জাপানের একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। সাধারণত স্টিকি রাইস জাপানিদের খুবই পছন্দের খাবার। তাই এটির চাহিদাও বাজারে বেশ। কিন্তু জাপানিরা যে মূল্যে নিজেদের বাজার থেকে এই চাল কিনছে সেই মূল্যের আরো কমে সহজেই বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে তারা তা আমদানি করতে পারতো। কিন্তু নিজেদের কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে উচ্চমূল্য দিয়েই তারা স্বেচ্ছায় একই জিনিস কিনছে নিজেদের বাজার থেকে। অথচ একই চিত্র আপনি বৈশ্বিক ভাবে মিলাতে পারবেন না। বৈশ্বিক বাদ দিন, নিজ দেশেই তো কৃষকদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। উচ্চমূল্য তো দূরে থাক ন্যায্য মূল্যই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাতে করে দিনকে দিন কমছে কৃষকদের পরিমাণ। তবে উপরের ঘটনাটি অনেক বিশাল সমস্যার একটি দিক মাত্র। মূল সমস্যা আরো গভীরে প্রোথিত।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে বিগত ২০ বছরে কৃষিখাতে বাংলাদেশে লোকবল কমেছে ৩৬ ভাগ। তার উপর কৃষকদের গড় বয়স বাড়ছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে বাংলাদশের কৃষকদের গড় বয়স ৬০ এর উপরে। তার মানে নতুন প্রজন্ম থেকে কৃষি কাজ কিংবা খামার গড়ে তোলার প্রবণতা একেবারে শূন্যের কোটায়। তবে ঢালাওভাবে তরুণ প্রজন্মকে দোষারোপ করলেই হবেনা। আরো যেসব কারণে কৃষিকাজ কিংবা কৃষকদের বেহাল অবস্থা তাই নিয়েই আজকের আয়োজন।

ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত
ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়াটা কৃষক হওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। বিবিসির জরিপে উঠে এসেছে গাজর উৎপাদনে সবচেয়ে বড় দেশ আর্জেন্টিনা। সেখানে প্রতি কেজি গাঁজর স্থানীয় কৃষকদের কাছে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছেন মাত্র ৭-৮ পেসো তে। সেটিই বুয়েনস আয়ার্সে এসে হয়ে যাচ্ছে ৬০-৭০ পেসো। মাঝখানে কৃষকরা হারাচ্ছে তাদের ন্যায্য মূল্য। লভ্যাংশ দূরে থাক চাষাবাদের খরচ উঠাতেই হিমশিম খাচ্ছে তারা।

একই চিত্র এ দেশেও বিদ্যমান। প্রান্তিক চাষীরা বারবার মার খাচ্ছেন সিন্ডিকেট ব্যবসার জের ধরে। প্রতিটি শস্য ঢাকায় যে দামে বিক্রয় হচ্ছে তার অর্ধেকের অনেক কম দামে বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে কৃষকরা। অনেকে রাগে অভিমানে নিজেদের ফসল ন্যায্য দাম না পেয়ে নদীতেও ফেলে দিচ্ছেন। আর এসবের ফলে কৃষি কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকেই।
নগরায়ন
১৯৮৩ সাল থেকে একবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত এ দেশ কৃষি জমি হারিয়েছে ১ মিলিয়ন হেক্টর। গড়ে যেটি বছরে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর। নগরায়নের এই যুগে আবাদি জমি কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশে সেই কমে যাওয়ার হার আর অন্য যেকোনো দেশ থেকেই বেশি অস্বাভাবিক। মূলত বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় নেহায়তই ছোট দেশ হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত কমছে মাথাপিছু জমির পরিমাণ। এর পাশাপাশি পানি সেচের উৎসগুলোও ভরাট হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বর্তমানে গ্রামেও দেখা যাচ্ছে যে নদী খাল পুকুর গুলো অবৈধ ভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে কৃষকরা হারাচ্ছেন তাদের আবাদি জমি ও কৃষিকাজের জন্য প্রাকৃতিক সহায়তাও। নদী বা পুকুর ভরাটের কারণে কৃত্রিম সেচের দিকে ছুটছেন কৃষকেরা। তাতে আবার হীতে বিপরীত হচ্ছে। কৃষকদের খরচ কিংবা লগ্নি বেড়ে যাচ্ছে অনেক। যা পরবর্তীতে ফসল বিক্রয় করে তুলে আনতে পারছেন না সিংহভাগ কৃষকই। শেষমেশ উপায়ন্তর না দেখে কৃষিকাজকেই বিদায় বলে দিচ্ছেন অনেকে।
লিঙ্গ বৈষম্য
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের মতে পুরুষদের মতো যদি নারীরাও জমির কর্তৃত্ব সমান ভাবে পেতো তাহলে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্রসীমা থেকে বের হয়ে আসতে পারতো। কিন্তু বাস্তব চিত্র খুবই করুণ। পৃথিবীতে জমির মালিকদের মধ্যে ১৫ ভাগের কম সংখ্যক মালিক হচ্ছেন মেয়েরা। যার ফলে জমি নিয়ে সিদ্ধান্ত খুব কমই আসে নারীদের পক্ষ থেকে। আর এই বিশাল ফারাকের কারণেও কৃষকদের সংখ্যা কমছে।

