১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এক বিদগ্ধ জনপদের নাম বগুড়ার বাবুর পুকুর। বগুড়া থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে ইতিহাসের স্বাক্ষী হিসেবে অবস্থান করছে ঐতিহাসিক এই বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর এখানেই সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। তাই ১১ নভেম্বর এখনো বগুড়া জেলায় ‘বাবুর পুকুর গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের তিতখুর নামক স্থানে তিতখুর মৌজার ৫৮০ দাগের ৩ শতক জায়গার উপরে ১৪টি কবর এবং ১২ শতকের উপর স্মৃতিস্তম্ভের বেদি নির্মান করা হয়েছে।
বিদগ্ধ সেই রজনী
দিনটি ছিল ১১ নভেম্বর, ১৯৭১। রমজান মাস। ঘরে ঘরে সেহরির প্রস্তুতি চলছিল, ২১ রমজানের রাত।
সেদিন বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া, শাহপাড়া, তেঁতুলতলা, হাজিপাড়া ও পশারীপাড়ায় রেডএলার্ট জারি করেছিল পাক হানাদার বাহিনী। এদেশীয় পাকবাহিনীর দোসর শান্তি কমিটি নামে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধ চক্রের তালিকা অনুযায়ী ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর সেনা কনভয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বাবুর পুকুরে। এরপর ফজরের আযানের পূর্বে বীর বাঙালির গর্বিত সন্তানদের সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। হানাদার বাহিনীর সেই পাশবিক হত্যাযজ্ঞে মাতৃভূমির কোলে নুয়ে পড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এতেই ক্ষান্ত হয়নি বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শহীদদের নিথর শরীরের ওপরও চালানো হয় নির্মম নিষ্ঠুরতা। এক সময় নিথর দেহ ফেলে রেখে চলে যায় বর্বর পাক হানাদার বাহিনী।
ব্রাশ ফায়ারের ফলে তাদের রক্ত মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে আশেপাশের গাছের ডালেও ঝুলতে দেখা যায়। পরে ভোরবেলা শহীদদের কবর দিয়েছিলেন স্থানীয় আলাউদ্দিন মাষ্টার নামে এক ব্যক্তি।

১৪ শহীদের তালিকা
১। হান্নান পশারী;
২। মান্নান পশারী;
৩। ওয়াজেদুর রহমান টুকু;
৪। জামাল ম-ল;
৫। মন্টু ম-ল;
৬। আব্দুস সবুর ভোলা ম-ল;
৭। সাইফুল ইসলাম;
৮। আলতাফ আলী;
৯। বাদশা শেখ;
১০। বাচ্চু শেখ;
১১। ফজলুল হক খান;
১২। নূর জাহান লক্ষী;
১৩। আবুল হোসেন;
১৪। (অজ্ঞাতনামা)

মেলেনি স্বীকৃতি
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও স্বীকৃতি পায়নি গণকবরে শায়িত ১৪ শহীদের পরিবার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ অবধি বিভিন্ন জনের কাছে ধরণা দিয়ে ব্যর্থ হয়েও এখনো আশা ছাড়েননি শহীদ পরিবারের স্বজনেরা। কবে মিলবে এই মহান আত্মত্যাগের স্বীকৃতি? আদৌ মিলবে কি?
শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে পদক্ষেপ
স্থানীয় তিতখুর গ্রামের মহানুভব ব্যক্তি আলতাফ হোসেন, এ্যাড. আফতাব উদ্দিন, এ্যাড. রাশেদুর রহমান মরিস, আলাউদ্দিন মাষ্টার ১৫ শতাংশ জমি শহীদদের স্মরনীয় করে রাখার জন্য স্মৃতিস্তম্ভের নামে দান করেছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অব্যাহত দাবীর প্রেক্ষিতে বগুড়ার বাবুর পুকুরে আত্মদানকারী ১৪ শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৮ বছর পর অবশেষে নির্মান হয়েছে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ ‘বিমূর্ত পাজর’।
১৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে বগুড়া জেলা পরিষদ ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ৩২ লক্ষ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়। উক্ত প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২২ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকার একটি পরিকল্পনা প্রাথমিক ভাবে বাস্তবায়ন করছে বগুড়া জেলা পরিষদ। শহীদ স্মৃতি স্তম্ভের স্মারক ভাস্কর্যটির নকশা অঙ্কন করেছেন রংপুরের ভাস্কর অনিক রেজা। উক্ত স্মৃতি স্তম্ভটিকে ভাস্কর দেখিয়েছেন, শহীদদের বুকের পাজরের আদলে নির্মান করা সুউচ্চ বেদির গায়ে মেশিনগানের গুলির ২৮টি ছিদ্র চিহ্নসহ একটি বিমূর্ত শিল্পকর্ম হিসেবে।

