মালায়ালাম চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা ফাহাদ ফাসিল। আপনারা হয়ত জানেন তার সেরা চরিত্র, অতীত পরিচয় বা পারিবারিক বৃত্তান্ত। কিন্তু চলুন আজকের লেখায় আমরা জেনে নিই কীভাবে প্রথম সিনেমা ফ্লপ হওয়ার পরও ক্রমেই তিনি ছুঁয়েছেন মোহনলাল, মাম্মুথিদের মত অভিনেতাদের সমান জনপ্রিয়তা। পৃথ্বীরাজ, দুলকার সালমান, নিভিনদের সাথে আসীন হয়েছেন একই আসনে।
ফাহাদকে বলা হয় ক্লোজ শট অভিব্যক্তির রাজা। আপনারা হয়তো ভেবে অবাক হবেন যে প্রায় টাক মাথা, চোখের কোল ভারী এমন একটা লোককে কী করে ক্লোজ শটের রাজা বলা হয়। কিন্তু তার অভিনীত সিনেমাগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে এ কথা ভুল নয়।
আরও খোলাসা করে বললে, অভিনয় মূলত মোটা দাগে দুই প্রকার- ‘ফিজিকাল অ্যাক্টিং’ ও ‘ভার্বাল অ্যাক্টিং’। সিনেমা যখন সাইলেন্ট ছিল, সংলাপ সাথে সাথে রেকর্ড ও ডাবিং প্রযুক্তি ছিলনা বা চলচ্চিত্রের সাথে সংলাপ মিলানোর কৌশল মানুষের যখন অজানা ছিল সেই সময় অভিনয়শিল্পীদের তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়েই নিজের চরিত্রের বক্তব্য ফুটিয়ে তুলতে হতো। চার্লি চ্যাপলিন বা বাস্টার কিটনের অভিনয় দেখুন। কিংবা ‘সিটি লাইটস’ -এ অন্ধ মেয়েটি অভিব্যক্তি দিয়ে যেভাবে তার অন্ধত্বের বেদনা তুলে ধরেছিল- এগুলো ফিজিক্যাল অ্যাক্টিংয়ের চমৎকার উদাহরণ।

আর ভার্বাল অ্যাক্টিং সংলাপ বলার অভিনয়। গডফাদারে মারলন ব্রান্ডো স্রেফ একটি চেয়ারে বসে থাকলেও তার কণ্ঠ দিয়ে যখন বলেন- “I will make him an offer that he can’t refuse…” সেটা আমাদের সবার বুক কাঁপিয়ে দেয়। কিংবা ‘দেয়া নেয়া’ চলচ্চিত্রে উত্তম কুমার ও কমল মিত্রের বাবা-ছেলে চরিত্রে সেই বিখ্যাত “কোথাও যাচ্ছো?” সিকোয়েন্সটিও ভার্বাল অ্যাক্টের এক চমৎকার উদাহরণ।

কিন্তু চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকদের মতে স্রেফ সংলাপ নির্ভরতা দিয়ে চলচ্চিত্র হয় না। ওটি মঞ্চনাটক, অপেরা বা ডেইলি সোপেও করা যায়। চলচ্চিত্র হচ্ছে সংলাপ কম কিন্তু ভিজ্যুয়াল বেশি- এমন একটি ব্যাপার। পরিচালক ভিজ্যুয়াল দিয়েই দর্শকদের বেশি গল্প বলবেন। আর সেজন্যই দরকার হয় এমন অভিনেতাদের যারা ফিজিক্যাল এক্টিংয়ে সুদক্ষ। ফাহাদ ফাসিল এমনই একজন অভিনেতা, যিনি তার দুটো চোখ দিয়েই অ্যাক্টিংয়ে যোগ করেছেন ভিন্ন একটি মাত্রা। যাকে নিঃসন্দেহে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিংয়ের একটি নতুন দিক হিসেবে সংযোজিত করা যায়।
ফাহাদের অভিনীত মাল্টিস্টার ফিল্ম ‘বেঙ্গালোর ডেইজ’ এ এক ঝাঁক তারকার ভিড়ে হয়তো তিনি চোখে পড়তেন না। কিন্তু ফ্রেমের আর সব চরিত্র থেকে তিনি এতই ভিন্ন যে আপনার চোখ তার দিকে যেতে বাধ্য। আর তখনই আপনি খেয়াল করবেন যে কিভাবে সে তার কাছে আসা মানুষদের চোখের দিকে না তাকিয়ে তার চরিত্রের যে নিস্পৃহতা তা বজায় রাখছে। সেটি বিয়ের রিসিপশনে তার স্ত্রীর সাথে বাকিদের ছবি তোলার সময় অথবা পরবর্তী সিকোয়েন্সে ডিনার টেবিলে নিভিন পাওলির হাতে চটকে বিরিয়ানি খাওয়া বা দুলকারের পা উপরে তুলে বসা দেখে রাগ করা- একটি সংলাপ না বলেও স্রেফ চোখের মুভমেন্টেই আমরা কাহিনি বুঝে যেতে পারি। আবার যখন তার অতীতের ফ্লাশব্যাক আসে, তখন ফাহাদের চোখের ভাষাও যেন একদম ১৮০ ডিগ্রী বিপরীত।

