হাসির রাজা, জ্ঞানের রাজা, বুদ্ধির রাজা, রসিক রাজা প্রভৃতি সম্ভাসনে সম্মোধিত গোপাল ভাঁড় চরিত্রটি ছোট বড় সকলের কাছেই ব্যাপক জনপ্রিয়।
কিন্তু বাস্তবিকভাবে কে এই গোপাল ভাঁড়? আদৌ গোপাল ভাঁড় নামে কি কেউ ছিলেন নাকি এটা মানুষের কল্পিত কোনো চরিত্র সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
বর্তমান সময়ে ভারতীয় টিভি চ্যানেল ‘সনি আট’ এর অন্যতম জনপ্রিয় একটি সিরিজ হচ্ছে ‘গোপাল ভাঁড়’। সিরিজটি বাচ্চাদেরকে শিক্ষামূলক বিনোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে এটি সকল বয়সের মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
সিরিজটির প্রধান চরিত্র গোপাল ভাঁড়। তিনি তার বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে অসামান্য পান্ডিত্য ও চতুরতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, যা খুব সহজেই দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে কার্টুন সিরিজ তৈরির পূর্বে বিভিন্ন গল্পের বইয়ে তার পান্ডিত্য, চাতুর্য, হাস্যরসিকতা ও ভোজনবিলাস নিয়েও বহুল আলোচনা হয়েছে।
গোপাল ভাঁড় চরিত্রটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় একটি ঐতিহাসিক ব্যাক্তি। তাকে হাসির রাজা এবং জ্ঞানের রাজা বলেও সম্বোধন করা হয়। গোপাল ভাঁড়ের পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কৌতুকপূর্ণ অনেক গল্প প্রচলিত আছে।
গোপাল ভাঁড় জনপ্রিয় চরিত্র হলেও তার বিষয়ে খুব বেশিকিছু জানা যায় নি।
ঐতিহাসিক গবেষণা অনুযায়ী, গোপাল ভাঁড় ছিলেন মধ্যযুগের নদীয়া অঞ্চলের একজন প্রখ্যাত রম্য গল্পকার ভাঁড় ও মনোরঞ্জনকারী। তার আসল নাম গোপালচন্দ্র প্রামাণিক। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়া জেলার প্রখ্যাত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় নিযুক্ত ছিলেন। রাজা তাকে তার সভাসদদের মধ্যকার নবরত্নদের একজন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সেই আমলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদের সামনে নির্মিত তার একটি ভাস্কর্য এখনো সেখানে অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। পরবর্তীতে কৃষ্ণনগর পৌরসভার সীমানায় ঘূর্ণীতে গোপাল ভাঁড়ের নতুন মূর্তি স্থাপিত হয়েছে।
প্রায় দুইশত বছরেরও অধিক সময়কাল ধরে প্রচলিত তার জীবন-রস সমৃদ্ধ গল্পগুলো পশ্চিমবঙ্গের ও বাংলাদেশের বাংলাভাষী মানুষের মাঝে লোককথায় এখনো স্বমহিমায় টিকে আছে। কতগুলি গল্পপ্রায় প্রবাদের ন্যায় ব্যাবহৃত হয়।
গোপাল ভাঁড় চরিত্রটি ঐতিহাসিক গবেষক ও ভাষাবিদদের কাছে বিতর্কের বিষয় বহুকাল থেকেই। গোপালের গল্পগুলো সমাজে চুড়ান্ত জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত হলেও গোপাল ভাঁড় বাস্তবে ছিলেন কিনা সে নিয়ে মতভেদ আছে। অনেকে মনে করেন গোপাল ভাঁড় নামে নির্দিষ্ট করে কেউ ছিলেন না। তবে কোনো না কোনো বিদূষক রাজার প্রিয়পাত্র হন। সে গোপাল নাম্নী নাপিত বংশীয় কোনো ব্যাক্তি ছিলেন।
গোপালের জন্ম কত বঙ্গাব্দে তা কোথাও লেখা নেই। তার জন্মস্থানের পক্ষেও কোনো নথি নেই। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা হিসেবে সম্পত্তির কিংবা জায়গা জমির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। গোপালের বাবার নাম জানা গেলেও তার মা ও স্ত্রী সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি।
নগেন্দ্রনাথ দাসের মতে গোপালের পদবী ছিল ‘নাই’। মহারাজ তাকে ‘হাস্যার্ণব’ উপাধি দান করেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও ভাষাবিদ সুকুমার সেন বলেছেন গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আধুনিক বাঙালির কৌতুহল থাকার ফলে বাস্তব অথবা কল্পিত ব্যাক্তিটির সম্পর্কে যে জনশ্রুতি গজিয়ে উঠেছে ও উঠছে তার বীজ হচ্ছে ‘ভাঁড়’ নামের অংশটি। গোপাল ভাঁড়ের ভাঁড় অংশটুকু সংস্কৃত শব্দ ভান্ডারের। ‘ভান্ড’- জাত মনে করে অনেকে গোপালের জাতি নির্ণয় করেছেন। পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তি যাইহোক গোপাল ভাঁড় বাঙালি রসিক ও লৌকিক সংস্কৃতিতে অমলিন হয়ে আছেন।
