আমরা যা বাইরে থেকে দেখি, বিষয়টা কি আসলে তেমনই? নাকি এই দেখার বাইরেও লুকিয়ে থাকতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোন সত্য? কোনো মানুষের কাজ, পোশাক বা লাইফস্টাইলের কিছু দেখে আমরা সহজেই তাকে বিচার করি, তার সম্পর্কে সরলীকৃত কোন ধারণা পোষণ করি। তবে এই ধারণা অনেকসময়ই সঠিক হয়না। এর আড়ালেও লুকিয়ে থাকতে পারে ভিন্ন কোন সত্য, কোন লড়াই- যা তলিয়ে না দেখলে বোঝা যায়না।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’। ১৯৯৪ সালে প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় বইটি।
বইটির প্রধান চরিত্র একটি মেয়ে। সিনেমায় এক্সট্রার কাজ করে সে। উপন্যাসের শুরুতে তাকে দেখা যায় কোটিপতি ব্যবসায়ী মোবারক সাহেবের শয্যাসঙ্গিনী হতে। তার কাছে সে নিজের পরিচয় দেয় টেপী নামে। সিনেমার এক্সট্রা হিসেবে কাজ করে পাওয়া শিফটপ্রতি আড়াইশো টাকায় সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব তার জন্য। তাই বাধ্য হয়েই নিতে হয়েছে এই পথ। সিনেমা জগতে অবশ্য তার নাম রেশমা। আর পরিবারে মিতু- তার আসল নাম।
মিতুর বাবা নেই। মা শাহানা আর বোন ঝুমুরকে নিয়ে গাজীপুরের জয়দেবপুরে তার সংসার। ভাই রফিক খুনের দায়ে জেলে। পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষটি মিতু। আর তার এই এক্সট্রার কাজ কিংবা ধনী কোন ব্যক্তির শয্যাসঙ্গিনী হবার বাইরেও আছে নিজের একটা জগৎ। তার ভেতরের সেই মানুষটিকে সে মেলে দিতে পারে মবিন ভাইয়ের কাছে।
মবিন থাকে মেসে। টিউশন করে চলতে হয় তাকে। মিতুর প্রতি তার ভালোলাগা আছে, আছে প্রছন্ন ভালোবাসাও।
মিতুর এই রূপটি মোবারক সাহেবের অজানা। তিনি তাকে দেখেছেন টেপী হিসেবেই। তবে তাতেই মেয়েটির কথাবার্তায় মুগ্ধ হন তিনি। তার মনে হয় বহুদিন পর কেউ তাকে বিস্মিত, চমৎকৃত করছে। একপর্যায়ে তিনি ঠিক করেন টেপী নামের এই মেয়েটিকে দিয়েই সিনেমা বানাবেন! খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার নাম রেশমা।
হিট পরিচালক আজমল তরফদারকে দায়িত্ব দেন সিনেমাটা নির্মাণের। আজমল তরফদারের অবশ্য মনে হয়েছিল এটা একটা বাতিকের বেশি কিছু নয়! মানিকদা অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের সাহচর্য একসময় পেয়েছিলেন আজমল। কিন্তু তারপরও একরকম মানসিক সংকীর্ণতা দেখা যায় তার মাঝে। রেশমাকে একটা পথের কুকুরীর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারেন না তিনি!
মোবারক সাহেব নিঃসন্তান। তার স্ত্রী আছেন-রেহানা। তবে তিনি আলাদা থাকেন। মাঝে-মাঝে ফোনে কথা হয়। মোবারক সাহেব তার দীর্ঘদিনের নিস্তরঙ্গ জীবনে রেশমা অথবা টেপী নামের মেয়েটির ভেতরেই নতুন করে বেঁচে থাকার আগ্রহ খুঁজে পান।
মিতুদের সংসারে অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। বাড়িওয়ালা বকেয়া ভাড়ার জন্য বের করে দিতে চান তাদের। এক্সট্রার কাজ করে অনেক সময়ই পারিশ্রমিক বাকি থাকে। কিন্তু ছবির এই প্রস্তাবটি যেন হঠাৎ করেই জীবন পরিবর্তন করে দেয় মিতুর।
মবিনের এদিকে টিউশনি চলে গেছে। চাকরির খুব দরকার তারও। মিতু সেই ব্যবস্থাও করে দেয়। মোবারক সাহেবের সুপারিশে চা বাগানের ম্যানেজার পদে চাকরি হয় তার। আর মিতুকে আমরা দেখি মোবারক সাহেবের বাগানবাড়িতে, তিনি তার সাথে কথা বলছেন ছবির বিষয়ে। মোবারক সাহেব ভাবেন মেয়েটির শরীরকে যখন তিনি কিনে নিতে পেরেছেন, আত্মাকেও অবশ্যই কিনে নিতে পারবেন!
উপন্যাসের শেষে মিতু দেখা করতে আসে মবিনের সাথে। মিতু যখন চাইছে দুজনের জীবন একসাথে নষ্ট না করতে, মবিনের সম্মানের কথা ভেবেই আলাদা হয়ে যেতে; তখন মবিনের কথা কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শেষটা বেশ চমকপ্রদ, যা পাঠকের মনেও মুগ্ধতা তৈরি করতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা বরাবরই খুব সাবলীল ও গতিশীল। ১২৪ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মোহবিষ্ট করে রাখে। বইটির কাহিনী প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্কদের জন্য। তবে অকারণে যৌনতার কোন ব্যবহার করেননি লেখক। উপন্যাসের নামকরণ ও চরিত্রচিত্রণে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। পেন্সিলে আঁকা কোন ছবি যতই সুন্দর হোক, তা আবার মুছেও ফেলা যায়।
যেমন-মোবারক সাহেব টেপীতে খুঁজে পেয়েছেন মুগ্ধতা, কিন্তু সেই মুগ্ধতা স্থায়ী হবে এমন নয়। তিনি মূলত চাইছেন নিজের সুখের জন্য মেয়েটিকে অধিকার করে নিতে। তার শরীর ও আত্মা- উভয়েরই অধিকার। আবার একই মানুষের একাধিক রূপও বেশ দক্ষ হাতেই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। যে রেশমাকে পথের কুকুরীর মত মনে করছেন পরিচালক আজমল তরফদার, তারই যে আবার মিতু নামে আরেকটি রূপ আছে, তার ভেতরেও যে আলাদা একজন মানুষ আছে- তা মবিনের সাথে মিতুর সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন তিনি।
হুমায়ূন বরাবরই তাঁর উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন চিত্রিত করার জন্য খ্যাতিমান। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের অভাব-অনটন, লড়াই-সবকিছুই তুলে ধরেছেন তিনি। পর্দার এক্সট্রা রেশমা অর্থাৎ মিতুকে বাস্তবজীবনেও যে নানা জায়গায় অভিনয় করে যেতে হচ্ছে- তাও তুলে এনেছেন তিনি। আর বিশেষত মবিনের চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে এক মহানুভব উদার সত্তা, যে ভালোবাসতে জানে একটা মেয়ের ভেতরের মানুষটিকে, যার ভালোবাসা দেহসর্বস্ব নয়।
সবমিলিয়ে বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদের সেরা উপন্যাসগুলোর একটি এই ‘পেন্সিলে আঁকা পরী’, যা পাঠককে শুধু মুগ্ধই করে না; বরং পাঠকের হৃদয়েও রেখে যায় দীর্ঘস্থায়ী ছাপ।
Feature Image Courtesy: YouTube.com