১৯৭১ সালে ড্যানিয়েল এলসবার্গ পেন্টাগন পেপার্স ফাঁস করে সবাইকে দেখিয়ে দেন কীভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে তথ্য লুকিয়েছিল মার্কিন সরকার। আজ পড়ুন সেই ইতিহাসের শেষ পর্ব।
পেন্টাগন পেপার্স-এর ইতিবৃত্ত (দ্বিতীয় পর্ব) পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আদালতের রায়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন বনাম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর আইনি লড়াই চলতে থাকল। এদিকে এলসবার্গ তখন অন্যান্য পত্রিকাকে পেন্টাগন পেপার্স-এর কপি বিতরণ করে যাচ্ছেন। শেষমেষ তিনি প্রায় দু’ডজনের মতো পত্রিকার হাতে এর কপি বিতরণ করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ জুন তারিখে সুপ্রিম কোর্ট শুনানিতে রাজি হয়। জুন ৩০ তারিখে এক রায়ের মাধ্যমে সংবাদপত্র দুটির পক্ষে রায় ঘোষণা করে আদালত। ০৬-০৩ ভোটের এ রায়ের পর থেকে প্রতিবেদন প্রকাশে আর কোনো বাধা রইলো না সংবাদপত্রসমূহের। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য এ রায়টি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ধারণা করা হয়, সেদিন যদি আদালতের রায় পত্রিকাগুলোর পক্ষে না যেতো তাহলে হয়তো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তখনই অস্তমিত হতো।
দ্য পোস্ট (২০১৭) সিনেমায় বেন ব্রেডলিকে আমরা বলতে শুনি, ‘যদি আমরা এই লোকগুলোকে (মার্কিন প্রশাসন) জবাবদিহিতার মুখোমুখি না করি, তাহলে কারা করবে?’ সত্যিই সেদিন যদি সংবাদপত্রগুলো মার্কিন প্রশাসনকে এমন বেকায়দায় না ফেলতো, তাহলে আজকে হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্ত গণমাধ্যমের চর্চা কাগজ-কলমেই থেকে যেতো। বিশেষত ট্রাম্পের মতো রাষ্ট্রনেতাদের খপ্পরে পড়লে গণমাধ্যমের দশা যে করুণ থেকে করুণতর হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
নিক্সন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
প্রাথমিকভাবে নিক্সন চাননি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে। ১৯৭১ সালের ১৩ জুন তারিখে হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে এক ফোনালাপের বরাতে জানা যায়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন পেন্টাগন পেপার্স-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন এই স্টোরি পড়ে মানুষ ভাববে ভিয়েতনামের ভুল তার সরকারের নয় বরং তার পূর্ববর্তী সরকারগুলোই এর জন্য দায়ী। নিক্সন বরং চেয়েছিলেন যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ নথিগুলো ফাঁস করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
কিন্তু এদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মিচেল আশঙ্কা করলেন যদি প্রশাসন এই মুহূর্তে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নেয় তাহলে পরে হয়তো তা আর সম্ভব হবে না। তখন মিচেল পত্রিকাটির কাছে সতর্কতামূলক টেলিগ্রাম পাঠানোর জন্য নিক্সনের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এক ফোন কলের মাধ্যমে অনুমতি প্রদান করেন নিক্সন।
১৯৭১ সালের দিকে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। পেন্টাগন পেপার্স ফাঁস হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি কুপিত হয়েছিলেন কিসিঞ্জার। কারণ তিনি ভেবেছিলেন এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দ্য প্লামার্স
নিক্সন প্রথমে ভেবেছিলেন পেন্টাগন পেপার্স ফাঁস করেছে প্রতিরক্ষা দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। কিন্তু যখন আসল ব্যক্তির কথা হোয়াইট হাউজ জানতে পারলো তখন নিক্সন প্রশাসন মনোযোগ দিলো এলসবার্গ আর সহযোগীদের প্রতি। তাকে এবং তার সহযোগী রুশোকে ষড়যন্ত্র, গুপ্তচরবৃত্তি ও চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। তবে ১৯৭৩ সালে তাদেরকে এ অভিযোগগুলো থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারণ ততদিনে নিক্সনের নিযুক্ত করা ‘দ্য প্লামার’-এর খবর সবাই জেনে যায়।
