একটি জাতির ইতিহাস- ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসেবে খাদ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবার ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো বিশ্বব্যাপী। এই আধুনিক যুগে আমরা এক দেশে বসেই উপভোগ করতে পারি আরেক দেশের জানা অজানা নানান খাবার। জানা কিংবা অজানা হোক; এই নানান কিসিমের খাবার কিংবা রেসিপির নামকরণের পিছনেও রয়েছে অদ্ভুত ইতিহাস কিংবা মজার সব গল্প। আজ আমরা দেখবো এমনি কিছু জনপ্রিয় খাবারের নামের ইতিহাস।
হ্যামবার্গার
রান্না করা মাংসের স্বাদ নিতে শুরু করেছে মানুষ প্রায় ৮০০ বছর হলো। তবে দুই বানের ভেতর মাংসের প্যাটি বসিয়ে বার্গার আবিষ্কার বলতে গেলে আধুনিক ধারণাই। পৃথিবীজুড়ে নানান কিসিমের বার্গারের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো হ্যামবার্গার। ছেলে বুড়ো সবাই আদতে এই বার্গারের নাম শুনে এসেছে।
এই বার্গারের নামকরণ হয়েছে জার্মানির হ্যামবুর্গ শহর থেকে। উনিশ শতকে রাশিয়ার বাল্টিক অঞ্চলে সর্বপ্রথম জার্মান নাবিকেরা এই বার্গারের সন্ধান পান। সেই ধারণাটি পুঁজি করে তারা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় এই খাবার। বলা বাহুল্য, জার্মানির হ্যামবুর্গ শহর থেকেই খ্যাতি পাওয়া শুরু এর।
বারবিকিউ
বারবিকিউ কে না চেনে? কিন্তু এই সুস্বাদু খাবারের নাম বারবিকিউই বা কেন হলো? তা নিয়ে যদিও নানান মতভেদ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু থিওরি বেশ জনপ্রিয়- অনেকের মতে ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘দে বারবে আ কিউ’ থেকে এসেছে এই নাম। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ফ্রম বিয়ার্ড টু টেইল’। আবার কারো কারো ভাষ্যমতে নামটির উৎপত্তি উনিশ শতকে নর্থ ক্যারোলিনার এক বিজ্ঞাপন থেকে।
সেই সময় এক বারের বিজ্ঞাপনে কোম্পানি বিনামূল্যে হুইস্কি, বিয়ার, বিলিয়ার্ডস ও রোস্ট করা শূকরের অফার দিয়েছিল। তা আবার সংক্ষেপ করে এক গালভরা নাম দিয়েছিল ‘বার-বিয়ার-কিউ-পিগ’। বলা হয়ে থাকে তখন থেকেই এই নামের প্রচলন। তবে স্থানীয় আমেরিকান ও ক্যারাবীয়দের মতে নামটি এসেছে স্প্যানিস ভাষা থেকে। স্প্যানিশে ‘বারবাকোয়া’ শব্দটির মানে হলো ‘পবিত্র কয়লার আগুন’। আর যেহেতু বারবিকিউ মানেই সেখানে প্রয়োজন কয়লা তাই তারা মনে করেন বারবিকিউর উৎপত্তি এই শব্দটি থেকেই।
রুবেন স্যান্ডউইচ
রুবেন এক ধরনের স্যান্ডউইচ। যদিও রুবেনের উৎপত্তি নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। তবে বেশিরভাগের মতে এই স্যান্ডউইচটি ১৯২০ দশকের দিকে প্রথম দেখা যায়। সেই সময় নেব্রাস্কার হোটেল ওমাহার প্রধান শেফ ছিলেন বার্নার্ড শিমেল। একদিন কিছু পোকার খেলোয়াড় সেখানে এসে কিছু স্ন্যাকস চাইলে শিমেল কর্নড বিফ দিয়ে এক নতুন ধরনের স্যান্ডউইচ তৈরী করে দেন।
ভাগ্যক্রমে যে খেলোয়াড়কে প্রথম খাবারটি পরিবেশন করেন তার নাম ছিলো রুবেন কুলাকোফস্কি! রুবেনের বেশ ভালো লেগে যায় নতুন ঘরানার এই স্যান্ডউইচটি। আর তার নামেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই রেসিপিটি।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই
