“The Pakistani army has attacked police lines at Rajarbag and East Pakistan Rifle Headquarters at Pilkhana at midnight. Gather strength to resist and prepare for war of independence.” MASSACRE by Robert Payne (Page 24) The Macmillan Company New York. (পাকিস্তান সামরিক বাহিনী মাঝরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। প্রতিরোধ করবার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন) ‘ম্যাসাকার’ রবার্টপেইন (পৃষ্ঠা ২৪) : দি ম্যাকমিলান কোম্পানি, নিউইয়র্ক।
২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানিয়ে তার এই সর্বশেষ বাণী প্রেরণ করেন তখন ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৬ শে মার্চ শুরু হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পরে আর কী করণীয় তা নির্ধারিত হয়ে যায়। করণীয় ঠিক হলেও তখন তিন মতভেদের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রথম শ্রেণীর যারা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নির্দেশনার আশায় বসেছিলেন। আরেক শ্রেণি যারা ধরে নিয়েছিল এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এছাড়া এমন একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছিল যারা নিজ উদ্যোগে তখনই পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাদেরই একজন ছিলেন এই হেমায়েত উদ্দিন। যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলেন বিশাল বাহিনী; যারা দাপিয়ে বেড়াতো বাংলার বুক। যাদের ভয়ে তটস্থ থাকতো পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। হেমায়েত উদ্দিন এর নাম অনুসারেই বাহিনীর নামকরণ করা হয় হেমায়েত বাহিনী। এই বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর ফরিদপুর ও বরিশালের উত্তরাঞ্চল জুড়ে।
হেমায়েত উদ্দিনের জন্ম ১৯৪১ সালের ৩ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার টুপুরিয়া গ্রামে। পড়াশোনা শেষ করে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান আর্মিতে একজন সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। একাত্তরের উত্তাল মার্চে তিনি সরকারি ছুটিতে ছিলেন। ২৫ শে মার্চে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাপুরুষপ্রবণ ও বর্বর আক্রমণের ঘটনা দেখে তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। ঠিক করে ফেলেন তার করণীয়। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

এজন্য হেমায়েত উদ্দিন দুই তিনদিনের চেষ্টায় ২০/২২ জন সাধারণ সৈনিককে সাথে নিয়ে ২৯ মার্চ জয়দেবপুর সেনানিবাসে এক বিদ্রোহ করে বসেন এবং তাদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে তিনি নিজ এলাকায় চলে যান। ২৮ এপ্রিল তিনি নিজ এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ফিরে আসেন। কোটালীপাড়ায় আসলে স্থানীয় রাজাকাররা তাকে আত্মসমর্পণ করার জন্য বললে তিনি তা অস্বীকার করেন। রাজাকাররা তার বাড়ি জ্বালিয়ে দেন ও তার স্ত্রীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। তিনি এসময় পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ঠাঁই নেয়। ধীরে ধীরে তিনি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন এবং ট্রেনিং দেয়া শুরু করেন। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাবের জন্য প্রায় সকলকেই গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হতো। তবু যে কয়টি আধুনিক অস্ত্র ছিল তা দিয়ে সকলকে অস্ত্রচালনার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।

কোটালীপাড়ার জহরেরকান্দি হাইস্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই বাহিনীটি বিশাল আকার ধারণ করে। জহরেরকান্দি ট্রেনিং সেন্টারের প্রধান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ওয়ারেন্ট অফিসার জোবেদ আলী শেখ ও চিফ ইন্সপেক্টর ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কোরের আবদুল খালেক। এছাড়াও প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ছিলেন বেশ কিছু বাঙালি আর্মি, প্রাক্তন ইপিআর ও পুলিশ সদস্য। বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত বিলবাগিয়ায় প্রথম ঘাঁটি স্থাপন করে হেমায়েত বাহিনী। পরে ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিম দিকে পয়সারহাটের উত্তরে রাজাপুর নামক গ্রামে তিনি সদর দপ্তর স্থাপন করেন।
হেমায়েত বাহিনীতে সর্বমোট মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৫৫৫৮ জন। সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার স্বার্থে এ বাহিনীকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেকটি গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন একেকজন গ্রুপ কমান্ডার। বরিশালের উজিরপুর, গৌরনদীথানা, ফরিদপুরের কালকিনি, মাদারীপুর, রাজৈর, গোপালগঞ্জ, কোটালীপাড়া, মুকসুদপুর, কাশিয়ানী এবং খুলনার মোল্লারহাট থানার অংশবিশেষ ছিল হেমায়েত বাহিনীর যুদ্ধক্ষেত্র।

২৯ মার্চ জয়দেবপুর থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্র নিয়ে তিনি ২১ এপ্রিল ফরিদপুর থানা আক্রমণ করেন এবং অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রলুণ্ঠন করেন। ধারণা করা হয়, এটি ছিল হেমায়েত বাহিনীর প্রথম অপারেশন। ২৮ এপ্রিল তিনি গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া আক্রমণ করেন। আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে বন্দী থাকা ৩৬ জন আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীকে মুক্ত করেন। ৫ই মে হেমায়েত বাহিনী কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে দখল নেয়। কিন্তু ঢাকা থেকে ৭ই মে বিপুল পরিমাণ পাকিস্তানী সৈন্য এসে পুনরায় থানাটি দখল নেয়। ৯ই মে পুনরায় হেমায়েত বাহিনী কোটালীপাড়া থানা দখল করে।
বিজয়ের আগ পর্যন্ত এই বাহিনী পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মোট ছোট-বড় ১০৮টি অভিযান সম্পন্ন করে। হেমায়েত বাহিনীর কাছে কোটালীপাড়া, বরিশালের গৌর নদী ও যশোরের কালিয়া থানায় পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে হেমায়েত বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ এর খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী গোপালগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সকলের কাছে অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান জানালে হেমায়েত বাহিনী সরাসরি বঙ্গবন্ধুর নিকট অস্ত্র জমা দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরবিক্রম উপাধি দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর এই মহান মুক্তিযোদ্ধা পরলোকগমন করেন।

তবে হেমায়েত উদ্দিন; কমলেশবেদজ্ঞ, ওয়ালিউর রহমান সহ চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। কমলেশ বেদজ্ঞ মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। হেমায়েত উদ্দিন আহত হওয়ার পর তিনিই এই বাহিনী দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। ওয়ালিউর রহমান ছিলেন ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধের সমন্বয়কারী। ১৯৭৩ সালের ১০ মার্চ হেমায়েত তার সহযোগীদের নিয়ে কমলেশ বেদজ্ঞ, ওয়ালিউর রহমান সহ চারজন মহান মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পর গণবিক্ষোভ ও বিচারের হাত থেকে বাঁচতে হেমায়েত উদ্দিন পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় নেন। রাজনৈতিক জার্সি পাল্টিয়েছেন বারবার।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে হেমায়েত উদ্দিন এর বিভিন্ন কর্মকান্ড তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও স্বাধীনতার সময় একজন দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামী বাঙালি সৈন্য হিসেবে তার যা করণীয় ছিল তিনি তা করেছেন। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বরের পর কে কী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন সেটা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হতে পারে। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বর এর স্বাধীনতা লাভের মুহূর্ত পর্যন্ত গুটিকয়েক হাতে গোনা লোক ছাড়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ছিল স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত একটা নতুন জাতি। সবাই এক ও অভিন্ন।
Feature Image Courtesy: kalerkantho.com