৫ জানুয়ারি, ১৯৮১।
ইরানি প্রেসিডেন্ট আবুল হাসান বানি-সাদর ঠিক করলেন, ইরাকের দখলকৃত ভূমি পুনরুদ্ধার করবেন। তিনি দুটো অপারেশনের পরিকল্পনা করলেন। একটি ‘অপারেশন নাসর’, আরেকটা ‘অপারেশন হুভাইজেহ’। এ দুটো অপারেশনের ওপর নির্ভর করছিল তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। ইরানি মোল্লারা এই কাউন্টার-অফেন্সিভকে স্বাগত জানালো, যদিও তারা জানতো ইরানি সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয় জয়ী হওয়া। তারা ভেবেছিল, যদি বানি-সাদর সফল হন, তাহলে তারা কৃতিত্ব নিবে। আর ব্যর্থ হলে বানি-সাদর আর সেনাবাহিনীকে দোষ দিবে।
জেনারেল ফাল্লাহি অপারেশন হুভাইজেহের জন্য নিয়োজিত করলেন ৮৮ ব্রিগেডকে, যেটা ৯২ আর্মার্ডের ২৮০টা ট্যাঙ্ক নিয়ে গঠিত হয়েছিল। তাদের সাথে থাকবে ৫৫ প্যারাশ্যুট ব্রিগেড আর ১৬ আর্মার্ড। ইরাকের ছিল নবম ডিভিশনের ২৪০টা ট্যাঙ্ক। ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পুরের পর সবচেয়ে বড় ট্যাঙ্ক যুদ্ধে ইরান পরাজিত হয়ে পিছু হটে।
অপারেশন নাসরের জন্য বানি-সাদর নিয়োজিত করেন ১৬, ৭৭ আর ৯২ আর্মার্ডকে। ইরাকি সেনাবাহিনী ইরানিদের দেজফুলে ঘেরাও করে ফেলে। কাদায় আটকে গিয়ে অচল হয়ে যায় ইরানের দেড়শ ট্যাঙ্ক, মারা যায় ১৪১ জন সৈনিক। ইরাক হারায় ৪৫টি ট্যাঙ্ক।
বানি-সাদরের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে মোল্লারা আক্রমণ করে তাকে। তারা আইয়ারজিসিকে শক্তিশালী করে তোলে। আইয়ারজিসির পূর্ণরূপ ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড কোর, ফার্সিতে ‘সিপাহ-ই পাসদারানে ইনকিলাবি ইসলামি’। এদের ডাকা হত পাসদারান নামে। এক লাখ চল্লিশ হাজার সৈন্য ছিল পাসদারানে। এরা তিনটি ব্রিগেড গঠন করে। দেজফুলের যুদ্ধের পর থেকে ইরানি সেনাবাহিনীর সাথে সাথে সব যুদ্ধে পাসদারানকে ব্যবহার করা শুরু হয়।
ওদিকে ইরাক কুর্দিস্তানে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খুলে দেয়। ইরাকি প্রথম কোরের জেনারেল আমিন ১৯৮০ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইরানের দুটো গিরিপথ দখল করে নেয়। ইরাকের হালাবা শহরে এক ব্রিগেড সৈন্য পাঠানো হয় ইরাকি কুর্দিদের হাত থেকে দারবান্দিখান বাঁধ রক্ষা করার জন্য। ইরানি কুর্দি বিদ্রোহী পিডিকেআইকে ইরাক প্রচুর অস্ত্র দেয়। ১৯৮১ এর এপ্রিলে ইরানি কুর্দিদের নেতা আবদুর রহমান গাসেমলু ৪০০০০ বিদ্রোহী নিয়ে বিদ্রোহ করে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ইরানি কুর্দিস্তানের পুরোটা দখল করে নেন।
ইরাক তার প্রথম ব্যাচের মিরেজ এফ-১ ফাইটার জেট পায় ফ্রান্স থেকে। এই বিমানগুলোকে ৭৯ স্কোয়াড্রনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মিরেজ জেটগুলোকে রাখা হয় ফরাসি সহযোগিতায় মসুলের কাছে তৈরি করা সাদ্দাম বিমানঘাঁটিতে। ওদিকে ইরানে আজারি বিদ্রোহ তীব্র হয়। দেশের অভ্যন্তরে মার্ক্সবাদী বিপ্লবী পিপলস মুজাহেদীন নাশকতা শুরু করে।
ইরানি বিমানবাহিনী নতুন আক্রমণের প্ল্যান করে। কর্নেল জাভেদ ফাকৌরি এক নবীন স্কোয়াড্রন লিডারের সহায়তায় ইরাকি এইচ-৩ বিমানঘাঁটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এইচ-৩ ঘাঁটি ছিল জর্দান সীমান্তের একটি ঘাঁটি, যেটা ছিল ইরানি ফ্যান্টমের পাল্লার বাইরে। এইজন্য এখানে ইরাকি ডিফেন্স ছিল দুর্বল। এখানেই ইরাক রেখেছিল তাদের টুপোলেভ হেভি বোম্বারগুলো। এছাড়াও ফ্রান্স থেকে আসা মিরেজ ফাইটারগুলো জর্দানের মধ্যে দিয়ে এই ঘঁটিতে এনে রাখা হত। এই ঘাঁটিতে ছিল মিশরীয় ও জর্দানি টেকনিশিয়ানরা। এত কিছু থাকার পরও প্রতিরক্ষায় ছিল এক স্কোয়াড্রন মিগ আর পুরনো স্যাম সিস্টেম।
