১৯৭১ সালের ১৩ জুন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমেরিকার জনগণ একটি বড়সড় ধাক্কা খেলো। সেদিনকার দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা’র প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছাপা হলো কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার জনগণকে এতদিন মিথ্যের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখেছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে। গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে যে যুদ্ধে আমেরিকার এতো এতো তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছিল, সেই যুদ্ধে জেতার কোনো সম্ভাবনা ছিল না জেনেও মার্কিন প্রশাসন ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। গোপন নথির সূত্র ধরে সাংবাদিক নিল শিহ্যানের করা এই এক্সক্লুসিভ রিপোর্টের পর স্বভাবতই সারা আমেরিকায় এবং পুরো দুনিয়ায় হইচই পড়ে যায়। বিব্রত হয় নিক্সন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ দানা বেধে ওঠে। কিন্তু কী করে এই ভেতরের খবর খুঁজে পেলেন নিল শিহ্যান? কী ছিল সেই সব ফাঁস হওয়া নথিপত্রে? জানুন এই লেখায়।
পেন্টাগন পেপার্স কী?
১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব রবার্ট এস. ম্যাকনামারা একটি গবেষণা প্রকল্প চালু করেন। বিষয় ছিল ১৯৪৫ সাল পরবর্তী সময়ে গৃহীত মার্কিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহের বিশ্লেষণ। যেসব বৈদেশিক নীতির কারণে মার্কিন সরকারকে ভিয়েতনামে এত গভীরভাবে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল সেগুলোর পেছনের কারণ খুঁজে বের করাও ছিল এই প্রকল্পের অংশ। ওই বছরের জুন মাস থেকে কাজ শুরু করে টাস্কফোর্সটি।
ভিয়েতনাম স্টাডি টাস্কফোর্স নামের এই প্রকল্পের নেতৃত্বে ছিলেন প্রতিরক্ষা বিভাগের পলিসি প্ল্যানিং অ্যান্ড আর্মস কন্ট্রোল ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সডিভিশনের পরিচালক লেসলি এইচ. গেল্ব। এই গবেষণা দলটিতে ছিলেন ৩৬ জনের মতো সামরিক ব্যক্তিবর্গ, ইতিহাসবিদ, র্যান্ড কর্পোরেশন (RAND Corporation) ও ওয়াশিংটন ইন্সিটিউট অফ ডিফেন্স অ্যানালাইসিস-এর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। দেড় বছরের গবেষণা ও বিশ্লেষণের পর দলটি প্রায় ৪৭ খণ্ডের, ৭০০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তৈরি করে। ইউনাইটেড স্টেটস-ভিয়েতনাম রিলেশনস, ১৯৪৫-১৯৬৭ শিরোনামের প্রতিবেদনটির ৩০০০ পৃষ্ঠা ছিল মূল নথিপত্র এবং বাকি ৪০০০ পৃষ্ঠা ছিল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এই প্রতিবেদনটিই পরবর্তী সময়ে পেন্টাগন পেপার্স নামে পরিচিতি লাভ করে।
কী ছিল পেপার্স–এ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, নীতিমালা, টপ-সিক্রেট ডকুমেন্টস, ক্লাসিফায়েড তথ্য ইত্যাদিতে ভরপুর থাকার পাশাপাশি পেন্টাগন পেপার্স-এ আরও ছিল কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারগুলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে জনগণের কাছে তথ্য লুকিয়েছে বা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করেছে। শুধু নিক্সন সরকার নয়, তার আগের হ্যারি এস. ট্রুমান থেকে লিন্ডসে বি. জনসন – সব সরকারই ভিয়েতনাম যুদ্ধের আসল রূপ থেকে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুন মাসের ১৩ তারিখ সবাইকে চমকে দিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ওই প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ হয়ে যায়। আর এই দুর্ধর্ষ কাজটি করেছেন ড্যানিয়েল এলসবার্গ। তিনিই গোপন নথিগুলো চুরি করে সাংবাদিক শিহ্যানের হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু কেন করেছেন তিনি এই কাজ? কে এই ড্যান এলসবার্গ?
