উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপ। অবস্থাসম্পন্ন বা জমিদার প্রকৃতির পরিবারগুলোর জমি-জমা, শান-শওকত, চাকর-বাকর কিছুরই অভাব ছিল না। এত বিত্ত-বৈভবের মাঝে বাস করতে গিয়ে তাদের মনে হয়েছিল পৃথিবীতে দুঃখ বলেই কিছু নেই! কিন্তু দুঃখ তো জীবনেরই অংশ। দুঃখ ছাড়া সুখও হয়ে পড়ে মূল্যহীন। তারা ভাবলেন এমন একটা ব্যবস্থা করা দরকার যাতে দুঃখের বিষয়টিও মাঝে মাঝে তাদের মনে পড়ে। মানে আয়োজন করে দুঃখ-দুর্দশার প্রদর্শনী আরকি! আর তাই তারা ঠিক করলেন বাগানে অলংকার হিসেবে কিছু দুঃখের প্রতীক নিয়ে আসবেন।
পাঠক, আপনারা হয়ত ভাবছেন এমন বৈভবশালীদের তো এরকম শখ-আহ্লাদ থাকেই কিছু কিছু। এত যখন সম্পদ তাদের, বাতিকেরও তাই অভাব থাকবেনা। জমিদারবাবুরা যদি দুঃখ-দুর্দশার কোন চিত্রকর্ম বা ভাস্কর্য নিয়ে এসে তাদের প্রাসাদ সাজান, তাতে আর ক্ষতি কী? দুর্দশার কথাও মনে পড়বে, আবার শিল্প-রসিক হিসেবে নিজেদের পরিচয়টাও আরও পোক্ত হবে!
কিন্তু না, তাদের ভাস্কর্য বা চিত্রকর্মে মন ভরেনি। তারা এই বিষণ্ণতা, দুর্দশা বোঝার জন্য চাইলেন জ্যান্ত মানুষ! হ্যাঁ, রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ- যারা থাকবে তাদের বাগানের অলংকার হয়ে, তীব্র আভিজাত্যের মাঝে তাদের দেবে একটু দুর্দশার অনুভূতি!

হ্যাঁ, এই মানুষগুলোই গার্ডেন হারমিট। বাগানের অলংকার। কিন্তু বিলাসের নয়, বিষণ্ণতার। উটচালকদের মত লম্বা আলখেল্লা পরা, না কামানো দীর্ঘ চুল-দাঁড়ি আর লম্বা নখ নিয়ে যারা জমিদারদের বাগানে বসবাস করতেন সবার থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে।
সাধারণত সাতবছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হতো একেকজন গার্ডেন হারমিটকে। জমিদারদের বাগানে তাদের জন্য নির্মাণ করা হতো খুব ছোট একটা ঘর। বেশিরভাগ সময়েই সেটা একটা খাঁচার চেয়ে খুব বেশি বড় হতো না। সেখানেও কোনোরকম থাকতে হতো তাদের। বিশেষত বাগানের সীমানার বাইরে যাওয়া কিংবা কারো সাথে যোগাযোগ রাখা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কখনো কখনো চাকরদের সাথে একটা-দুটো কথা বলতে পারতো তারা।
সে সময়ের বড় বড় ইংরেজি দৈনিকে গার্ডেন হারমিট চেয়ে আবেদন করা হতো। চার্লস হ্যামিলটনের লেখা এরকম একটি বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ছিল- ‘Expectation for a hermit-in-residence.’ বিজ্ঞাপনটি থেকে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা পাওয়া যায়। হারমিটদের দেয়া হতো একটি বাইবেল, চোখে পরার চশমা, মাদুর এবং বালিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্য হ্যাসোক (একরকম মোটা কুশন চার্চে ব্যবহৃত হয়), সময় দেখার জন্য ঘড়ি আর পান করার জন্য সুপেয় পানি। খাবার সরবরাহ করা হতো জমিদার বা বিত্তশালীদের বাড়ি থেকেই।

