বিদ্যুৎ আমাদের জীবনে এক অপরিহার্য উপাদান। বাতি জ্বলছে বিদ্যুতে, পাখা চলছে বিদ্যুতে। বড় বড় অফিস-কলকারখানা-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব জায়গাতেই আবশ্যক এই বিদ্যুৎশক্তি।
কিন্তু আমরা কি জানি কীভাবে আবিষ্কার হলো এই বিদ্যুৎ? চলুন জেনে আসা যাক বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পেছনের কথা।
মিলেটাস বন্দরে থেলিস
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। তুরস্কের পশ্চিম উপকূলে ছিল এক ছোট সমুদ্র বন্দর- মিলেটাস। এই বন্দরে দেখা দিলেন বিজ্ঞানী থেলিস। থেলিসকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী। তিনি বিভিন্ন জিনিস নিয়ে পরীক্ষা চালাতেন, প্রকৃতির নিয়ম-কানুন খুঁজে পাবার চেষ্টা করতেন।
একদিন সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটতে গিয়ে তিনি কুড়িয়ে পেলেন ফিকে তামাটে রঙের অদ্ভুত রকমের একটি পাথরের নুড়ি। তিনি এই নুড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখলেন কোন কিছু দিয়ে ঘঁষলে এই নুড়ি তখন কাছে টেনে নিচ্ছে ছোট-ছোট পাখির পালক বা খড়কুটো। তিনি এই নুড়ির নাম দিলেন ইলেকট্রন। এখন অবশ্য অ্যাম্বার বলা হতো একে।

এ অঞ্চলে আরো এক রকমের পাথর পাওয়া যেত, যা আকর্ষণ করত লোহাকে। থেলিস ভেবেছিলেন ইলেকট্রন নামের সেই নুড়ির আকর্ষণ আর এই পাথরের আকর্ষণ বোধহয় একই। কিন্তু আসলে তা নয়। এই পাথরগুলো ছিল মূলত চুম্বক। সে সময়ে থেলিস এটা ধরতে পারেননি।
উইলিয়াম গিলবার্ট ও স্থির বিদ্যুৎ
থেলিস পরবর্তী প্রায় ২২০০ বছরেও এই পার্থক্যটা কেউ ধরতে পারেনি। অবশেষে সেটা ধরলেন ডা. উইলিয়াম গিলবার্ট।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা। ১৬০০ সাল। ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথ সবে সিংহাসনে বসেছেন। গিলবার্ট ছিলেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তিনি সে সময় ‘চুম্বকের কথা‘ নামে একটি বই লিখলেন।
থেলিসের গবেষণায় যে বিষয়টি অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, ডা.গিলবার্ট সেটিকে পূর্ণতা দিলেন। তিনি বললেন গোটা পৃথিবীটাই আস্ত একটা চুম্বক। লোহার চুম্বকে যেমন উত্তর-দক্ষিণ মেরু আছে, তেমন আছেপৃথিবীতেও। এছাড়া থেলিস যে নুড়ি ঘষে তাতে পাখির পালক আকৃষ্ট করতে দেখেছিলেন, সেটারও ব্যাখ্যা দিলেন ডা. গিলবার্ট। তিনি এর নাম দিলেন স্থির বিদ্যুৎ।

