পৃথিবীর বয়স আনুমানিক সাড়ে চার বিলিয়ন বছর। আর আধুনিক মানবজাতির আগমন হওয়ার পরেও কেটে গেছে প্রায় ২ লক্ষ বছর। এই সময়ের মধ্যে এসেছে বহু সভ্যতা। বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা চলছে এখনো। শিল্প, ভাস্কর্য বা স্থাপত্য ছাড়াও খাদ্যও একটি সভ্যতার সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেইসব প্রাচীন খাবারের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কিছু খাবারের প্রচলন রয়েছে এখনো। আজ আমরা দেখবো পৃথিবীজুড়ে এমনি কিছু প্রাচীন খাবার।
আমাজাকি: জাপানের প্রাচীন পানীয়
প্রাচীন এই খাবারের উৎপত্তির সময় জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে। যিশুর জন্মের প্রায় ২৫০ থেকে ৫৮০ বছর পূর্বে এই পানীয় প্রথম আবিষ্কৃত হয়। মূলত গাঁজন প্রক্রিয়ায় তৈরী হতো এই পানীয়। সিদ্ধ চালের সাথে পানি ও কজির মিশ্রনকে গাঁজিয়ে বানানো হতো আমাজাকি। বলে রাখা ভালো কজি হচ্ছে এক ধরনের চিকন ছত্রাক। যেটি কিনা জাপানিজ অনেক পানীয় তৈরী করার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়। উপরোক্ত মিশ্রনগুলোকে প্রায় ৮-১০ ঘন্টা ধরে গাঁজানো হয়। আর তাতেই প্রস্তুত হয় এলকোহল মুক্ত প্রচুর পুষ্টি যুক্ত আমাজাকি।

প্রাচীন এই পানীয় এর জনপ্রিয়তা জাপানে এখনো তুঙ্গে। ফুডেক্স জাপান এর মতে ২০১৬-১৭ এর মধ্যেই এই পানীয়ের বিক্রয় বেড়ে গিয়েছিলো ১৩৪.৮%। স্বাদের জন্য এর সাথে সামান্য আদা যোগ করা হলেও মূলত এটি একটি মিষ্টিজাত পানীয়। শুধুমাত্র স্বাদের জন্যই নয়, শরীরে পুষ্টির যোগানদাতা হিসেবেও এটি বেশ কার্যকর। প্রতি ১০০ গ্রাম আমাজাকিতে রয়েছে ৮০ ক্যালরি শক্তি। ভিটামিন বি ছাড়াও ফলিক এসিড, ফেরুলিক এসিড, প্রচুর আঁশ সহ এতে আছে যথেষ্ট পরিমানে গ্লুকোজ। যেটি কিনা সহজেই খাবার হজম করতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি ত্বক ও চুলের জন্যও এটি বেশ সহায়ক। তাই আমাজাকি শুধু জাপানের ইতিহাস ঐতিহ্যই বহন করেনা বরং আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে এটি পৃথিবীর অন্যতম সেরা একটি পানীয়।
গজি বেরি: চিরতরুণ রাখার লাল হিরা
ছোট ডিম্বানু আকারের বেরি যেটি কিনা বহুল পরিচিত ‘রেড ডায়মন্ড’ নামে; বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম সুপারফুড হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এই গজি বেরি চিনে ব্যবহার শুরু হয়েছিলো সেই সুদূর তৃতীয় শতকের শুরুর দিকে। প্রাচীন চিনের নিনজিয়া প্রদেশে চাষ হতো এই বহুল পরিচিত ফলটি। পর্বত থেকে আসা শীতল বাতাস, খনিজ সমৃদ্ধ মাটি আর পাশে প্রবাহিত ইয়েলো নদীর পানি নিনজিয়া প্রদেশের গজি বেরিকে করে তুলে অতুলনীয়। এমনকি বর্তমানেও নিনজিয়ার কৃষকরা সেই প্রাচীন রীতি অনুসরন করেই এই ফলটি উৎপন্ন করে থাকে। আর নিনজিয়ার গজি বেরির মূল্যও অন্য গজি বেরির থেকে একটু বেশি।

