ফরাসি বিপ্লবের পটভূমিকায়

অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্স। ফরাসি বিপ্লবের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রাজা ষোড়শ লুইয়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হচ্ছে ফ্রান্সের জনতা। গণপরিষদে অভিজাতদের সাথে তৃতীয় শ্রেণির বেঁধে গেছে দ্বন্দ্ব। অভিজাতরা চাইছে না তৃতীয় শ্রেণির লোকদের অধিকার দিতে। তারাও ছাড়ার পাত্র নয়। আদায় করে নিতে চাচ্ছে নিজের অধিকার। এসবে তেমন মন ছিলোনা গ্রাভ্রিয়াক গ্রামের যুবক আন্দ্রে লুইয়ের। কিন্তু যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হলো বন্ধু ফিলিপ, তখন বন্ধুহত্যার বিচার চেয়ে রুখে দাঁড়ালো সে। আর এজন্য সুযোগমত ব্যবহারও করে ফেললো বিপ্লবীদের এক সমাবেশকে। সেখানে তার দেয়া ভাষণ শুনে বিপুল উদ্যমে ফেটে পড়লো জনতা, আর এর পরিণতিতে ফেরার হতে হলো তাঁকে।

সত্য ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এক কাল্পনিক চরিত্রের বিচরণ ঘটিয়ে লেখক রাফায়েল সাবাতিনি এভাবেই শুরু করলেন তার বিখ্যাত থ্রিলার ‘স্কারামুশ‘।

রাফায়েল সাবাতিনি, Image Courtesy: wikimedia.org

ফিরে যাই লুইয়ের কাছে। ঘটনাচক্রে এক নাটকের দলের সাথে ভিড়ে গেলো আন্দ্রে লুই। পোলিশিনেল এর ভূমিকায় অভিনয়কারী দলপ্রধান বিনেতের আস্থাও অর্জন করে নিলো সে। টিকেট চেকার হিসেবে শুরু করে হঠাৎই সে পেয়ে গেলো স্কারামুশের চরিত্র। বিদূষক, কৌশলী, পলায়নপর এক চরিত্র। দুর্দান্ত অভিনয় করে চলছিলো আন্দ্রে লুই। বিনেতের হতশ্রী দলের শ্রীও ফিরিয়ে এনেছিল ভালোভাবেই। জীবনে প্রেমও এলো, বিনেতের মেয়ে ক্লিমেনের প্রেমে পড়লো সে। কিন্তু তখনই আবারো দৃশ্যপটে আবির্ভাব মাহখি (জমিদার) দু লা তুখ দাজির। এই লোকটিকেই প্রতিশোধের জন্য পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে আন্দ্রে লুই। তার বন্ধু ফিলিপকে হত্যা করেছে এই লোকটিই।

কিন্তু ক্লিমেনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো দু লা তুখ দাজি। বন্ধু হত্যার শোধের আগুনে নতুন করে ঘি ঢাললো তার প্রেমিকা হারানোর শোক।

এ সময়েই একদিন এক মঞ্চায়নে সম্মানিত দর্শক হিসেবে দ্যু লা তুখ দাজিকে আবিষ্কার করে আন্দ্রে লুই। নাটককেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলে সে। সমবেত দর্শকদের সামনে মুখোশ খুলে দেয় মাহখি দ্যু লা তুখ দাজির।

বইয়ের একটি প্রচ্ছদ, Image Courtesy: amazon.com

আন্দ্রে লুই ভেবেছিল নাটকের মাধ্যমে অনেকদূর এগিয়ে যাবে সে। প্যারিসে, ভিয়েনায়, লণ্ডনে হবে তাঁর নাটকের প্রদর্শনী। কিন্তু মাহখির মুখোশ খুলে দেবার পর এখান থেকেও পালাতে হলো তাকে।

এরপর আন্দ্রে লুইয়ের জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। আবারও আত্মগোপন করে পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে। এবার তাঁর নতুন শুরুটা হয় তলোয়ারবাজ হিসেবে। আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছিল সে। সাথে তলোয়ার চালনার প্রশিক্ষণও ছিলো কিছু। এবার দক্ষ প্রশিক্ষক বার্তনের একাডেমিতে ঢুকে তলোয়ার চালনায় রীতিমত অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলো। সাথে যোগাযোগ রেখেছিলো পুরনো বন্ধু ল্য শাপুলিয়ারের সাথেও। লা শাপুলিয়ার বিপ্লবী রাজনীতির সাথে যুক্ত। পার্টির বড় এক নেতাকে সাথে নিয়ে আন্দ্রে লুইয়ের সাথে দেখা করলো সে। প্রস্তাব দিলো তৃতীয় শ্রেণির পক্ষে প্রতিনিধি হয়ে সংসদে যাওয়ার।

আন্দ্রে লুই যে ব্যক্তিগতভাবে বিপ্লবী রাজনীতি খুব পছন্দ করতো, তা নয়। তার মূল লক্ষ্য ছিলো বন্ধু ফিলিপ হত্যার বিচার আদায়।