তবে শর্ত ছিল যতদিন তারা গার্ডেন হারমিট হিসেবে থাকবেন, কাটতে পারবেন না চুল–নখ–দাঁড়ি। স্নানের ব্যবস্থাও হতো বছরে অল্প কয়েকবার। পরতে হতো বড় আলখেল্লার মত পোশাক। বাগানের গাছপালা বা ফুল-ফল-সবজির পরিচর্যায় অনেক সময় কাজে লাগতেন তারা। তবে সেখান থেকে কোনকিছু গ্রহণের অধিকার তাদের ছিল না।
তাদের অনেকসময়ই ব্যবহার করা হতো অতিথিদের মনোরঞ্জনে। বিত্তবান জমিদারদের বাড়িতে নানারকম উপহার নিয়ে আসতেন তাদের অন্য সব জমিদার বন্ধু। আর তাদের সামনে নিজের সম্মানের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হতো এই গার্ডেন হারমিটদের। এত প্রাচুর্যের মাঝেও অপ্রাপ্তির, বঞ্চনার নিদর্শন হিসেবে এদের উপস্থাপন করে সম্মানিত বোধ করতেন তারা!
হারমিটদের প্রধান কর্তব্য ছিল কারো সাথে কোনরকম কথা না বলা। তারা শুধু তাদের জীর্ণ পোশাক, শীর্ণদেহ, আর জান্তব নখ-চুল নিয়ে উদভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে থাকত অতিথিদের সামনে। অতিথিরা তাদের নিয়ে নানারকম মন্তব্য করত, খাঁচায় পশু-পাখি দেখে যেমন করা হয়! তবে এতে তাদের কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখানো ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা ছিলেন শুধুই আভিজাত্য প্রদর্শনের অলংকার। অভিজাতদের জন্য সম্ভ্রান্ত বংশের স্ত্রী বা সুন্দরী রক্ষিতা যেমন ছিল সম্মানপ্রাপ্তির উপকরণ, তেমনি এই গার্ডেন হারমিটরাও ছিল তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির ডানায় নতুন পালক।

অনেকেই হারমিটের এই কাজটি করতে এসে এভাবে টিকে থাকতে না পেরে সময়ের আগেই চলে যেতে বাধ্য হতেন। তাতে করে যতটুকু অর্থ তাদের প্রাপ্য হতো, তা থেকেও বঞ্চিত হতে হতো তাদের। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারাতেন, অনেকে ঢলে পড়তেন মৃত্যুর কোলে। একজন হারমিটের জায়গা পূরণ করতো নতুন আরেকজন এসে। অনেক বিত্তশালী হারমিট না রাখলেও তৈরি করে রাখতেন তাদের থাকার ঘর। যাতে অন্যদের বোঝানো যায় হারমিট চলে গেছে, তাই ফাঁকা; আবার নতুন কেউ আসবে।
তবে যাদের ভেতরে একটু সহানুভূতি হতো, তারা মাঝে মাঝে হারমিটদের দিয়ে কৃষিকাজ করানো কিংবা পার্টিতে বারটেন্ডারের দায়িত্ব পালন করাতেন।
সময়ের পরিক্রমায় সিরামিক ইন্ড্রাস্টির বিকাশের সাথে সাথে জমিদারবাড়িগুলোতে মানুষের মূর্তি রাখার চল শুরু হয়। এছাড়া সিরামিকের তৈরি বিভিন্ন ভাস্কর্য তারা রাখতে শুরু করেন সেই দুঃখবোধের নিদর্শন হিসেবে। আর তার সাথে সাথে প্রয়োজন ফুরিয়ে আসতে থাকে বাগানের এই অলংকারকের।

এখনো কিছু কিছু জায়গায় হারমিট রাখার চল আছে। তবে তারা মূলত কৃষিকাজ, বাগানের পরিচর্যাসহ বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকেন। অন্যদের সাথে কথাও বলতে পারেন। দিনের পর দিন স্নানবিহীন থেকে, নখ-চুল বড় রেখে, এক কাপড়ে তাদের জীবন কাটাতে হয়না।
কিন্তু এককালে অভিজাতদের খেয়ালের বশে, তাদের তথাকথিত সামাজিক মর্যাদার উপকরণ হিসেবে গার্ডেন হারমিটদের ব্যবহার করা হয়েছে পণ্যের মতো। যে পশুসুলভ জীবন তাদের যাপন করতে হয়েছে, তা অভিজাততন্ত্রের এক নোংরা এবং অন্ধকার ইতিহাস হিসেবেই টিকে আছে আজও।
Feature Image Courtesy: mysterious-times.com