নিক্সনের আদেশে এলসবার্গের মনোচিকিৎসক লুইস ফিল্ডিং-এর অফিসে গোপনে প্রবেশ করে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল একদল লোক। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন কোনো তথ্য হাতিয়ে নেওয়া যা দিয়ে এলসবার্গকে হেয় করা যাবে। এরাই ‘দ্য প্লামারস’ নামে পরিচিত। এই ‘প্লামারস’দের মধ্যে দুজন, ই. হাওয়ার্ড হান্ট এবং জি. গর্ডন ছিলেন সেই কুখ্যাত মহারথীদের অংশ যারা ওয়াটারগেট হোটেলে ডেমোক্র্যাটদের অফিসে গোপনে প্রবেশ করে ধরা খেয়েছিলেন। অর্থাৎ নিক্সন নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছিলেন।
নিক্সনের লোকেরা অবশ্য শুধু এতেই ক্ষান্ত হয়নি। এলসবার্গ জানান, তার ওপর শারীরিক আক্রমণেরও আশঙ্কা ছিল। জনৈক সিআইএ কর্মীর মিশন ছিল তার পা ভেঙে দেওয়া। এছাড়া তাকে পুরোপুরি অক্ষম (incapacitated) করে দেওয়ার কথাও চিন্তা করা হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসে তাকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এলসবার্গ তার প্রসিকিউটরকে ‘অক্ষম করা’র মানে জনতে চাইলে তার প্রসিকিউটর বলেন, বলা তো হয়েছিল পুরোপুরি অক্ষম করে দিতে কিন্তু বোঝেনই তো এই লোকেরা কখনো ‘খতম’ শব্দটা ব্যবহার করে না। তারা ‘নিউট্রালাইজ’, ‘টার্মিনেট উইদ অ্যক্সট্রিম প্রেজুডিস’ এসব শব্দসম্ভার ব্যবহার করে।
পেন্টাগন পেপার্স’র প্রভাব
পেন্টাগন পেপার্স’‘-এর কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে যেসব তর্কবিতর্ক সামনে এসেছিল তা আজকের দিনেও বেশ প্রাসঙ্গিক। এডওয়ার্ড স্নোডেনের কর্মকাণ্ড বা ট্রাম্প প্রশাসন; সব ক্ষেত্রেই পেন্টাগন পেপার্স খুবই প্রাসঙ্গিক।
ইতিহাসবিদ লয়েড গার্ডনারের ভাষ্যে, সেবার যদি সরকারপক্ষ জিতে যেতো, তাহলে সাংবাদিকতার ওপরে এক ভয়ঙ্কর কালো ছায়া নেমে আসতো।
সাংবাদিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও সরকারী কর্মচারী আর সাংবাদিকদের মধ্যে একপ্রকার দূরত্বই সৃষ্টি করেছে এই পেপার্স যা আজও বিদ্যমান বলে প্রতীয়মান হয়।
‘সেটাই হচ্ছে পেন্টাগন পেপার্স-এর শিক্ষা। যতোই চতুর আর শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষেরা হোয়াইট হাউজ বা পেন্টাগনে থাকুক না কেন, তারাও যেকোনো সময় উন্মত্ত হতে পারে, অবৈধ কাজকারবারে লিপ্ত হতে পারে।…’
১৯৯৬ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন কথাগুলো বলেন এলসবার্গ।
ঘটনার ৪০ বছর পর, ২০১১ সালের জুন মাসে পেন্টাগন পেপার্স-এর সম্পূর্ণ ৭০০০ পৃষ্ঠা প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়।
কেন করলেন ফাঁস?
“We are eating our young.”
ড্যানিয়েল এলসবার্গের মনে এই কথাটাই বারবার খোঁচা দিতে থাকে। ভিয়েতনামে তিনি দেখেছিলেন কীভাবে মার্কিন সেনারা মার খাচ্ছে, মারা পড়ছে। তখনই তার মনে হয়েছিল এটা থামানো দরকার। তিনি ভেবেছিলেন এভাবে মিথ্যের বেসাতি আর হতে দেওয়া চলে না। এলসবার্গের বই ‘দ্য ডুমসডে মেশিন: কনফেশনস অভ আ নিউক্লিয়ার ওয়ার প্ল্যানার’-এ তিনি উল্লেখ করেছিলেন, পেন্টাগন পেপার্স‘-এর পাশাপাশি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোপন নিউক্লিয়ার প্ল্যানের সন্ধানও পেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে তার কাছে মনে হয়েছিল নিউক্লিয়ার প্ল্যানগুলো ফাঁস করার চেয়ে পেন্টাগন পেপার্স ফাঁস করাটা তখন বেশি জরুরি ছিল। “কারণ ভিয়েতনামে তখন বোমা ফেলা হচ্ছিল এবং আমি চেয়েছিলাম তাড়াতাড়ি এর একটা ইতি টানতে।”
(সমাপ্ত)
Feature Image Courtesy: notrecinema.com
Reference: Links are hyperlinked within the article.