এরকম একটা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য ইরানি বিমানবাহিনীর শক্তি ছিল কম, তবুও এই ঝুঁকিটা নিলেন কর্নেল ফাকৌরি। এরিয়াল ফটোগ্রাফের মাধ্যমে জানা গেল, ঘাঁটিতে ছড়ানো ছিটানো আছে ৫০টি ফাইটার প্লেন। ইরাকি সেনাবাহিনীকে এড়ানোর জন্য সিরিয়ার মধ্যে দিয়ে একটা করিডোর প্রয়োজন ছিল ইরানের। হাফিজ আল আসাদকে অনুরোধ করা হল কয়েকঘণ্টার জন্য ইরানি ফাইটারগুলোকে ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য। উনি খুশিমনেই তা করে দিলেন।
আটটি ফ্যান্টম আর চারটি টমক্যাট বাছাই করা হল এই অপারেশনের জন্য। এছাড়াও রইল দুই স্কোয়াড্রন টাইগার। ফ্লাইং কমান্ড পোস্ট হিসেবে রইল একটা বোয়িং ৭৪৭, রিফিউয়েলিং এর জন্য রইল চারটে বোয়িং ৭০৭। হামাদান ঘাঁটি থেকে উড়ে গেল এই বহরটা। টাইগারগুলো ইরাকে ঢুকে ব্যস্ত রাখল তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে। এই সুযোগে পেছন দিয়ে ঘুরে এইচ-৩ ঘাটিতে আক্রমণ করল ইরানি ফাইটারগুলো। তখন বাজে সকাল আটটা পনেরো। আকস্মাৎ এই আক্রমণে হতভম্ব হয়ে গেল ইরাকিরা। বুঝে ওঠার আগেই মিগগুলোকে গ্রাউন্ডেড করে ফেলল ইরানি ফ্যান্টম। পরপর চারবার বোমাবর্ষণ করা হলো ঘাঁটিতে। ধ্বংস হয়ে গেল ৪টা মিগ-২১, ৮ টা মিগ-২৩, ৫টা সু-২০, ২টা নতুন মিরেজ, ২টা টু-১৬ হেভি বোম্বার আর ৩টা ট্রান্সপোর্ট প্লেনসহ ৪০টা বিমান। আরো পনেরোটা বিমান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হল। এক আঘাতে ইরাকের বোম্বার ফ্লিটের অর্ধেক ধ্বংস করে ফিরে এলো ইরানিরা। তখনো স্যাম চালু করতে পারেনি ইরাকিরা।
এই আঘাতের পরপরই নতুন আঘাত আসে ইরাকের ওপর। আর ওই আঘাতে নস্যাৎ হয়ে যায় সাদ্দামের বিমানবাহিনীর সমস্ত নির্ভরযোগ্যতা।
ওশিরাকের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিল ইজরেল। তাদের ধারণা ছিল সাদ্দামের হাতে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট থাকা মানেই তা ইজরেলের জন্য হুমকি। এজন্য ফ্রান্সে অমান্ডো আক্রমণ এবং এই প্রজেক্টের সাথে জড়িতে বিজ্ঞানীদের হত্যা করার পর ইজরেল সিদ্ধান্ত নেয়, ওশিরাকে বিমানহামলা করে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ধ্বংস করে দেয়া হবে। ১৯৮১ সালের শুরু থেকেই এই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে ইজরেলি বিমানবাহিনী। ১৯৮১ সালের মে মাসে ইরানে উপস্থিত হয় ইজরেলের এজেন্ট, দেখা করে খোমেনির দূতের সাথে। ইরানের কাছ থেকে ইজরেল জানতে চায় ওশিরাকে চালানো ইরানি হামলার কথা। ১৯৮০ সালে ইরানি বিমানবাহিনী ‘অপারেশন স্কর্চ সোর্ড’ পরিচালনা করেছিল ওশিরাকের ওপর। সেসময় ইরানের হাতে তথ্য ছিল না সেটায় ইউরেনিয়াম আছে কিনা; নিউক্লিয়ার ফল আউটের ভয়ে কেমিক্যাল স্টোরেজ আর কন্ট্রোল সেন্টার ধ্বংস করে এসেছিল তারা। ইজরেল জানত, ওশিরাকে তখনো নিউক্লিয়ার ফিউয়েল দেয়া হয়নি। ১৯৮০ সালে ইরানি ফ্যান্টমের তোলা এরিয়াল ফটোগ্রাফ ইজরেলকে একটা মেটাল কন্টেইনারে ভরে দেয় ইরান। এসকল তথ্য পাবার পর পুরোদমে শুরু হয় ইজরেলের পরিকল্পনা। এর নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন অপেরা’।
