জহির রায়হান নামটি শুনলেই আপনার কী মনে হয়? হাসিমুখের একজন তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক কিংবা ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হবো’ এর রচয়িতা? নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো জহির রায়হানকে চিনেছি মাধ্যমিকের বইয়ের সেই ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের পাতা থেকে। বাস্তবিক একজন জহির রায়হান ছিলেন আমাদের ধারণার বাইরে, সময়কে ছাপিয়ে যাওয়া একজন লেখক, সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্র পরিচালক। মাঝেমাঝে আফসোস হয় না যে একজন সত্যজিৎ রায় আমাদেরও থাকতে পারতো? হ্যাঁ, জহির রায়হান ছিলেন আমাদের সেই সত্যজিৎ রায় যাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি পাকিস্তানি সেনাদের শেষ মূহুর্তের হত্যাযজ্ঞে। আসলে জহির রায়হানের অন্তর্ধান এখনো একটা রহস্যই বটে! কিন্ত সেই রহস্য ভেদ করতে না পারলেও চলুন জেনে নিই একজন অসাধারণ প্রতিভাবান বাঙালি জহির রায়হান সম্পর্কে যিনি নিজের ছোট্ট জীবন পরিসরেই বাংলাদেশকে, বাংলার মানুষের জীবনকে পরিচিত করে তুলেছিলেন বিশ্বের দরবারে।
জন্ম, শিক্ষাজীবন ও পারিবারিক তথ্য
জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন। তিনি ১৯৫০ সালে আমিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। তিনি আই.এসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন।
জহির রায়হান দু’বার বিয়ে করেন। সুমিতা দেবীর সাথে তার দুই সন্তান রয়েছে- অনল রায়হান ও বিপুল রায়হান। সুমিতা দেবীর সাথে বিচ্ছেদের পরে ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তানের নাম অপু ও তপু। জহির রায়হানের দুই স্ত্রীই ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
জহির রায়হানের সাহিত্যিক জীবন
ছোটবেলা থেকেই জহির রায়হানের ছিল বই পড়া ও লেখালেখির ভীষণ শখ। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি যখন হাইস্কুলের ছাত্র, তখন ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ‘ওদের জানিয়ে দাও’ নামে প্রথম তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এটি অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তৎকালীন নিরীহ বাঙালিদের ওপর চলমান অত্যাচারের চিত্র তার কবিতায় ফুটে ওঠে।
“ওদের জানিয়ে দাও,
ওরা আমার ভাই–বোনকে কুকুর বিড়ালের মত মেরেছে
ওদের স্টীম রোলারের নিচে
ওদের জানিয়ে দাও
ওরা দেখেও যদি না দেখে
বুঝেও যদি না বোঝে“
অল্প বয়সেই জহির রায়হান কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তখন কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। তিনি কুরিয়ারের দায়িত্ব পালন করতেন অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চিঠি ও সংবাদ পৌঁছে দিতেন। গোপন পার্টিতে তাঁর নাম রাখা হয় ‘রায়হান’। তার আসল নাম ছিল মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। পরবর্তী সময়ে তিনি জহির রায়হান নামে পরিচিত হন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ২১ ফেব্রুয়ারি যে ১০ জন প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন তিনি তাঁদের অন্যতম। অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁকে মিছিল থেকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। দেশের প্রতি জহির রায়হানের যে ভালোবাসা এবং পাকিস্তানিদের প্রতি যে ঘৃণা তা পরবর্তীতে তার বিভিন্ন লেখায় এবং চলচ্চিত্রে বার বার প্রকাশ পেয়েছে।
প্রথম বই প্রকাশের আগেই জহির রায়হানের সাংবাদিক জীবন শুরু হয়। ১৯৫০ সালে তিনি যুগের আলো পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি সম্পাদক হিসেবে প্রবাহ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ সালে তার উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ চিত্রালী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তারপর সেই অতি পরিচিত উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭১ সনে। গ্রামীণ প্রান্তিক জীবনের সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা ও সাংসারিক টানাপোড়েন কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি এখানে। এই উপন্যাসের জন্য জহির রায়হান ইংরেজি ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পান।
ভাষা আন্দোলন কে কেন্দ্র করে লেখা তার উপন্যাস ‘আরেক ফাল্গুন’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এখানে উল্লেখ্য যে ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসটি তিনি কারাগারে বসে লিখেছিলেন। কারণ জহির রায়হান ছিলেন সবসময় পাকিস্তানিদের বিপক্ষে এবং ভাষা আন্দোলনে যোগদানের জন্যই তাকে তখন গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপর ‘বরফ গলা নদী’ প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৭৬ সনে, এটি উত্তরণ পত্রিকায় প্রথমে প্রকাশিত হয়। ‘তৃষ্ণা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাথা ছিল এই বইটিতে। অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্নার আন্তর্জাতিক রূপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের আত্মকথা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘আর কতদিন’। বইটির নামের মধ্যেই যেন লেখক প্রকাশ করেছেন এক তীব্র আকুতি! এরপর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। জহির রায়হান তার স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনে ৮ টি উপন্যাস ও ২১ টি গল্প লিখেছেন।