চিনের গজি বেরির প্রতি ভালবাসা সেই কয়েকশ বছর আগে থেকেই। চিনের সবচেয়ে প্রাচীন চিকিৎসার বইয়েও উল্লেখিত রয়েছে এই ফলটির কথা। চাইনিজরা অবশ্য এটিকে ফল এবং শস্য দুইটি রুপেই বিবেচনা করে আসছে। খনিজ উপাদান সহ এই ফলে রয়েছে ভিটামিন সি, এমাইনো এসিড ও এন্টিঅক্সিডেন্ট। পাশাপাশি ক্যারোটিনের জন্য চোখের প্রতিকারেও চাইনিজরা এই ফল প্রচুর পরিমানে খেয়ে থাকে।
তবে চিরতরুণ হওয়ার রহস্য নিয়ে প্রাচীন লোককথাও প্রচলিত রয়েছে। প্রায় ২০০০ বছর আগে এক চিকিৎসক চায়নার একটি গ্রাম পরিদর্শনে আসেন। সেখানে তিনি দেখেন যে অধিকাংশ বাসিন্দার বয়সই ১০০ বছরের উর্ধ্বে। তিনি আবিষ্কার করেন যে তারা সবাই গজি বেরির শরবত নিয়মিত পান করে। তাছাড়া কথিত রয়েছে ১৭ শতকের দিকে চিনের বিখ্যাত ভেষজবিদ লি কিং ইউয়েন নিয়মিত গজি বেরি খেয়ে বেঁচে ছিলেন ২৫২ বছর পর্যন্ত। তবে এইসব লোককথার জন্যই হোক কিংবা গজি বেরির উপকারিতার জন্যই হোক এই ফলের চাহিদা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। শুধু চিনেই নয় এর চাহিদা রয়েছে গোটা বিশ্বেই। আর তাই ইউরোপিয়ানরা সাধারণত ১০ ডলারের বিনিময়ে এক প্যাকেট গজি বেরি কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। যেটি কিনা এশিয়ায় বিক্রয় হওয়া দামের প্রায় তিন গুন। ভবিষ্যতেও যে এ চাহিদার ঘাটতি হবেনা তা বলে দেওয়াই যায়।
স্ট্যু: ৪০০০ বছরের পুরাতন খাবার
ভেড়ার স্ট্যু বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি খাবার। কিন্তু এর আসল উৎপত্তি সময় কাল জানলে আপনার পিলে চমকে উঠলেও উঠতে পারে। প্রায় চার হাজার বছর আগের মেসোপোটেমিয়ান সভ্যতায় প্রথম এই ধরনের খাবার তৈরীর প্রণালি পাওয়া যায়। বর্তমান বাগদাদ, সিরিয়া ও তুরস্ককে ঘিরে গড়ে উঠেছিলো এই সভ্যতা। সেই সভ্যতার এক প্রাচীন লিপি থেকেই আধুনিক ভাষাবীদরা এই ভেড়ার স্ট্যু এর রেসিপি উদ্ধার করে। সেই লিপির মর্মোদ্ধারে কাজ করা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর পিয়া সরেনসন জানিয়েছেন লিপিটি ততটা তথ্য সমৃদ্ধ নয়। বড়জোর চার লাইনের লিপিতে সংক্ষিপ্ত আকারে কী কী করতে হবে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আর বাকি বেশিরভাগ ব্যাপারগুলো আপনাকে অনুমান করে নিতে হবে।

কিন্তু অবাক করা বিষয় ছিলো যে রন্ধনের উপাদানগুলোতে কোনো হেরফের হয়নি। চার হাজার বছর আগের উপাদান গুলোই বর্তমানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে ইরাকের প্রধান খাবার স্ট্যু, ভাত আর রুটি। এই ব্যাপারটি খুবই বিস্ময়কর যে সেই চার হাজার বছর আগের তৈরী সংস্কৃতি এখনো অনুসরণ করে আসছে ইরাকবাসী। সাধারণ একটি খাবারের অসংখ্য বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও সেই প্রাচীন আমলের রেসিপিই বর্তমানে অনুসরণ করা হয়। আমরা শুধুমাত্র ৪০০০ বছর আগের ব্যবিলন, মেসোপোটেমিয়ার কথা বলছি। কে জানে হয়তো তারো আগে থেকেই বর্তমানের মতো বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন খাবার রান্না হয়ে আসছে। যেটি হয়তো বর্তমান দুনিয়ার তুমুল জনপ্রিয় কোনো এক রেসিপি!
ইনজেরা: ডাচদের সুপারফুড নাকি আফ্রিকান প্রাচীন খাবার?
প্রায় ২০০০ বছর আগে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবাতে উচ্চ প্রোটিন যুক্ত টেফ নামক এক ঘাসকে গুড়ো করে এক ধরনের মুখ্য খাবার তৈরী করা হতো। ইনজেরা নামের সেই প্যানকেকের মতো খাবারটি ছিলো ইতিওপিয়ানদের প্রধান খাবার। সবজি কিংবা মাংস দিয়ে ইনজেরা প্রতিদিন একবার করে খাওয়া ইথিওপিয়ানদের জন্য একেবারে রুটিনমাফিকই হয়ে গিয়েছিলো। যেমনটা আমরা বাঙালিরা ভাত খেয়ে থাকি। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে বর্তমানে এই টেফ ঘাস সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো তৈরী করাতে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে নেদারল্যান্ড।