এই অভিযানে ইজরেল নিযুক্ত করে একদম নতুন আটটা এফ-১৬ আর ছয়টা এফ-১৫। দেয়া হয় ইজরেলের সেরা পাইলটদের। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিল ইজরেলের সেরা এফ-১৬ পাইলট লে. কর্নেল জীভ রাজ। এই দলের সবচেয়ে তরুণ সদস্য ছিল লেফটেন্যান্ট ইলান রামোন- যে পরবর্তীতে ইজরেলের প্রথম মহাকাশচারী হয়েছিল। ইজরেল জানত এই মিশনটা অত্যন্ত কঠিন- এজন্য একটা সি-১৩০ বিমান আর দুটো সিএইচ-৫৩ হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো নামানো হয়েছিল সৌদী আরব আর জর্দানের সীমান্তে, যাতে যেকোনো দুর্ঘটনায় পাইলটকে উদ্ধার করে আনা যায়।
৭ জুন ভোর চারটেয় এই বিমানবহর উড়ে যায় সাইনাইয়ে অবস্থিত এৎজিয়ন আমেরিকান বিমানঘাঁটি থেকে। আকাবা উপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে জর্দান সীমান্ত দিয়ে সৌদী আরবে প্রবেশ করে। এসময় তারা জর্দানি রেডিও সিগন্যাল আর ফ্লাইং ফর্ম্যাশন অনুসরণ করছিল এবং আরবিতে কথা বলছিল। এতে সৌদীরা ভাবে জর্দানি পেট্রল এয়ার ফরম্যাশন পথ ভুলে ঢুকে পড়েছে সৌদী সীমানায়। ইরাকে প্রবেশ করে এফ-১৬ গুলো অনেক নিচু দিয়ে উড়ে যেতে থাকে, ওদের ৮০০০ মিটার ওপর দিয়ে উড়ে যায় এফ-১৫ গুলো, যাতে যেকোন ইরাকি বিমানকে প্রতিহত করা যায় এফ-১৬ গুলোকে আঘাত করা থেকে। ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আক্রমণ শুরু হয়; মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে চৌদ্দটি ৯০০ কেজি ওজনের মার্ক-৮৪ বোমা ফেলে ধ্বংস করে দেয়া হয় পুরো ওশিরাক নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট। ফুল স্পিডে জর্দানের সীমান্ত ঘেঁষে ইজরেলে ফেরত আসে ইজরেলের ফাইটারগুলো। এই সময় জর্দানি বিমানবাহিনী যাতে আক্রমণ করতে না পারে, সেজন্য কয়েকটা এফ-১৫ জর্দান নদীর মোহনা বরাবর সীমান্তে শো-ডাউন করে।
শান্তিপূর্ণ এই প্রজেক্ট ধ্বংস করায় ইজরেলের বিরুদ্ধে বিশ্বে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে এহেন সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম ইজরেলের জন্য নতুন নয়। এর আগেও একই কায়দায় সিরিয়ার নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ধ্বংস করে দিয়েছিল ইজরেল। সাদ্দাম হোসেনের গর্ব ওশিরাক ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি আরেকবার গোড়া থেকে সব শুরু করতে চাইলেও ফ্রান্স বা সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে সাড়া দেয়নি। এতে অবশ্য শাপেবর হয় তার জন্য। নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ধ্বংস হয়ে যাবার পর পশ্চিমা দেশগুলো ইরাকের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
ওদিকে ইরানের অবস্থা শোচনীয়।
জুন মাসে ১৯৭৯ সালে সিআইএ এর এজেন্ট ভার্নন ক্যাসিনের একটা দলিল পাওয়া যায়, যেখানে বানি-সাদরকে তথ্যপাচার করার টোপ দেয়া হয়েছিল মাসে পাঁচ হাজার ডলারের বিনিময়ে। বানি-সাদর এই প্রস্তাবের কথা স্বীকার করে নেন, কিন্তু জানান, তিনি এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন বিতর্ক শুরু হয়। ১১ জুন খোমেনি বানি-সাদরের ওপর থেকে সমর্থন সরিয়ে নেন। অথচ সারাজীবন বানি-সাদর ছিলেন খোমেনির অন্ধ সমর্থক আর প্রধানতম সহযোগী। ২০ জুন তাকে ইমপিচ করা হয়। রেজিমের খুনিরা তার বাসায় আসার মাত্র কয়েক মিনিট আগে প্রধানমন্ত্রী রাজাভিকে নিয়ে পালিয়ে যান।
