১৯৭১ সালে ড্যানিয়েল এলসবার্গ পেন্টাগন পেপার্স ফাঁস করে সবাইকে দেখিয়ে দেন কীভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে তথ্য লুকিয়েছিল মার্কিন সরকার। আজ পড়ুন সেই ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্ব।
পেন্টাগন পেপার্স-এর ইতিবৃত্ত (প্রথম পর্ব) পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কয়েক সপ্তাহ আলোচনা করার পর ড্যান-শিহ্যান জুটি স্থির করলেন কাগজপত্রগুলো নিউইয়র্কে স্থানান্তরিত করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর আন্তর্জাতিক সম্পাদক (ফরেইন এডিটর) জেমস এল. গ্রিনফিল্ডের ম্যানহাটনের বাসায় নথিগুলো রাখা হয় প্রাথমিকভাবে।
জেরাল্ড গোল্ড ছিলেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর তৎকালীন সহকারী সম্পাদক (আন্তর্জাতিক)। তিনি নিউ ইয়র্ক হিল্টন হোটেলে দলটির জন্য একটি স্যুটের ব্যবস্থা করেন। সেখানে ড্যানিয়েল এলসবার্গ, নিল শিহ্যান, এবং অপর সহকারী সম্পাদক (আন্তর্জাতিক) অ্যালান এম. সিগ্যাল কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে অন্যান্যরা যোগদান করেন এ কর্মযজ্ঞে। এদের মধ্যে ছিলেন হেড্রিক স্মিথ, ই. ডব্লিউ. কেনওর্থি, ফক্স বাটারফিল্ড-এর মতো দুঁদে সাংবাদিকেরা। তারা একসাথে বসে প্রতিটি বিশ্লেষণ, মন্তব্যের সাথে মূল নথি মেলাতে শুরু করলেন। নথিগুলো প্রসঙ্গে কোনো সাংবাদিকের ব্যক্তিগত মতামত বা মন্তব্য রাখার কোনো সুযোগ ছিল না।
পত্রিকাটির আইনি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান লর্ড ডে অ্যান্ড লর্ড যখন জানতে পারলো এই ৭০০০ পৃষ্ঠার বিশাল সংগ্রহ পুরোপুরি ক্লাসিফায়েড ছিল, এটি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে প্রকাশে নিরুৎসাহিত করলো। এ সময় সংস্থাটি পত্রিকাটিকে আইনি সহায়তা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেছিল।
দ্য স্কুপ
“Vietnam Archive: Pentagon Study Traces Three Decades of Growing US Involvement”
অনেক খাটুনির পর ১৯৭১ সালের ১৩ জুন এই শিরোনামে ভিয়েতনাম আর্কাইভ সিরিজের প্রথম স্টোরিটি প্রকাশিত হয়। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রথম পাতায় ফার্স্ট লিড হিসেবে বক্স স্টোরিটি ছাপা হয়। মজার ব্যাপার হলো, সেদিন প্রথম পাতায় সেকেন্ড লিড ছিল নিক্সনের মেয়ের বিয়ের খবর। নিল শিহ্যানের বাইলাইনে ছাপা এ খবরটি স্বাভাবিকভাবেই চারদিকে হইচই ফেলে দিয়েছিল। মার্কিন প্রশাসনের উচ্চাসনে বসে থাকা ব্যক্তিটি শুরু করে একেবারে আদার ব্যাপারী, সবাই নড়েচড়ে বসেছিলেন। কিন্তু পেন্টাগন পেপার্স-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে খবর সবার আগে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করেনি।
১৯৭১ সালের জুন মাসের বেশ আগেই দ্য বোস্টন গ্লোব পত্রিকার সাংবাদিক থমাস অলিফ্যান্ট এলসবার্গের সাক্ষাৎকার নেন। তার সূত্রে মার্চ মাসে প্রকাশিত এক সংবাদে ডকুমেন্টগুলোর পেছনের গল্প ও মার্কিন নীতির কথা জানানো হয়। এছাড়া জানানো হয়, যারা রিপোর্টটি সম্পূর্ণ পড়েছিলেন তারা সবাই ভিয়েতনামে যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে ছিলেন।
দ্য বোস্টন গ্লোব সবার আগে পেন্টাগন পেপার্স-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করলেও পেপার্স-এর আধেয় নিয়ে সবার আগে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-ই খবর প্রকাশ করে। তৃতীয় পত্রিকা হিসেবে ১৯৭১ সালের ২২ জুন পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে দ্য বোস্টন গ্লোব ।
গড়াল আদালত পর্যন্ত