এর শুরুটা হয়েছিলো ২০০৩ সালে। ইথিওপিয়া থেকে প্রায় এক ডজন ভিন্ন ধরনের টেফ বিজ পাঠানো হয় নেদারল্যান্ড কৃষিবিদ জান্স রসজেনের কাছে। চার বছর পর ইউরোপিয়ান পেটেন্ট কোম্পানি এই ধরনের পণ্য উৎপাদনের পেটেন্ট দিয়ে দেয় রসজেনের কোম্পানিকে। তাতে করে আইনি লড়াইতে নামে ইথিওপিয়া। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবারকে বাঁচাতেই ইথিওপিয়ার এই যুদ্ধ। কারণ বর্তমানেও ইনজেরা ইথিওপিয়াতে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক ইথিওপিয়াতে নেমেই সর্বপ্রথম এই ইনজেরার স্বাদ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কোলেস্টেরল মুক্ত এই খাবারে রয়েছে উচ্চ পরিমানে আমিষ ও আয়রন। তাই ২০০০ বছরের এই পুরানো খাবার শুধু ইথিওপিয়ার ঐতিহ্যেরই অংশ নয় বরং ইথিওপিয়ার অর্থনীতিতেও এর অবদান অপরিসীম।
আচাই বোল: ব্রাজিলিয়ান কল্পকাহিনী থেকে যে ফলের জন্ম
গাড় বেগুনি রঙ এর আইসক্রিমের মতো এক ধরনের খাবারের নাম আচাই বোল। যেটি কিনা ব্রাজিল ছাড়াও তাবত বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়। নিজেকে সতেজ ও তরুন রাখার সাথে সাথে শরীরে শক্তিরও যোগান দাতা হিসেবেও এই খাবারটির তুলনা নেই। প্রায় ব্ল্যাকবেরি ও চকোলেটের মিশ্রনের স্বাদের এই আচাই বোলের ৮৫% যোগানদাতা দেশ ব্রাজিল। দক্ষিন আমেরিকার এই দেশটি প্রতিবছর ১.২৫ মিলিয়ন টন আচাই মন্ড উৎপন্ন করে থাকে।
পর্তুগিজ জাহাজ ব্রাজিলে ভেড়ার অনেক আগেই এইখানে বসবাস করতো টুপি নামের এক গোত্র। আমাজন নদীর তীরবর্তী বর্তমানে সিটি অফ বেলেম নামে পরিচিত এই জায়গায় বসতি ছিলো এই গোত্রের। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তাদের জনসংখ্যা বহুগুণে বেড়ে গেলে খাদ্য সংকট দেখা দেয় প্রকটভাবে। তাই উপায়ন্তর না দেখে গোত্রের রাজা ইটাকি ঘোষণা দেয় যে রাজ্যের সকল নতুন জন্ম নেওয়া শিশুকে ইশ্বরের উদ্দেশ্যে বিসর্জন দেওয়া হবে।
এমনকি সেই সময় ইটাকির আপন মেয়ে সন্তান সম্ভবা হলেও এই ঘোষনা দিতে পরোয়া বোধ করেননি তিনি। শেষমেষ নিজের মেয়ের সন্তানকেও বলি দিতে বাধ্য হোন ইটাকি। এদিকে সন্তান হারানোর শোকে ইশ্বরের কাছে এই ক্ষুধা ও দুঃখ কষ্ট নিবারনের জন্য প্রার্থনা শুরু করেন ইটাকির মেয়ে। একদিন সকালে গোত্রবাসি জেগে উঠে দেখে ইটাকির মেয়ে মৃত হয়ে একটি তালগাছ স্বরুপ গাছ জড়িয়ে ধরে আছে। যেই গাছে অসংখ্য ছোট ছোট ফল ধরে আছে। মেয়ে আচাই এর সম্মানে ইটাকি সেই ফলের নাম রাখেন আচাই। সেই থেকে টুপা গোত্র আর কখনোই ক্ষুধার কষ্ট ভোগ করেনি। আর বলা হয়ে থাকে এইভাবেই আচাই এর আগমন ঘটে ব্রাজিলে।

সেই প্রাচীন আমল থেকেই তাই আচাই এর প্রতি ব্রাজিলিয়ানদের ভালবাসা প্রখর। প্রথমে আমাজনের গভীর জঙ্গলে চাষ হলেও বর্তমানে ব্রাজিলের অনেক জায়গায় চাষাবাদ হয় এই ফলের। সাধারণত আচাই এর মন্ড থেকে তৈরী করা হয় আচাই বোল। ভিটামিন, আমিষ, ফাইবার সহ প্রায় ৩০ ধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট আছে এই ফলে। যেটি কিনা শরীরের শক্তির যোগান ছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী ও পেশির সক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে।
পৃথিবী জুড়ে এমন হাজারো প্রাচীন খাবার প্রচলিত রয়েছে। যেসব কিনা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের মতে বেশ উপকারী। তাছাড়া এসব খাবার আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও পরিচায়ক। তাই সুষ্ঠুভাবে এদের বাঁচিয়ে রাখাও আমাদের কর্তব্য।
Feature Image Courtesy: bbc.com