গোপাল অন্তর্ধান নিয়েও একটি জনশ্রুতি আছে। জনশ্রুতি অনযায়ী ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলা যখন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হিসেবে ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন তখন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করেছে তারই বিশ্বাসভাজন আত্মীয়বর্গ ও সভাসদগন। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও শর্তসাপেক্ষে ইংরেজদের সাথে হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নবাব বিরোধী ষড়যন্ত্রে। রাজসভার অন্যান্য সভাসদ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে নবাব বিরোধী ষড়যন্ত্রে সমর্থন করলেও গোপাল তার তীব্র বিরোধিতা করে। সে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে বোঝানোর চেষ্টা করে ইংরেজদের স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেলে রূপ বদলে ফেলবে। গোপালের কথা শুনে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাকে অদ্ভুত এক শর্ত দেন। রাজা গোপালকে বলে সে যদি মুর্শিবাদে গিয়ে নবাবকে ভেংচি দিয়ে আসতে পারে তবে রাজা ইংরেজদের সাথে হাত মেলাবেন না।
গোপাল রাজার শর্ত মানতে মুর্শিবাদের দিকে রওনা হয় নবাবকে ভেংচি দিতে। কিন্তু গোপালকে ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত হাঁড়িঝিল প্রাসাদে ঢুকতে বাঁধা দেওয়া হয়। গোপাল তখন প্রাসাদের প্রহরীর হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। প্রহরীকে কামড় দেওয়ার অপরাধে গোপালকে বন্দী করে নবাবের সামনে হাজির করা হয়। নবাব গোপালকে প্রহরীকে কামড় দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে গোপাল কোনো উত্তর না দিয়ে নবাবকে ভেংচি কাটে। নবাব গোপালকে আটক করার নির্দেশ দিয়ে বলেন আগামীকাল তার বিচার করবেন। কারাগারে গোপাল মীরজাফরকে বলে, “আমি মুর্শিবাদে এসেছিলাম তোমাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে। কিন্তু সেটা করলে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ফেঁসে যাবেন, নবাব কৃষ্ণচন্দ্রকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসাবেন। আর আমি চাই না কৃষ্ণচন্দ্র তার ক্ষমতা হারাক।”
গোপালের কথা শুনে মীরজাফর ঘাবড়ে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে নবাবকে দিয়ে গোপালের ফাঁসি কার্যকর করায়। কিন্তু গোপালকে ফাঁসি দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় গোপাল আবার নবাবকে ভেংচি কাটে। তখন নবাব বলে, “একে কি ফাঁসি দেব, এ তো পাগল”! নবাব গোপালকে ছেড়ে দিলে সে কৃষ্ণনগরে ফিরে আসে। গোপাল শর্তপূরণ করে ফিরে আসার পরেও রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। রাজার এরুপ আচরণে গোপাল মনঃক্ষুণ্ন হয়ে স্বপরিবারে কৃষ্ণনগর ত্যাগ করেন। তারপর থেকে সবার প্রিয় গোপাল ভাঁড়কে আর কখনো এই বাংলায় দেখা যায় নি।
উনিশ শতকের প্রথম দিককার বটতলা সাহিত্যে গোপাল ভাঁড়ের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলার ইতিহাস এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসেও অল্প হলেও দেখা যায় সমষ্টিগতভাবে জনগণের উপস্থিত বুদ্ধি ও জ্ঞান কোনো একজন অতীত লোকের নামে প্রচলিত আছে এবং কালক্রমে তিনি জনগনের মধ্যে হিরো হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
গোপাল ভাঁড় হয়তো এমনি এক কাল্পনিক ব্যাক্তিত্ব। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দেহরক্ষক হিসেবে ‘শঙ্কর তরঙ্গ’ নামে এক ব্যাক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। তার সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি ও জ্ঞানের জন্য রাজা তাকে বিশেষ মর্যাদা দিতেন। হয়তো তিনিই পরবর্তীকালের গোপাল ভাঁড়। তবে কাল্পনিক বা বাস্তব যাইহোক গোপাল ভাঁড় বাংলা লোকসাহিত্যের একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব।
Feature Image Courtesy: kalerkantho.com