ড্যানিয়েল ‘বিভীষণ’ এলসবার্গ
ড্যানিয়েল এলসবার্গের জন্ম ১৯৩১ সালের ০৭ এপ্রিল, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অর্থনীতিতে বি.এ. ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ইউএস মেরিন কোরের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি র্যান্ড কর্পোরেশনে (একটি অলাভজনক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক) একজন কৌশলগত বিশ্লেষক হিসেবে যোগদান করেন। কর্মজীবনে ১৯৬২ সালে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এলসবার্গ।
১৯৬৪ সালে র্যান্ড ছেড়ে প্রতিরক্ষা দপ্তরে যোগ দেন এলসবার্গ। সেখানে তার কাজ ছিল ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর কাজকারবার বিশ্লেষণ। পরের বছর স্বরাষ্ট্র দপ্তরে তাকে স্থানান্তর করা হয়। চাকুরী নিয়ে তাকে চলে যেতে হয় সাইগনে (বর্তমানে হো চি মিন সিটি)। সেখানে মার্কিন বাহিনীর টহল দলের সাথে নিয়মিত ঘুরে বেড়াতেন তিনি। এসময়ই তার মনে হতে থাকে মার্কিনীদের পক্ষে ভিয়েতনাম জয় সম্ভব নয়।
১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে পুনরায় র্যান্ড-এ যোগদান করেন ড্যানিয়েল এলসবার্গ। এরপরই তিনি জড়িয়ে পড়েন ম্যাকনামারা’র প্রজেক্টে। তারপরের ঘটনা তো সবারই জানা।
প্রজেক্টে অংশ নেওয়ার পর নিজের পুরনো বিশ্বাস আরও পোক্ত হতে শুরু করে ড্যানের ভেতর। তার মনের কথাগুলোই যেন ওই কাগজগুলোতে প্রমাণরূপে হাজির হলো। ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাস থেকে তিনি নথিপত্রগুলোর অনুলিপি নেওয়া শুরু করেন ফটোকপির মাধ্যমে। পরের দেড় বছরে তিনি অনেক মার্কিন সিনেটরের কাছে গিয়েছিলের এ উদ্দেশে যে তারা হয়তো নথিগুলো প্রকাশ করতে তার সাথে এগিয়ে আসবেন। এদের মধ্যে ছিলেন সিনেটর জে. উইলিয়াম ফুলব্রাইট, সিনেটর চার্লস ম্যাথিয়াস জুনিয়র, সিনেটর জর্জ ম্যাকগভর্ন, ও কংগ্রেসম্যান পল ম্যাকক্লস্কি জুনিয়র।
নিল শিহ্যানের বাজিমাত
১৯৭০ সালে র্যান্ড ছেড়ে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজি (এমআইটি)-তে কাজ নেন এলসবার্গ। ততদিনে উপর্যুক্ত সিনেটরেরা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু জর্জ ম্যাকগভর্ন এলসবার্গকে পরামর্শ দেন তিনি যেন সিনেটরদের কাছে ধর্না না দিয়ে এলসবার্গ বরং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বা দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-কে নথিগুলো পাঠান। পরামর্শটি ড্যানের মনে ধরে।
নিজের স্মৃতিকথায় এলসবার্গ লিখেন:
“(আমি ভেবেছিলাম) কেবল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস–ই হয়তো পুরো স্টাডিটি প্রকাশ করতে পারতো, আর তা করার জন্য পত্রিকাটির যথেষ্ট প্রতিপত্তিও ছিল।”
নিল শিহ্যান ভিয়েতনামের যুদ্ধ কাভার করেছিলেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর হয়ে। তাকে আগে থেকেই চিনতেন এলসবার্গ। ১৯৭১-এর ০২ মার্চ তারিখে শিহ্যানকে তার ওয়াশিংটনের বাসায় ফোন করেন এলসবার্গ। তারপর দুজনে দেখা করে দীর্ঘ আলোচনা করেন। সেখানেই তাদের কথা হয় পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশ করা নিয়ে। (চলবে)
Feature Image Courtesy: beaconbroadside.com
Reference: links are hyperlinked within the article