পরের দিন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস দ্বিতীয় আর্টিকেল প্রকাশ করে। ১৫ জুন তৃতীয় আর্টিকেল প্রকাশ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জন মিচেলের কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পায় পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। টেলিগ্রামে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে গোপন রিপোর্ট প্রকাশে বিরত থাকতে বলা হয় এবং আরও জানানো হয় এ ধরণের রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে পত্রিকাটি আইনভঙ্গ করছে। বলা হয় “এ ধরণের তথ্য আরও প্রকাশ করা হলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি”। কিন্তু এ আদেশ বা অনুরোধ মানেনি পত্রিকাটি।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর তখনকার সম্পাদক আর্থার ওশ সুলজবার্গার বলেন, “ওটা (পেন্টাগন পেপার্স’র প্রকাশ) জাতীয় নিরাপত্তায় কোনো ফাটল সৃষ্টি করেনি। আমরা কোনো জাতীয় গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করিনি। ভিয়েতনামে থাকা কোনো সৈনিক বা মেরিন সেনার জীবনকে হুমকির মুখে ফেলিনি আমরা।”
যাহোক ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। একজন ফেডারেল বিচারক তখন পত্রিকাটির ওপর পরবর্তীকালে আর কিছু প্রকাশ না করতে সাময়িক আদেশ জারি করেন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এ রায় মেনে নিলেও আইনি লড়াই চালিয়ে যায়। এই প্রথমবারের মতো আদালতের আদেশে কোনো পত্রিকার সংবাদ প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
রঙ্গমঞ্চে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট
যারা স্টিভেন স্পিলবার্গের দ্য পোস্ট (২০১৭) সিনেমাটি দেখেছেন, তারা জানেন পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য কতোটাই না কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-কে। পোস্ট তখন বলতে গেলে স্থানীয় একটি পত্রিকা। কিন্তু দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রথম প্রতিবেদনের পরই পোস্ট-এর পক্ষে আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভবপর ছিল না। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর তখনকার সম্পাদক বেন ব্রেডলি স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে:“পোস্ট-এর কাছে কোনো কপি (পেন্টাগন পেপার্স‘র) ছিল না। আমাদেরকে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনকেই পুনর্লিখন করতে হয়েছিল। আমাদের প্রতিবেদনের প্রতি প্যারাগ্রাফেই ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ভাষ্যমতে’ কথাগুলো যোগ করতে হয়েছিল। প্রতিটা শব্দ থেকে যেন রক্ত চুইয়ে পড়ছিল, যেটা শুধু আমরা দেখেছিলাম।”
১৬ জুন, বুধবারে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সম্পাদক (জাতীয়) বেন এইচ. ব্যাগডিকিয়ানের সাথে ড্যানিয়েল এলসবার্গের যোগাযোগ স্থাপিত হলো। ব্যাগডিকিয়ান ছিলেন র্যান্ড কর্পোরেশনে এলসবার্গের একজন প্রাক্তন সহকর্মী। সে রাতেই এলসবার্গের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে বোস্টনের পথে উড়াল দেন বেন ব্যাগডিকিয়ান।
বৃহস্পতিবার সকালে দুটো প্রথম শ্রেণির টিকেট নিয়ে ফেরার পথ ধরেন ব্যাগডিকিয়ান। দুটো আসন, একটাতে ব্যাগডিকিয়ান, আরেকটাতে পেন্টাগন পেপার্স-এর কপিভর্তি বাক্স।
এদিকে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন তখন বন্ধ রয়েছে আদালতের আদেশে। তবুও ব্রেডলি ঠিক করলেন পরেরদিন শুক্রবারের পত্রিকায় দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে প্রতিবেদন ছাপাবেন। ১৮ জুন ওয়াশিংটন পোস্ট পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে খবর ছাপানোর পর বিকেলে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে ফোন পেলেন বেন ব্রেডলি। তাকেও পরবর্তী সময়ে আর কোনো প্রতিবেদন না ছাপানোর অনুরোধ করা হলো। কিন্তু ব্রেডলি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাথে সাথে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-কেও এরপর আদালতে হাজিরা দিতে হয়।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)
Feature Image Courtesy: amazon.com
Reference: links are hyperlinked within the article.