২৯ জুলাই মেহরাবাদ এয়ারপোর্টে সৈনিকের পোশাকে দুজন ঢুকেন। মেইনটেনেন্সের জন্য রাখা একটা বোয়িং ৭০৭ এ চড়ে বসেন তারা। প্লেনটি উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক গোলযোগের কথা জানায়। এরপর তা তুরস্কে চলে যায়। আঙ্কারায় ল্যান্ড করার পর তুরস্ক বানি-সাদরকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেখান থেকে তারা প্যারিসে চলে যান। ফ্রান্স তাদের আশ্রয় দেয়। এতে ফ্রান্স আর ইরানের মধ্যে নতুন সঙ্কট শুরু হয়। ইরান ৬২ জন ফরাসিকে জিম্মি করে রাখে। ফ্রান্স ইরানকে নতুন মিসাইল বোটের দেয়ার বিনিময়ে ফিরিয়ে আনে জিম্মিদের। লেবাননে ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিইয়ারা ফরাসি দূতাবাসে হামলা করে হত্যা করে রাষ্ট্রদূতকে।
বানি-সাদরের পলায়নের পর বিমানবাহিনীতে আরেকবার পার্জ চালানো হয়। এর ফলে ইরানি বিমানবাহিনী তার শক্তি হারিয়ে ফেলে। পরবর্তী কয়েকবছরের মধ্যে ইরানি বিমানবাহিনী নতুন করে যুদ্ধের সক্ষমতা ফিরে পায়নি।
ওদিকে রাজাভির মার্ক্সবাদী দলের ক্যাডাররা দেশব্যাপী বোমাহামলা শুরু করে। ২৮ জুন এক বোমা হামলায় ৭৪ জন সঙ্গীসহ মারা যান খোমেনির উত্তরসূরী আয়াতুল্লাহ বেহেশতি, মাত্র কিছুদিন আগেই যিনি বানি-সাদরকে হটিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষমতার লড়াই থেকে। এই শুন্যস্থান থেকে উঠে আসে দুজন নবীন- আকবর হাশেম রাফসানজানি আর আলি খামেনি।
রাফসানজানি ছিলেন পার্লামেন্টের স্পিকার। খামেনি পাসদারানের কমান্ডার। এই দুইজনের সাথে তুলনীয় ফরাসি বিপ্লবের দাতোঁ আর রোবসপীয়ের। রাফসানজানি ছিলেন দাতোঁ, খামেনি রোবসপীয়ের। রাফসানজানি ক্যারিশমেটিক আর কূটনীতিতে দক্ষ; খামেনি গোঁড়া আর অনমনীয়। দুজনে সহযোগিতার ভং ধরে অপেক্ষায় থাকেন ৭৯ বছর বয়স্ক খোমেনির মৃত্যুর জন্য।
রাফসানজানি হলেন প্রধানমন্ত্রী, খামেনি প্রেসিডেন্ট। অত্যন্ত ক্যারিশমেটিক এবং দক্ষ মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিস্ট ছিলেন রাফসানজানি। তিনি ক্ষমতায় এসেই ইরাকের দখল করা ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কাউন্টার-অফেন্সিভের পরিকল্পনা শুরু করেন। এর আগে তিনি সেনাবাহিনীর উচ্চপদ থেকে প্রগতিশীলদের সরিয়ে দেন।
২৯ সেপ্টেম্বর মধ্য ইরানে একটা সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে যাত্রী ছিলেন সেনাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফাল্লাহি, বিমানবাহিনী প্রধান কর্নেল ফাকৌরি আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী কর্নেল নামজু। এই রহস্যজনক দুর্ঘটনার পেছনে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার হাত ছিল বলে ধরে নেয়া হয়। এই শুন্যপদগুলো পূরণ করেন মোল্লাদের প্রতি অনুগত সেনাকর্মকর্তারা।
২৬ সেপ্টেম্বর রাতে শুরু হয় ইরানি অফেন্সিভ, নাম ‘অপারেশন সামেন অল’-আইমাহ’ (অপারেশন এইটথ ইমাম)। এর লক্ষ্য ছিল আবাদান অবরোধ ভেঙে দিয়ে কারুন নদীর পূর্বতীর দখল করে নেয়া। আবাদানে থাকা ইরাকি ৫ম ডিভিশন একেবারেই আচমকা এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায়। পাসদারান হিউম্যান ওয়েভ আক্রমণ চালানো শুরু করে। ২২ জন করে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হালকা অস্ত্র নিয়ে শত্রুর দিকে ছুটে যেত ইরানিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাবাহিনীর সুইসাইডাল চার্জের মতই ছিল এই আক্রমণ। এছাড়াও ইরানি ৮৮ আর্মার্ড সজ্জিত ছিল সোভিয়েত টি-৫৫ ট্যাঙ্কে, ইরাক যেসব ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতো। এতে বিভ্রান্ত হয়ে ৫০টা ট্যাঙ্ক, দুশো আর্মার্ড ভেহিকল আর সমস্ত কামান ফেলে পালিয়ে আসে ইরাকিরা। ২০০০ মানুষ হারিয়ে ইরান ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই পুনরুদ্ধার করে আবাদান। ইরাকিরা পালিয়ে এসে খুররমশাহরে রিগ্রুপ করে।