দেখা যায় কোনো এক জমি বিক্রয় কিংবা ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষরা বেশি এগিয়ে নারীদের থেকে। এমনকি কোন ফল বা শস্য উৎপাদন হবে সেটি ঠিক করছেন পুরুষেরা। কৃষিকাজের মূলে যে ধৈর্য রয়েছে তা পুরুষরা অনেকাংশেই শতভাগ দিতে পারেন না। বিবিসির এক জরিপে উঠে এসেছে যে, উৎপাদিত ফসলের ৩০% ফসল ই কারো মুখে উঠে না। এই বিপুল পরিমাণ পঁচে যাওয়া ফেলনা শস্যের জন্য দায়ী পরিচর্যা আর যত্নের অভাব। এ ক্ষেত্রে জমির কর্তৃত্বে নারীরা থাকলে তা কমে আসতো অনেকখানিই।
জীবনযাত্রার মান
গ্রামের চেয়ে শহরের জীবন যাত্রার মান কিংবা সুযোগ সুবিধা সব কিছুই বেশি। আবার অন্যদিকে কৃষি জমিগুলো বেশিরভাগই গ্রামের দিকে অবস্থিত। কিন্তু শহুরে জীবনের জন্য অনেকেই গ্রাম ছেড়ে স্থায়ী হচ্ছেন নগরে। যার জন্য কৃষক কমছে দিনকে দিন। উল্টো দিকে নগরায়নের ফলে শহরেও সেভাবে মিলছেনা চাষাবাদের জমি। তাই কৃষকের সাথে সাথে কমছে আবাদী জমিও।

এগ্রিকালচার রিসার্চার আন্দ্রেস সোসার মতে, উন্নত মানের কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজন চারটি জিনিস। তা হলো পানি, ইন্টারনেট, শিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য। অথচ বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যাবে এর একটিও পরিপূর্ণভাবেভাবে নেই একজন কৃষকের কাছে। তাই জীবনযাত্রার মান ও একটি বড় নিয়ামক।
আধুনিক প্রযুক্তি
প্রথম বিশ্বের দেশ গুলোয় কৃষিকাজ এখনো চাঙ্গা থাকার মূলে যেটি রয়েছে সেটি হচ্ছে উন্নত ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার গুটি কয়েক দেশ বাদে বাকী সব জায়গাতেই টেকনোলজির বদলে ম্যানুয়ালিই কৃষিকাজ করতে হচ্ছে কৃষকদের। নাইজেরিয়ার কথাই ধরা যাক। দেশটির বেশিরভাগ গ্রামেই বিদ্যুৎ সুবিধা নেই। আর থাকলেও দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে বড়জোর ৮-১০ ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় থাকে। যার ফলে আধুনিক প্রযুক্তি দূরে থাকুক নিজেদের শস্য মজুদ করার হিমাগারের জন্যও চড়া মূল্য গুণতে হয় কৃষকদের।

একই চিত্র প্রযোজ্য বাংলাদেশেও। নগরায়নের দোহাই দিয়ে শহরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকছে তার অনেক কম থাকছে গ্রামে। পাশাপাশি সরকারী হস্তক্ষেপে যেখানে কৃষকদের প্রযুক্তির বিষয়ে সহায়তা করার কথা সেসব ই বাস্তবায়ন হচ্ছে কোথায়। তাই দিনকে দিন কমছে কৃষক আর সাথে কৃষি জমিও।

‘ভাতে মাছে বাঙ্গালী’ – কথাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনো আগের মতোই প্রযোজ্য। একটা সময় যেখানে দেশের ৮০% মানুষ কৃষিকাজের সাথে কোনো না কোনো ভাবে জড়িত ছিলো তা এখন নেমেছে ৪৪% এ। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে আমাদের কৃষকের অভাব বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হবে। তাই সময় থাকতেই আমাদের উচিৎ কৃষিকাজের মতো এই মহৎ পেশা কে রক্ষা করা।
Feature Image Courtesy: comdevasia.org