বেশিরভাগ মানুষই হয়তো ভেবে থাকেন যে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের উদ্ভাবন আদতে ফ্রেঞ্চদের হাতে। তবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর মতে সর্বপ্রথম ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের দেখা মিলেছিল বেলজিয়ামে। সেখানে মিউস নদীর তীরে দীর্ঘ শীতের রাতে জেলেরা মাছের অভাবে আলু ফ্রাই করে খেতে শুরু করে।
আমেরিকান সৈন্যরা এই খাবারের সন্ধান পায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে। তারা এর সন্ধান পেয়েছিল ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা কিছু বেলজিয়ান সৈন্যদের থেকে। ভুলক্রমে তারা ভেবে নেয় খাবারটির আগমন ফ্রান্স থেকেই, যেহেতু সৈন্যেরা ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলছিল। সেই থেকে আমেরিকানরা এই খাবারের নামকরণ করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।
সালিসবারি স্টেক
স্টেকের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো সালিসবারি স্টেক। এই নামকরণের পিছনে রয়েছে একজন মানুষ, ডক্টর জেমস হেনরি সালিসবারি। উনিশ শতকে তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। গৃহযুদ্ধের সময়ে সৈন্যদের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। সেই সময়ে সালিসবারি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য এক ধরনের স্টেক রান্না করতেন। আলু ও গ্রেভির মিশ্রণে সেই স্টেক আক্রান্ত রোগীদের জন্য বেশ উপাদেয়ও ছিলো।
তারও তিন দশক পর যুদ্ধ শেষে নিজের এক বইয়ে সালিসবারি দাবী করেন তার উপায়ে রান্না করা স্টেক কানেক্টিভ টিস্যুর জন্য উপকারী এবং এটি সহজে পরিপাকসাধ্য। সেই থেকে সালিসবারি স্টেকের জনপ্রিয়তা হুহু করে বেড়েই চলছে।
নাচোস
নাচোস সর্বপ্রথম দেখা যায় ১৯৪৩ সালে। মেক্সিকোর ছোট্ট এক শহর পেদ্রাস নেগ্রাসে। টাইমের মতে সেই সময় একদল মিলিটারীর স্ত্রী পেদ্রাস নেগ্রাসে আসে কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। কেনাকাটা শেষে তারা খেয়াল করে যে প্রায় সব রেস্টুরেন্টই বন্ধ।
সেই সময়ে হন্যে হয়ে খুঁজে, ভিক্টোরি ক্লাবের সামনের রেস্টুরেন্টে তারা এক নারীর দেখা পায়। ইগনাসিও নাচো নামের এ মহিলা জানায় তার কাছে বাকি যা উপাদান আছে তাই দিয়ে সে এক ধরনের খাবার তৈরী করে দিতে সক্ষম। খাবার পরিবেশন শেষে যখন নাচো দেখলো সব মহিলাই তার খাবার দারুণ পছন্দ করেছে তখনই রেস্টুরেন্টের মেন্যু কার্ডে নিজের নামে নামকরণ করে খাবারটি লিখে দেন তিনি। আর খাবারের নাম যে নাচোস ছিলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ডোনাট
ডোনাট বেশ জনপ্রিয় এক খাবার। তবে আর বাকি সব খাবারের মতো ডোনাট নামকরণে এত জটিলতা নেই। খুব সহজেই খেয়াল করলে বুঝতে পারা যায় এই নামকরণের স্বার্থকতা।
বাফেলো উইংস
আপনার মনে কি কখনো প্রশ্ন জেগেছে যে চিকেন দিয়ে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও এর নাম কেনো বাফেলো উইংস? আসলে এই খাবারের নাম এর পেছনে রয়েছে এক স্থানের নাম।
১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কের বাফেলোতে সর্বপ্রথম এই খাবার দেখা যায়। টাইমের মতে মুরগীর অন্যান্য অংশের এক শিপমেন্টের বদলে সেই রেস্টুরেন্টে পাঠানো হয় মুরগীর উইংস। উপায়ন্তর না দেখে মালিক টেরেসা বেলেসিমো নিজেই একটি রেসিপি আবিষ্কার করে ফেলেন। সেই থেকে বাফেলো উইংস এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
Feature Image: wp.com