২৯ তারিখেই নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল নেজদ সুসানগার্দ উদ্ধারের জন্য অপারেশনের প্ল্যান করেন। এর নাম দেয়া হয় ‘অপারেশনতারিখ-আল কুদস’ (অপারেশন রোড টু জেরুজালেম)। এই অপারেশনে নিয়োজিত হয় ৫৫ প্যারাশ্যুট, ৯২ আর্মার্ড আর একটি পাসদারান ব্রিগেড। ২ ডিসেম্বর শুরু হয় আক্রমণ। প্রবল বর্ষণের মধ্যে এমন আক্রমণ আশাও করেনি ইরাক। পাসদারান ব্রিগেড ৩ ডিসেম্বর আক্রমণ করে বোস্তান শহর। টানা তিনদিনের লড়াইয়ে আড়াই হাজার প্রাণের বিনিময়ে দখল করে নেয়া হয় বোস্তান।
কাসর-আল শিরিনে চালানো হয় ‘অপারেশন মাতলা-উল ফজর’ (অপারেশন ডন)। ভয়াবহ আবহাওয়ার মাঝেও ইরানি ১৫ মাউন্টেন ব্রিগেড, তিনটে পাসদারান আর ১৬ ও ৮১ আর্মার্ডের চারটে ট্যাঙ্ক ব্রিগেড আক্রমণ চালিয়ে যায়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে ইরাকিরা পিছু হটে।
১৯৮১ সালের শেষে ইরাকের দখল করা ৪০% জায়গা পুনরুদ্ধার করে নেয় ইরান।
১৯৮২ সালের প্রথমেই বিরাট ধাক্কা খায় ইরাক। ইরাকের অয়েল পাইপলাইনের একটা শাখা ইরাকের কিরকুক থেকে সিরিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে বানিয়াস বন্দর দিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতো। আরেকটা শাখা কিরকুক থেকে তুরস্কের মাঝ দিয়ে গিয়ে দরতিয়েস বন্দর দিয়ে রপ্তানি করতো। এর আগে ইরাকের দুই অয়েল টার্মিনাল ধ্বংস করে দিয়েছিল ইরান ‘অপারেশন মোরাভিদ’ চালিয়ে। ইরান হাফিজ আল আসাদকে প্রস্তাব দেয় কিরকুক-বানিয়াস পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়ার জন্য। হাফিজ যুক্তি দেখান এই পাইপলাইন থেকে সিরিয়া নিজের জন্য তেল নেয়, আর বাকিটুকুর জন্য রাজস্ব পায়। ইরান মার্চে প্রস্তাব দেয়, বছরে ৯০ লাখ টন তেল দেবে সিরিয়াকে, যার ৮০% কম দামে আর ২০% ফ্রি। এছাড়াও সিরিয়ার নিম্নমানের পণ্য কেনার কথা বলে ইরান, যা থেকে সিরিয়া বছরে এক বিলিয়ন ডলার আয় করবে । এই সুবিধে পেয়ে হাফিজ বন্ধ করে দেন পাইপলাইন। এই ধাক্কা সামলাতে বেশ কষ্ট হয় সাদ্দামের জন্য। জর্দানের আকাবা দিয়ে নতুন পাইপলাইন বানাতে চান তিনি, সেখানেও বাগড়া দেন হাফিজ। সাদ্দাম তুরস্কের মাঝ দিয়ে নতুন আরেকটা পাইপলাইন বানানোর প্রকল্প হাতে নেন। সেটা শেষ হবার আগে ইরাকের অবস্থা হয়ে যায় শোচনীয়। তখন সাদ্দাম সৌদী আরবের কাছে সাহায্য চান। সৌদীর নতুন বাদশা ফাহাদ সাদ্দামকে ব্যবহার করে ইরাকের ওপর নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে চান। তিনি সৌদীর দাহরান বন্দর পর্যন্ত নতুন পাইপলাইন তৈরি শুরু করেন। তিনি সাদ্দামকে আরো বেশি করে ঋণ দিতে থাকেন। তুর্কি পাইপলাইন শেষ হয় ১৯৮৪ সালে, আর সৌদী পাইপলাইন ১৯৮৫ সালে। কুয়েতের মাঝ দিয়েও একটা পাইপলাইন বানানো শুরু করেন সাদ্দাম, তবে তা শেষ হয় যুদ্ধের পরে।
১৯৮২ সালের শুরুতে ইরাক বুঝে যায়, ইরান পালটা আক্রমণ শুরু করেছে। এজন্য বিপুল পরিমাণে ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার আর কামান নিয়ে ইরাক ইরানে ‘অপারেশন আল ফওজুল আজিম’ (অপারেশন সুপ্রিম সাকসেস) পরিচালনা করে। কিন্তু তেমন ভালো ফল নিয়ে আসেনা সেটা। উলটো ইরান এক বিরাট কাউন্টার-অফেন্সিভের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এতে আনা হয় ২১, ৭৭, ৮৪ আর ৯২ ডিভিশন, ৫৫ প্যারাশ্যুট ব্রিগেড, তিনটি পাসদারান ডিভিশন, দুটো আর্টিলারি ব্রিগেড আর একটা হেলিকপ্টার ব্রিগেড। মোট এক লাখ বিশ হাজার সৈন্য আনা হয় এতে। এর বিপরীতে ইরাকের ছিল মাত্র ৪০০০০ সৈন্য আর কয়েকশো ট্যাঙ্ক। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন ফাতহ-উল মুবিন’ (অপারেশন আনডিনাইয়েবল ভিক্টরি)।
