর গতিবেগ ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটারে নিয়ে যেতে সক্ষম। এছাড়াও গাড়িটি কোনোরকম জ্বালানী তেল বা গ্যাস ছাড়া শুধুমাত্র এর লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারীর ওপর নির্ভর করে ২৫০ মাইল পাড়ি দিতে পারে। ডেইমলারের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন ও টয়োটার সাথে কারিগরী অংশীদারিত্ব নিয়ে ২০১০ সালের জুনে টেসলা প্রথমবারের মত পাবলিক লিমিডেট কোম্পানী হিসেবে স্টক মার্কেটে নামে। অল্প সময়ের মধ্যেই যার মূল্য দাঁড়ায় ২২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
কোম্পানীর প্রথম ইলেকট্রিক সিডান ‘Model – S’ বাজারে দারুন সফলতা লাভ করে। একবার ব্যাটারি ফুল চার্জ হলে এটি ২৬৫ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম। মোটর ট্রেন্ড ম্যাগাজিন মডেল এস কে ২০১৩ সালের সেরা গাড়ির মর্যাদা প্রদান করে।
২০১৭ সালের এপ্রিলে ঘোষণা দেয় যে তারা জেনারেল মোটরস কে টপকে আমেরিকার সবথেকে লাভজনক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটি অবশ্যম্ভাবী ভাবেই টেসলার প্রত্যাশা পূরণ করেছিল এবং পণ্য প্রস্তুতে আরও গতির সঞ্চার করেছিল যার ফলে ঐ বছরই তারা তাদের ‘মডেল ৩ সিডান’ বাজারে আনে।
২০১৭ এর নভেম্বরে মাস্ক কোম্পানীর ডিজাইন স্টুডিওতে তাদের নতুন দু’টি গাড়ি টেসলা সেমি এবং রোডস্টারের পর্দা উন্মোচন করে আবারও একবার হৈচৈ ফেলে দেন। টেসলা সেমি আসলে একটি সেমি ট্রাক, ২০১৯ সালে যেটির প্রস্তুতের কাজ শুরু হবার কথা রয়েছে। একবার ব্যাটারি ফুল চার্জ দিলে গাড়িটি ৫০০ মাইল পথ পাড়ি দিতে পারবে এবং সেইসাথে কোম্পানীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে গাড়িটির ব্যাটারি ও মোটর ১ মিলিয়ন মাইল ভ্রমণ পর্যন্ত কোনও সমস্যা ছাড়াই চলবে। রোডস্টারকে ধরা হচ্ছে আজ পর্যন্ত তৈরী হওয়া সবথেকে দ্রুতগামি গাড়ি হিসেবে। মাত্র ১.৯ সেকেন্ড সময়ে এর গতিবেগ প্রতি ঘন্টায় ০ থেকে ৬০ কিলোমিটারে উঠবে! রোডস্টার ২০২০ সালে বাস্তবতার মুখ দেখবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন মাস্ক।
রোডস্টারের উন্মোচন অনুষ্ঠানে মাস্ক বলেন – “আমার এই প্রকল্পের একমাত্র উদ্দেশ্য হল খনিজ জ্বালানী চালিত গাড়িকে একটি বড় আঘাত দেয়া। (আমার গাড়ির পাশে) খনিজ জ্বালানীর স্পোর্টসকার চালালে মনে হবে আপনি ডিমের খোসায় তৈরী একটি স্টিম ইঞ্জিন চালাচ্ছেন।”
ইলনের আরেকটি উদ্যোগ হলো তিনি সমস্ত পৃথিবীটাকে সৌরিশক্তির নিচে আনতে চান। আরও বেশি মানুষের হাতে বহুব্যবহারযোগ্য জ্বালানী ও শক্তি তুলে দেয়ার এবং এই শক্তির ব্যবহারকে আরও বেশি প্রচলিত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে ২০১৬ এর আগস্ট মাসে মাস্ক তাঁর ইলেক্ট্রিক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও সৌরশক্তি উৎপাদনকারী কয়েকটি কোম্পানীর মাঝে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করেন। তাঁর টেসলা মোটর কোম্পানী সেই বছর ঘোষণা দেয় যে তারা সোলার সিটি করপোরেশনের সমস্ত স্টক কিনে নিয়েছে। ২০০৬ সালে তিনিই তাঁর কয়েকজন আত্মীয়কে সোলার সিটি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন। বর্তমানে দুই প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ারই তাঁর। এই চুক্তির ব্যাপারে টেসলার ওয়েবসাইটে নিচের লেখাটি প্রকাশিত হয়,