বইয়ের ভেতরের একটি পাতা; Image Courtesy: wikipedia.org

সমাজ-সংসার নিয়ে কখনোই তেমন ভাবতে চায়নি আন্দ্রে লুই। বড় হয়েছে গ্রাভিয়াকের জমিদারের পালক পুত্র হিসেবে। জমিদারদের বিষয়ে তুলনামূলকভাবে সুধারণাই রাখত সে। বিপ্লবী ধ্যান-ধারণা তার তেমন পছন্দ ছিলোনা কখনই কিন্তু বন্ধু ফিলিপের হত্যার পর বিচার চাইতে গিয়ে সে দেখেছে আইনের অসহায়ত্ব। তাই ঠিক করে তৃতীয় শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে যাবে সে। এখানে আবারো মাহখিকে পাবে সে, কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করে নেবে বন্ধুর রক্তের দাম।

মাহখি তুখ দাজিও সুযোগ খুঁজছিলো আন্দ্রে লুইকে বাগে পাবার। সেদিনই কেন ফিলিপের সাথে সাথে ওকেও মেরে ফেললো না, তা ভেবেই ক্ষোভে ফুঁসে উঠছিলো সে! সে সময় পার্লামেন্টে অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বসতেন ডানদিকে আর তৃতীয় শ্রেণি যাদের বলা হত, সেই শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা বসতেন বাম দিকে। পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে বামপন্থা ও ধনতান্ত্রিক রাজনীতিকে ডানপন্থা বলার ব্যাপারটা এসেছে এখান থেকেই।

পার্লামেন্টে গেলো আন্দ্রে লুই। দক্ষ বক্তা ছিলেন তাই সুনাম গড়ে উঠতে বেশি যময় লাগলো না। এদিকে শিকার ধরার জন্য ফাঁদ পাতলেন মাহখি। মিথ্যে অভিযোগে দু-দুটো ডুয়েলে লড়তে হলো আন্দ্রেকে। কিন্তু ক্ষতি হলো মাহখিরই। দুজন লোক হারালো সে। এরপর মাহখির সাথে ডুয়েলে নামলো আন্দ্রে লুই। দুজনেই তীব্র আহত হলো।

বইয়ের গল্পের অনুকরণে নির্মিত ছবির পোস্টার; Image Courtesy: italyonthisday.com

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ১৭৮৯ সাল। ফরাসি বিপ্লবের এ সময়ে গাভ্রিয়াকে নিজের পালক জমিদার কান্তন দু কার্সেদু ও তার কন্যা এলিনকে রক্ষা করতে এসে নতুন ঝামেলায় জড়িয়ে গেলো আন্দ্রে লুই।

সে সময় প্রায় সব গ্রামেই জমিদারদের ওপর আক্রমণ করছে বিপ্লবী কৃষক-শ্রমিকেরা। কিছু কিছু জমিদার প্রজাবৎসল ছিলেন। কান্তন দু কার্সেদু-ও তেমনি একজন। কিন্তু তখন এত সূক্ষ্ম বিচার করতে পারার ক্ষমতা বা মানসিক অবস্থা শ্রমিকদের ছিলোনা। অত্যাচারী বিবেচনায় প্রায় সব জমিদারদেরই বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিলো তারা। এ বিষয়টিকে সেভাবে সমর্থন করতে পারেনি আন্দ্রে লুই। তাই তাদের বাঁচানোরই সিদ্ধান্ত নেয় সে। তবে খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে মাদাম দু প্লুগোস্তেলের বাড়িতে তার আবার দেখা হয়ে যায় মাহখি দ্যু লা তুখ দাজির সাথে। এবার জীবনের চরম এক সত্য হাজির হয় ওর সামনে। এরপর ঘটনার পরিক্রমায় বিপ্লব উন্মুখ ফ্রান্স-এ কি রয়ে যেতে পারলো ও? নাকি আর সবকিছু ছাপিয়ে আন্দ্রে লুই এর জীবনে বড় হয়ে উঠলো সেই পলায়নপর স্কারামুশের চরিত্রটি-ই? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বইটির শেষে।

সেবা প্রকাশনীর বাংলা অনুবাদের প্রচ্ছদ; Image Courtesy: Feature Writer

রাফায়েল সাবাতিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক। তাঁর এই ইন্টারন্যাশনাল বেস্টসেলার বইটির দুর্দান্ত গতিশীল লেখনী পাঠককে আকৃষ্ট করে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। বইটির শেষদিকটি অবশ্য একটু বেশি নাটকীয় মনে হতে পারে। তবে সাবাতিনি লেখার সময় নির্দিষ্ট কোন পক্ষে ঝুঁকে যাননি। লিখতে চেষ্টা করেছেন আপাত মধ্যবর্তী একটি অবস্থান থেকে। এককথায় পাঠককে আকৃষ্ট করবে বইটি, ভাবনার খোরাকও যোগাবে।

Feature Image Courtesy: dustjackets.com