২২ মার্চ ইরানি প্যারাশ্যুট ব্রিগেড চিনুক হেলিকপ্টারে করে ইরাকি বাহিনীর পেছনে অবতরণ করে আক্রমণ করে। হতভম্ব ইরাকিদের সমস্ত কামান দখল করে নিয়ে তাদের হেডকোয়ার্টার দখল করে নেয়। ওদিকে ১০০০ সৈন্যের একেক গ্রুপ করে পাসদারান হিউম্যান ওয়েভ আক্রমণ চালায়। অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও শেষপর্যন্ত ইরাকিদের হটিয়ে দেয় তারা। ইরাকি ট্যাঙ্কগুলোর ওপর ৯৫টি ফ্যান্টম আর টাইগার ফাইটার আক্রমণ করে বেশিরভাগ ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে দেয়।
ইরাক প্রায় ৪০০ ট্যাঙ্ক হারায়, ইরান হারায় ১৯৬টা। ইরাকিদের সুশ, দেজফুল আর আহভাজ থেকে হটিয়ে দেয় ইরানিরা এই অপারেশনের মাধ্যমে। ওদিকে খুজেস্তানের বেশিরভাগই দখল করে নিয়েছে ইরান। ৬০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছিল কুর্দিদের। এভাবে ইরাক একের পর এক পরাজয় বরণ করে। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় ইরানের দিকে। এখন শুধু বাকি আছে খুররমশাহর পুনরুদ্ধার করা।
জাতিসংঘ যুদ্ধ শুরুর পাঁচদিনের মাথায় রিসোলিউশন ৪৭৯ জারি করে ইরান-ইরাক দুইপক্ষকেই নিরস্ত করতে চেষ্টা করে। প্রথমবারের মত ওয়াশিংটন আর মস্কো একমত হয়ে যুদ্ধ বন্ধের প্রচেষ্টা চালায়। সাদ্দাম বেশ কয়েকবার আলোচনার কথা বলেছিলেন, কিন্তু খামেনি আর রাফসানজানি প্রতিবারই দাবি করেন, “যাদের আলোচনার ইচ্ছা আছে তারা যেন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।” এই একগুঁয়েমিতে আলোচনা ভেস্তে যায়। ওদিকে ওয়াইসি, আরব লিগসহ সকল সংস্থা ব্যর্থ হয়। ভারত এইসময় সস্তায় তেল কিনে নেয় ইরানের কাছ থেকে। অন্যদিকে পাকিস্তান গোপনে ইরানি পাইলটদের চীনের দেয়া এফ-৬ আর এফ-৭ ফাইটার জেট চালানোর ট্রেনিং দেয়।
ওদিকে আমেরিকা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ইরানি আক্রমণের মুখে ইরাক যে টিকবে না, পেন্টাগন সেটা বুঝতে পারে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানি আধিপত্য আর তার সাথে সাথে সোভিয়েত আধিপত্য শুরু হতে পারে। এই আশঙ্কায় গোপনে আমেরিকা ইরাককে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়।
ওদিকে মস্কোও বুঝতে পারে, ইরানের সাথে তাদের বনবে না। ইরানের রেজিম আফগান মুজাহেদীনকে অস্ত্র দিচ্ছিল, একইসাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতাও করছিল। সোভিয়েত অস্ত্রে সজ্জিত ইরাক যদি ইরানের কাছে হেরে যায়, তাহলে এ অঞ্চলে সোভিয়েত প্রভাব নাই হয়ে যাবে; ইতিমধ্যেই ইয়ম কিপ্পুরের যুদ্ধে সোভিয়েত অস্ত্রে সজ্জিত মিশর আর সিরিয়ার পরাজয় বেশ ভুগিয়েছে ওদের। এজন্যই সোভিয়েত রাশিয়া ইরাককে টি-৭২ ট্যাঙ্ক, বিএমপি-১ এপিসি, সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল, তিরিশটা মিগ-২১ আর চারটে মিসাইল বোট দেয়।
ওদিকে ইরান তাদের মাটি থেকে ইরাকের শেষ আউটপোস্ট উতখাত করার সঙ্কল্প নিয়ে নতুন পরিকল্পনা আঁটে; নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন বায়তুল মোকাদ্দাস’।
অপারেশন বায়তুল মোকাদ্দাসের জন্য জেনারেল নেজদ আর জেনারেল শিরাজি সারাদেশ থেকে দুইলাখ সৈন্য জড়ো করেন। সাথে ছিল ১০০০ ট্যাঙ্ক, ৬০০ কামান আর ১০০ হেলিকপ্টার। কিন্তু বিমানবাহিনীকে তখনো ঠিকমত অ্যামোনিউশন দেয়া হতো না অথবা পাইলটদের উড়তে দেয়া হতো না। ফলে ইরানিপক্ষের একমাত্র দুর্বলতা রয়ে যায় এয়ার স্ট্রাইক।