“সৌরশক্তি এবং এর ব্যবহারকারী সবথেকে ভাল কাজ করে যখন তারা একই জায়গায় থাকে। টেসলা (ব্যবহারকারী) এবং সোলার সিটি (সৌরশক্তি উৎপাদনকারী) একসাথে এমন সব সুনির্মিত, বানিজ্যিক পণ্য প্রস্তুত করতে পারবে যা শক্তি প্রস্তুত, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের ধারনাই বদলে দেবে।”
বর্তমানে সবথেকে বেশি ইলেক্ট্রনিক পন্যের পেটেন্ট এর মালিকানার রেকর্ডও টেসলার দখলে।
ইলন স্বপ্ন দেখেন মানুষ পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কয়েকঘন্টার ভিতর পাড়ি দিবে। এই সময় বিপ্লব পরিচালনা করতে চান তিনি হাইপারলুপ নামক প্রযুক্তির মাধ্যমে। মাস্কের ভাষ্য অনুসারে মাটির নিচ দিয়ে বায়ুরোধী লুপের মধ্য দিয়ে ক্যাপসুলের সাহায্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাওয়া যাবে সহজেই। আগস্ট, ২০১৩ তে ‘হাইপারলুপ আলফা’ নামক একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে মাস্কের কোম্পানি। এটি লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়া পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ মাইল দীর্ঘ হাইপারলুপ প্রকল্প। হাইপারলুপ জেনেসিস পেপার অনুযায়ী এ ব্যবস্থায় ৩৫০ মাইল বা ৫৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটে যাত্রীসমেত মাত্র ৩৫ মিনিটের অতিক্রম করা যাবে। ঘণ্টায় ৭৬০মাইল বেগে ছুটে চলা এ ব্যবস্থা প্রচলিত রেল বা বিমান ভ্রমণের চেয়েও দ্রুত।
প্রস্তাবিত রুটের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে শুধু মাত্র যাত্রীবাহী সংস্করণের জন্য প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং কিছুটা বড় ব্যাসের যাত্রী ও যানবাহন পরিবহনের জন্য ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। হাইপারলুপ ট্রান্সপোর্টেশন টেকনোলজি দিয়ে চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুর মধ্যে প্রস্তাবিত রুটের জন্য ভারত সরকারের সাথে একটি চিঠি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে, তবে ৩৪৫ কি মি দূরত্ব ৩০ মিনিটের মধ্যেই অতিক্রম করা যাবে।
মাস্কের মতে, হাইপারলুপ মঙ্গল গ্রহে বেশ কার্যকরী হবে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল সমুদ্রপৃষ্ঠে পৃথিবীর ঘনত্ব প্রায় ১%। হাইপারলুপ ধারণাটি পৃথিবীতে কাজ করার জন্য বায়ু প্রতিরোধ হ্রাস করতে নিম্ন-চাপ টিউবগুলি প্রয়োজন। তবে যদি সেগুলো মঙ্গল গ্রহে নির্মিত হয় তবে কেবল একটি ট্র্যাক হলেই একটি হাইপারলুপ তৈরি করা যাবে।