এরপর ফাহাদের অভিনীত ‘২২ ফিমেল কোট্টাম’ এ সে প্রথমে একজন প্রেমিকের ভূমিকায় থাকে। কিন্তু পরে সে একজন ধর্ষকের সহযোগী হয়ে উঠে, যে কিনা তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নিজ প্রেমিকার ধর্ষণে সহায়তা করে। পরে দেখা যায় তার প্রেমিকাই তাকে সিডাটিভ দিয়ে অজ্ঞান করে রাখে এবং ক্রমে যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে, সেই পুরাতন কোন মেলোড্রামাটিক চিরন্তন সংলাপ, “আমি এখানে কেন? আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন!” -এসব বা ন্যূনতম একটা চিৎকারও সে করে না। শুধু চোখ খুলে তৃপ্তির চোখে তাকায়। আর ক্রমে যখন বুঝতে পারে যে সে বন্দী সাথে সাথেই তার চোখে রাগ, ব্যর্থতা, ক্রোধ আর পরে হতাশা একত্রে নেমে আসে। তার হাত-পা বাঁধা ছিল। তার এই পরিণতির কারণ যখন প্রেমিকা তাকে জানায় তখন মনের অনুভূতি বোঝার জন্য পরিচালক তার চোখ বরাবর ক্লোজ শট নেয় এবং অশ্রুভেজা চোখের শট নিয়ে পুরো ব্যপারটি শেষ হয়।

এবার ফাহাদ অভিনীত অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা ‘মহেশিন্তে প্রতিকারম’ নিয়ে বলি। এখানে ফাহাদ ও ক্লোজ শটের সম্পর্কটা ভাল বুঝানো যাবে। যারা সিনেমাটা দেখেছেন তারা মনে করতে পারবেন যে তার ছোট বেলার প্রেমিকার সাথে তার ব্রেকাপের সিকোয়েন্সটি। যখন মোবাইলে প্রথম এ নিয়ে কথা হয় তখন যেন ঘটনার অবিশ্বাস্যতায় মহেশের চোখ একদম পলকহীন স্থির হয়ে যায়, পুরোপুরি খোলা। তারপর প্রেমিকার বিয়ের দিন লং শটে তার দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মহেশকে চার্চের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। তারপর আসে মিডশট, এরপরই ক্লোজে ফাহাদের চোখের জাদু শুরু হয়। মাঝেমাঝে একদম পরিষ্কার পথে আছাড় খেয়ে পড়ে যেমন আমাদের নিজেদেরই ব্যাথার মাঝে একটা হাসি চলে আসে, তেমনই তার চোখের দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি প্রেমিকা সহ্য করতে না পেরে চলে যায়, আর বিয়েবাড়ির ভিড়ের মধ্যেও ফাহাদের চোখ তাকে খুঁজতে থাকে। কারণ প্রেমিকাকে তো আর সে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে পারবে না। সমাজের চোখে তা অবৈধ। তারপরের শট, যেখানে সিকোয়েন্সটি শেষ হয়, আমরা দেখি কাঁদতে কাঁদতে তীব্রভাবে ফাহাদের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। যেটি এই সিকোয়েন্সের প্রথম শটের একদম বিপরীত, অবশেষে তার জীবনে অকল্পনীয় ঘটনাটি যে ঘটে গেলো তা বুঝতে পারার তীব্র একটি অভিব্যক্তি যেন!

‘কুমবালাঙ্গি নাইটস’ সিনেমায় নিজের রূপমুগ্ধ ফাহাদের অন্যদের দিকে ‘দয়া করছি’’ ভাব নিয়ে তাকানোর অভিনয়টা চমৎকার ছিল। কখনো আয়না পেলে সে নিজ ছাড়া আর কারোর দিকেই তাকাতো না। সেটি তার সেলুনের আয়না হোক বা মোটরসাইকেলের ভিউ গ্লাস হোক। আর যদিও তাকাতো, চোখ সরু করে একটা করুণা দানের মত ভাব ফুটে উঠতো চোখে। এছাড়া তার স্ত্রীর ছোট বোনের প্রেমিক বিষয়ক আলোচনার সময় নিজের চোখ নিজ হাতে বারবার সে চেপে ধরে, কুঁচকে তোলে- যেন বোঝানো যে এই বিষয়টাও চাপা দাও। আমি এটি নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নই।

জাতীয় পুরষ্কারজয়ী সিনেমা ‘থোন্ডিমুন্থালুন দৃশ্যাকশিয়ম’ সিনেমায় চোর চরিত্রে তার এন্ট্রি শটেই এক্সট্রিম ক্লোজ আপে ঐ চেইন চুরির সময় দুই বাহুর মাঝে চোখের সেই একবার চেইন আরেকবার পুরো বাসের যাত্রীদের দিকে নজর রাখা- দেখে মনে হয় যেন তার চোখেরই নিজস্ব একটি আলাদা মস্তিষ্ক আছে। যেন তা স্ক্রিপ্ট পড়েই ঠিক করে নেয় ফাহাদের অভিনয়ে নতুন কি ভাষা জুড়তে হবে।

তো বুঝতেই পারছেন এই গুণী মানুষটির ফ্যান নেহায়েতই কম হবে না। আর ফ্যানদের ক্রেজেও তুমি-আপনি গুলিয়ে যায়। কিন্তু সাউথ ইন্ড্রাস্ট্রির যে সাধারণ ট্রেন্ড, স্টারদের নামে ফ্যান ক্লাব করা, তা নিয়ে এই ভদ্রলোকের ঘোরতর আপত্তি। ২০১৬ সালের এক ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, স্টারদের নিয়ে অহেতুক মাথা না ঘামিয়ে যুবসমাজ যেন নিজেদের কাজ, পড়ালেখা এসবেই সময় ব্যয় করেন। তাহলেই সমাজের উন্নতি আর সমাজের একটি অংশ হিসেবে চলচ্চিত্রের উন্নতি হবে।
কিন্তু তারপরও মুগ্ধতার স্রোত কি আটকানো যায়? তারই একটি নিবেদন ধরতে পারেন এই লেখাটিকে!
Feature Image Courtesy: newindianexpress.com