এদিকে ইরাকের ছিল থার্ড কোরের তৃতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ, নবম আর চতুর্দশ ডিভিশন আর দশটা স্বতন্ত্র ব্রিগেডের ৬৫ হাজার সৈন্য, ৫০০ ট্যাঙ্ক আর ৫০০ কামান। তবে তাদের হাতে ছিল যথেষ্ট এয়ার সাপোর্ট।
১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল শুরু হল আক্রমণ। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে শত শত লাউডস্পিকারে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিতে দিতে পাসদারানরা আক্রমণ শুরু করে। অসংখ্য সৈন্য আক্রমণ করেছে মনে করে ইরাকি গার্ডরা পালিয়ে যায়। কারুন নদী পেরিয়ে ইরানি ৮৮ আর্মার্ড খুররমশাহরের চারদিকে ট্যাঙ্কের বেষ্টনি ঘিরে ফেলে। অপরদিকে উত্তর খুজেস্তানের দিক থেকে ৮৪তম ডিভিশন আক্রমণ করে; সুসানগার্দ থেকে আক্রমণ করে ৩০ আর ৭৭ ডিভিশন। আহভাজের দিক থেকে ইরাকি ৫ম আর ৬ষ্ঠ ডিভিশনকে হটিয়ে সেই জায়গা দখল করে ইরানি ২১ আর ৪০ ডিভিশন। চারদিকের আক্রমণে দিশাহারা হয়ে যায় ইরাকিরা। ইরাকি থার্ড কোরের কমান্ডার জেনারেল আল-কাদি ইরাক হাইকমান্ডে কল করে পরামর্শ চান; উত্তর আসে, “তুমি কোরের কমান্ডার, যা বোঝো তাই করো।”
এই সুযোগে ইরান ব্যাক আপ হিসেবে উড়িয়ে নিয়ে আসে ২৩ স্পেশাল ফোর্স ব্রিগেড, ২৫ আর ৫৮ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন।
৭ আর ৮ মে রাতে সুসানগার্দ থেকে শুরু হয় তীব্র শেলিং। ইরাকি ষষ্ঠ আর নবম ডিভিশন সীমান্তে পিছু হটে যায়। নবম ডিভিশনকে গণ্য করা হত ইরাকের সবচেয়ে বাজে ডিভিশন হিসেবে। এই অপারেশনে নবম ডিভিশন খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। এর কমান্ডার জেনারেল তালা আল-দুরি ছিলেন অপদার্থ চাটুকার। সাদ্দামের প্রতি তার আনুগত্যের জন্য সাদ্দাম তাকে পছন্দ করতেন। তাকে সরিয়ে শেষ মুহূর্তে আরেকজন জেনারেলকে কমান্ডার করা হয়; পরাজয়ের পর তাকে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ফলে ইরাকি জেনারেলদের সাহস আর দক্ষতার চরম অবনতি হয়।
৩৫০০০ সৈন্য আর একশো ট্যাঙ্ক নিয়ে খুররামশাহরের শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে ইরাকের অবশিষ্ট তিনটি ডিভিশন। খুররামশাহরে ইরাকি বাহিনী গড়ে তুলেছিল পার্শিয়ান ওয়াল নামের এক দুর্ভেদ্য ডিফেন্স লাইন। ১৯ আর ২০ মে রাতে এখানে তীব্র শেলিং করতে থাকে ইরানি আর্টিলারি। এই সুযোগে ইরানের ৫৫ প্যারাশ্যুট হেলিকপ্টারে গিয়ে শাত-ইল আরবের ব্রিজ ধ্বংস করে খুররামশাহরে থাকা ইরাকিদের পালানোর রাস্তা বন্ধ করে দেয়। হাজারে হাজার পাসদারানের হিউম্যান ওয়েভ আছড়ে পড়ে ইরাকিদের ওপর। পাসদারানদের নেতা মোহসেন রেজাই আর আলী শামখানি এটার সুপারভাইজ করেন। এই আক্রমণ পরিণত হয় মধ্যযুগীয় লড়াইয়ে। শহীদ হবার জন্য খোমেনির আহবানে উন্মত্ত ইরানি সৈন্যরা ইরাকিদের ওপর আছড়ে পড়তে থাকে। ইরাকি প্রতিরোধকারীরা যতই মারে, ততই যেন বেড়ে যায় আক্রমণ। ইরাকি বিমানবাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করে ইরানিদের থামাতে, কিন্তু ত্রিশটি বিমান হারিয়েও ব্যর্থ হয় তারা। ইরাকিরা নৌকায় বা সাঁতরে পার হতে চেষ্টা করে শাত-ইল আরব। মাত্র ৪০% অপর পাড়ে পৌছাতে পারে। ২৪ মে খুররামশাহরকে মুক্ত ঘোষণা করে ইরান।