যেখানে ১৪ জন শহীদদের জন্য দু’টি করে ছিদ্র এবং তাদের বক্ষে দেশাত্ববোধের চেতনায় লেখা-
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি, চিনে নিক দুর্বৃত্তরা;
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম;
আবার আসিব ফিরে ধান সিড়িটির তীরে এই বাংলায়;
জাগো বাহে কোনঠে সবায়;
জয়বাংলা বাংলার জয়;
মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা;
ও আমার দেশের মাটি তোমার তরে ঠেকায় মাথা, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি;
এরকম অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ও স্লোগান।

১৪ জন শহীদের পুর্ব পশ্চিম দিকের সারিবদ্ধ কবরকে সম্পৃক্ত করে মূল অবকাঠামো নির্মান করা হয়েছে। মোট ৭৫ ফুট প্লাটফর্মের পুর্বাংশে ২৫ ফুট উঁচু বেদী রাখা হয়েছে। আর স্মৃতি স্তম্ভের পশ্চিমাংশে বগুড়া-নাটোর মহাসড়ক। স্মৃতিস্তম্ভটি এমন ভাবে নির্মান করা হয়েছে যেন রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারীরা খুব সহজেই এটি দেখতে পায়।
সারিবদ্ধ কবরের উত্তর পার্শে লাল রং এর টাইলস বসানোর পরিকল্পনা থাকলেও বর্তমানে লাল রং দিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। টাইলস বসানো হলে লেকের উত্তর পাশ থেকে পানির প্রতিফলন লাল টাইলসে এসে পড়লে রক্ত আভা দৃশমান হবে। এতে দূর থেকে মনে হবে শহীদদের কবর থেকে লাল রক্ত লেকে প্রবাহিত হচ্ছে।
বেদির দক্ষিনে পুকুরের ৩ পাশেই ৫ ফুট প্রস্থ সরু লেন তৈরি করা হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভের দর্শনার্থীরা যেন কিছুটা আয়াশের সাথে সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। পুকুরের জলের স্পর্শ অনুভব করার জন্য প্লাটফর্ম থেকে পুকুরের জলসীমা পর্যন্ত সিড়ি বাঁধানো হয়েছে। সেই সাথে বগুড়া-নাটোর প্রধান সড়ক থেকে একটি লেন প্লাটফর্মের মাধ্যমে বেদী মূলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বগুড়ায় সরকারীভাবে বাবুর পুকুর বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হলেও সঠিক সংরক্ষনের অভাবে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বধ্যভূমিটি সংরক্ষনের জন্য চারদিকে গ্রীল দিয়ে ঘিরে নিরাপদ রাখলেও শুধু ছোট দুইটি দরজা খোলা থাকায় বধ্যভূমিটি এখন যুবক যুবতীদের প্রেমকুঞ্জে পরিণত হয়েছে। মাদক সেবীদের অভয়রাণ্য হিসেবে এবং অসামাজিক কাজকর্মের স্থান হিসেবে বধ্যভূমিটি এখন চিহ্নিত হয়েছে। বধ্যভূমির মূল অংশের পিছনে মাদক সেবীদের নিরাপদ স্থান হওয়ায় সেখানে দিন রাত অবাধে চলে মাদক সেবীদের জমজমাট আড্ডা।
মানুষের যাতায়াতের ছোট দরজাটি সারাবছরই খোলা থাকায় মানুষ, কুকুর, ছাগল অবাধে চলাফেরা করে। আর এই অবাধ চলাফেরায় বধ্যভুমির বেদি সব সময়ের জন্য থাকে অপরিচ্ছন্ন। খরনা ইউনিয়নের ৩টি গ্রামের লোকজন এই বেদির উপর দিয়ে প্রতিনিয়ত জুতা স্যান্ডেল পরে যাতায়াত করে থাকে। আশপাশের জমি থেকে গরু, ছাগল মূল বেদির উপর উঠে বধ্যভূমির পরিবেশ একেবারেই নষ্ট করছে। এছাড়াও তিতখুর গ্রামের ছোট শিশুদের খেলার নিরাপদ স্থান হিসেবে এই বধ্যভূমির মূল বেদিটিই ব্যবহৃত হচ্ছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বধ্যভূমিতে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভের উত্তর পার্শ্বে একটি নন্দন লেক তৈরির কথা থাকলেও এখনো সেই কাজে হাত পরেনি। এক কথায় পবিত্র এই ভূমির নানান দৈন্যদশা দেখে শঙ্কিত সচেতন বগুড়াবাসী।
Feature Image Courtesy: Mohammad Raihan