ইলনের লক্ষ্য ওপেন এআই শুরু করা যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঠিক প্রয়োগ করে কাজ করা হয়। নিউরালিঙ্কের চিন্তাধারা এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সরই। নিউরালিংক একটি ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস তৈরী করেছে। সহজ কথায় তারা তাদের আবিষ্কৃত সূতার ন্যায় কিছু কানেক্টর বা থ্রেড মানুষের ব্রেইনে ঢুকাবে। অতঃপর সেই থ্রেডগুলো মাথার খুলির উপর থাকা একটি ছোট্ট চিপের সাথে যুক্ত হবে। সেই চিপটি কানের সাথে যুক্ত একটি যন্ত্রের মাধ্যমে ব্রেইন থেকে বিভিন্ন নির্দেশ সিগন্যাল হিসেবে কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পাঠাবে। আর এই সিগন্যাল ব্যবহার করে পক্ষাঘাতগ্রস্থ রোগীরা হাত পা না নাড়িয়ে, এমনকি কোন শব্দ না করেই শুধু চিন্তা করার মাধ্যমে কোন যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এটা যদি মানুষের ক্ষেত্রে সত্যিই করা সম্ভব হয় তাহলে তা যে পৃথিবীকে বদলে দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এই কারণেই এলন মাস্ক আর নিউরালিঙ্ক নিয়ে এত আলোচনা।
তাদের একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী এরকম ৯৬ টি তন্তুর এক একটি অ্যারেতে সব মিলিয়ে ৩০৭২টি ইলেক্ট্রোড আছে। এগুলো একসাথে অনেক বেশি ডেটা পরিবহন করতে পারবে। সূতাগুলো মাত্র ৪ থেকে ৬ মাইক্রোমিটার ব্যাসের অর্থাৎ এগুলো মানুষের চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম।
মাস্কের ‘গিগাফ্যাক্টরি’ বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মানের কোম্পানি রয়েছে। বোরিং কোম্পানি নামে মাস্কের একটি কোম্পানি আছে যেটি টানেল বানায় যার মাধ্যমেই সহজেই যান চলাচল সম্ভব।
ইলন মাস্ক ব্যক্তিগত জীবনে দুইবার বিয়ে করেছেন। ২০০০ সালে তিনি কানাডিয়ান লেখিকা জাস্টিন উইলসনকে বিয়ে করেন যা ২০১০ সালে তিক্ত একটি বিচ্ছেদের মধ্যদিয়ে শেষ হয়। তার এই সংসারে ৫ ছেলেমেয়ে রয়েছে। পরবর্তীতে সেই বছরই তাঁর পরিচয় হয় বৃটিশ অভিনেত্রী টালূলাহ রেইলির সাথে। ২০১০ সালেই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০১২ তে একবার আলাদা হয়ে ২০১৩ সালে আরেকবার বিয়ে করেন তাঁরা এবং ২০১৬ সালে শেষবারের মত বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে মাস্ক ও রেইলির মাঝে।
২০১৭ থেকে মাস্ক হলিউড অভিনেত্রী এ্যামবার হার্ডের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২০২০ মিউজিসিয়ান গ্রিমসের গর্ভে মাস্কের ৬ষ্ঠ ছেলেসন্তান জন্মায়।
থাইল্যান্ডে গুহায় শিশুদের আটকে পড়ার ঘটনায় ফ্যালকন-৯ এর তরল অক্সিজেন সরবরাহ করার টিউব দিয়ে তৈরিকৃত একটি মিনি সাবমেরিন দান করেন মাস্ক উদ্ধারকারীদের সাহায্যার্থে। মানবজাতির কল্যানে বিরাট সম্ভাবনাময় মহাকাশ অন্বেষণ এবং মানবজাতির স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত করাই মাস্কের কাজের প্রধান অনুপ্রেরণা। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তিনি মাস্ক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন যা মহাকাশে নতুন সম্ভাবনার খোঁজ এবং বহুব্যবহারযোগ্য পরিবেশবান্ধব শক্তির উৎস খুঁজে বের করার কাজে নিবেদিত। মানবজাতির জন্য ইলন মাস্কের এইসব নিবেদন কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
Feature Image Courtesy: medium.com
References:
1. BBC.com
2. DW.com
3. Theladders.com
4. Investopedia.com
5. Britannica.com