স্থির বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের পার্থক্যকারী ডা. গিলবার্ট; Image Courtesy: Wikipedia.com
চুম্বকের যে আকর্ষণ তা প্রাকৃতিক। আর এখান থেকে গিলবার্টের ধারণা হয়েছিল পৃথিবী নিজেই একটি চুম্বক। তবে কাঁচের কাঠিকে রেশমি কাপড় দিয়ে ঘষে তাতে কাগজের টুকরো ধরলে যে আকর্ষণ ঘটে, তা ঘর্ষণের ফলে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার কারণে। এই দুটো ক্ষেত্রের পার্থক্য প্রথম ধরা পড়ে গিলবার্টের চোখে। গিলবার্ট এই স্থিরবিদ্যুৎ শক্তির নাম দেন ইলেকট্রিক শক্তি।
গিলবার্ট এমন আরো কিছু ধাতুকে ঘষে দেখেছিলেন তাতে অ্যাম্বারের মত আকর্ষণ জন্মাচ্ছে না। আসলে এক্ষেত্রে যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে তা তার মাথায় আসেনি। তিনি ধরে নিয়েছিলেন বিদ্যুৎ স্থির জিনিস।
স্টিফেন গ্রে–র আবিষ্কার পরিবাহক
১৭২৯ সালে ইংরেজ জ্যেতিষী স্টিফেন গ্রে গিলবার্টের ধারণাতে আরো পরিবর্তন নিয়ে এলেন। তিনি দেখালেন, ঘর্ষণে বিদ্যুৎ জন্মায় সবকিছুতেই। গিলবার্ট যেসব ধাতুতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় না বলে মনে করতেন, গ্রে দেখালেন সেসব ধাতুই দ্রুত বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ তারা বিদ্যুতের পরিবাহক। এই পরিবাহকের ধারণা গ্রে প্রথম পান তার ঘরে থাকা ঝাড়ুর প্রান্তের কর্ক থেকে। কর্ককে সাধারণত ইলেকট্রিকস হিসেবে গণ্য হতো না। তিনি বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য কেটলি দিয়েও পরীক্ষা করেন। তিনি দেখেন এতেও বিদ্যুৎ পরিবাহিত হচ্ছে। তাঁকে ‘ফাদার অভ ইলেকট্রিসিটি’-র সম্মান দেয়া হয়। তবে কী করে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয় তা ধরতে পারেননি স্টিফেন গ্রে।

দ্যু ফে ও পজেটিভ–নেগেটিভ এনার্জি
ফরাসি বিজ্ঞানী দ্যু ফে আবিষ্কার করেন বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণ। তিনি বিদ্যুৎ প্রবাহের ক্ষেত্রে ভিন্ন দু-রকম চার্জের বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন। ভিন্ন দুরকম চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে ও সমধর্মী চার্জ করে বিকর্ষণ। তবে চার্জ এর ধারণাকে তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তখন মনে করা হতো বিদ্যুৎ প্রবাহ হয় ঋণাত্মক দিক থেকে ধনাত্মক দিকে। তবে বাস্তবে বিষয়টি বিপরীত।
হাতের মুঠোয় বিদ্যুৎ নিয়ে এলেন বেনজামিন ফ্রাংকলিন
আমেরিকান বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্রাংকলিন পরবর্তীতে এ নিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তিনিই প্রথম বিদ্যুতের কণা বা স্ফুলিঙ্গের ধারণা দেন, যেখান থেকে পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি ধনাত্মক প্রোটন ও ঋণাত্মক ইলেকট্রন।
শক্তির নিত্যতার বিষয়টিও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে বুঝতে পেরেছিলেন ফ্রাংকলিন। মহাজগতে মোট শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট। শক্তির কোন ধ্বংস বা সৃষ্টি নেই, আছে শুধু রূপান্তর। ফ্রাংকলিন বিদ্যুৎ এর প্রবাহকে ব্যবহার করে শক্তির রূপান্তর ঘটিয়ে বিভিন্ন কাজের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে যা বাস্তব রূপ পেয়েছে।
সবচেয়ে দুঃসাহসী যে কাজটি তিনি করেছিলেন তা হলো, বজ্রপাতে উৎপন্ন বিদ্যুতকে মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসা। ১৭৫২ সালে প্রচণ্ড ঝড়ের এক রাতে ফ্রাংকলিন উড়িয়ে দেন রেশমি কাপড়ে তৈরি একটি ঘুড়ি। এর রেশমি সুতোর শেষপ্রান্তে ছিল একটি লোহার চাবি। বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে ঘুড়ি থেকে ভেজা সুতো বেয়ে
বিদ্যুতের প্রবাহ নেমে এলো, সুতোয় বাঁধা চাবি থেকে পাওয়া গেলো বিদ্যুতের ঝলক। ফ্রাংকলিনের এক ছেলে তাকে এই পরীক্ষাকার্য সম্পাদনে সহায়তা করেন।

ফ্রাংকলিনের পরে এই পরীক্ষাটি করতে গিয়ে দুজন প্রাণ দেন। কিন্তু সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে পরীক্ষা ফ্রাংকলিন চালিয়েছিলেন, তার ফলেই বিদ্যুৎশক্তি চূড়ান্তভাবে মানুষের হাতের নাগালে আসে। আর এরপর থেকে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করে ঘটানো হয়েছে সভ্যতার প্রভূত উন্নয়ন, যা এখন আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
Feature Image Courtesy: fi-edu.com
Reference:
আবিষ্কারের নেশায়-আবদুল্লাহ আল-মুতী