এই পরাজয় ছিল ইরাকের জন্য বিরাট ক্ষতি। ইরাক ৮০০০ সৈন্য হারায়, ১৯০০০ সৈন্য বন্দী হয়, ২৫০ ট্যাঙ্ক, ৩০০ আর্মার্ড ভেহিকল আর ১০০ কামান খুইয়ে আসে। ওদিকে উন্মত্ত হিউম্যান ওয়েভের আঘাত ইরানের ওপর পড়ে। ইরান হারায় ১৫০০০ সৈনিক, ২৫০০০ আহত হয় আর ৪০০ ট্যাঙ্ক।
এই যুদ্ধ নিয়ে ইরানি ফিল্মমেকার খসরু সাইনাই একটা অনবদ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন- ‘দার কৌচেহাই ইশক’ (ভালোবাসায় গলিপথে)। অত্যন্ত আবেগঘন এই চলচ্চিত্রে ছিল না তথাকথিত প্রোপাগান্ডা বা সিনেম্যাটিক ব্যাপার। এটা ছিল যুদ্ধকে ঘির এক অসাধারণ চলচ্চিত্র।
যুদ্ধটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হয়নি। বরং তা আরো রক্তাক্ত হয়ে ওঠে পরের দিনগুলোতে।
চরম আত্মবিশ্বাসী ইরানি সেনাবাহিনী বসরা আক্রমণ করে দখল করে নেয়ার পরিকল্পনা হাতে নেন। প্রথমে তারা চেয়েছিলেন ইরানের ক্রমেই ফুরিয়ে আসা অস্ত্র-গোলাবারুদ শেষ হবার আগেই বাগদাদ আক্রমণ করতে। কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না, তাই বসরা আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। এর নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন রামাদান’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যতম বিশাল সেনাসমাবেশ করা হয় এখানে- এক লাখ আশি হাজার সৈন্য জড়ো করে ইরান, যার এক লাখই ছিল পাসদারান।
পাসদারানের সাধারণ বাসিজ ভলান্টিয়ার। প্রায় খালি হাতেই ইরাকি বাঙ্কার আক্রমণ করে এই ভলান্টিয়ারর। হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। ইরাকি সেনাবাহিনী আগে থেকেই জেনে গিয়েছিল এই অপারেশনের কথা, তাই অত্র এলাকায় থাকা তিনটি আর্মার্ড ডিভিশন এনে জড়ো করেছিল এখানে। ইরানিরা ইরাকি ট্যাঙ্কে চড়ে বসে তার মাঝে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে থাকে। প্রায় ১৬ কিলোমিটার অগ্রসর হবার পর ইরানিদের থামিয়ে দেয় ইরাকিরা। টিয়ার গ্যাস মেরে ইরানি হিউম্যান ওয়েভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় ইরাকিরা। ইরাকি মি-২৫ হেলিকপ্টার আর গ্যাজিল হেলিকপ্টার ইরানি আর্মার্ড কলামের ওপর এন্টাই-ট্যাঙ্ক ইউরোমিসাইল এইচওটি মিসাইল নিয়ে হামলে পড়ে। পূর্ব জার্মান সামরিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে গড়া এই ট্যাক্টিসে ইরানিদের প্রভূত ক্ষতি হয়। ইরাকি মিগ আর ইরানি ফ্যান্টমের মাঝে আকাশে চলতে থাকে ডগফাইট। ১৬ জুলাই বসরা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ইরানিদের তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে ইরাকিরা। শেষমুহূর্তে ইরানি কোবরা হেলিকপ্টারবহর এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায় আটকে পড়া ইরানিদে্র।
এই ভয়াবহ যুদ্ধে দুইপক্ষের প্রায় আশি হাজার সৈন্য হতাহত হয়। তাই ১৯৮২ সালে আর তেমন কোনো লড়াই হয়নি।
Feature Image Courtesy: Pinterest.com
Reference :
Reference:
- The Iran-Iraq War- Pierre Razoux, Nicolas Elliot
- Immortal: A Military History of Iran And Its Armed Forces- Steven R. Ward
- Ghosts of Halabja- Michael J. Kelly
- The Iran-Iraq War 1980-1988- Efraim Karsh
- CIA Classified Reports -RDP84T00171R000201090001-0
- Photius
- latimes
- Brookings
- BBC
- Britannica
- Globalsecurity
- CIA
- Historytoday
- Washingtonpost
- Apnews
- Iranchamber
- Chemical Weapons and the Iran-Iraq War A discussion of the UN Security Council’s response to the use of gas in the Iran-Iraq war 1980-1988