লেখার সংখ্যা কম হলেও সাহিত্যের মান নিয়ে কোন আপস দেখা যায়নি তার লেখায়। এছাড়াও জহির রায়হানের অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে;
- পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ (প্রবন্ধ); এটি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ‘পরিচয়’ সাহিত্যপত্রের বাংলাদেশ সংখ্যায় (জুলাই ১৯৭১) এ প্রকাশিত হয়।
- অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র (প্রবন্ধ), সোভিয়েত বিপ্লবের ৫০ তম বার্ষিকী উপলক্ষে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক মহাবিপ্লব উদযাপন কমিটির (ঢাকা) স্মরণিকা ‘তরঙ্গ’-এ (নভেম্বর, ১৯৬৭) প্রকাশিত হয়।
- জহির রায়হান রচনাবলি ১ম খণ্ড
- জহির রায়হান রচনাবলি ২য় খণ্ড
জহির রায়হানের সিনেমা জগত ও বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন মাইলফলক সৃষ্টি
“আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে স্মরণীয় অবদান হচ্ছে দুটো।
একটি সিনেমার জন্ম।
অপরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম।
দুটোই বিপ্লব।
একটা চারুকলার ক্ষেত্রে।
অন্যটা সমাজ ব্যবস্থা ক্ষেত্রে।
সিনেমা মানুষের স্বষ্টি ক্ষমতাকে প্রকাশের এবং বিকাশের এক নতুন মাধ্যমের সন্ধান দিয়েছে, যার শক্তি অপরিসীম।
সিনেমা হলো কবিতা।
সিনেমা হলো উপন্যাস।
সিনেমা হলো সংগীত।
সিনেমা হলো পেইন্টিং।
সিনেমা হলো নাটক।
সিনেমা হলো বিজ্ঞান।”
রুশ বিপ্লবের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘তরঙ্গ’ পত্রিকায় ‘অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র’ লেখায় সিনেমাকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন জহির রায়হান।
জহির রায়হানের কাছে সিনেমা যে কত বড় শিল্প ছিল তা তার কাজ দেখেই ধারণা করা যায়। জহির রায়হান চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন ১৯৫৭ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ নামক উর্দু চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে। এই ছবিটি তখন মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে উল্লেখযোগ্য একটি পুরস্কার জিতে নেয়। একই সালে তিনি সালাউদ্দীন এর পরিচালনায় ‘ঐ নদী মরুপথে’ নামক চলচ্চিত্রেও সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ‘এ দেশ তোমার আমার’ এর নামসঙ্গীত পরিচালনা করেন। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ নামের এক ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে। এই ছবিটি ব্যবসাসফল হয়নি, তবে এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী কাহিনী যা তখন সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ভাষাশৈলী ও নির্মাণশৈলীর দিক থেকেও প্রথম ছবিতেই নিজের মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন জহির রায়হান। ‘কখনো আসেনি’ ছবি মুক্তির দিনের একটি প্রচারণায় বলা হয়েছিল ‘‘যে ছবি এই দেশ ২০ বছর পরে দেখবে বলে আশা করেছিল তা ২০ বছর আগেই দেশকে উপহার দিলো এদেশের তরুণরা।”
এরপর ১৯৬২ সালে কলিশ শরাফীর সাথে যৌথভাবে নির্মাণ করেন ‘সোনার কাজল’। ১৯৬৩ সালে শ্রেষ্ঠ বাংলা ছবি হিসেবে পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে এই সিনেমাটি। জহির রায়হানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ১৯৬৩ সালে বানানো ‘কাচের দেয়াল’ সিনেমাটি। এটি নিগার পুরস্কার, পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার, ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সার্টিফিকেট অফ মেরিট’ পুরস্কার পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ছবিটিও ব্যবসাসফল হয়নি তার। কিন্তু এই ছবির জন্যে জহির রায়হানকে ঋত্বিক ঘটকের মতো চলচ্চিত্র পরিচালকের সাথে তুলনা করা হয় তখন। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় জহির রায়হানের পরিচালনায় পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ যা দেশের চলচ্চিত্র জগতে এক নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করে।
এর পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালে উর্দু ভাষায় বানানো ছবি ‘বাহানা’ দেশের প্রথম সিনেস্কোপ চলচ্চিত্র ছিল। সেই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে টিকিয়ে রাখতে লোককথা নির্ভর ছবি বানানো শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের জনপ্রিয় ছবি রূপবানের ধারাবাহিকতায় জহির রায়হানও সেরকম বানিয়েছিলেন বেহুলা (১৯৬৬)। কিছুদিন বাদেই দর্শকের একঘেয়েমি চলে আসে এ ধরনের ছবির উপর। তাই বাংলা চলচ্চিত্রে আবার অন্য ধারা শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে জহির রায়হান ‘আনোয়ারা’ নির্মাণ করেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান এর ক্লাসিক ‘আনোয়ারা’ অবলম্বনে।
জহির রায়হানের পরিচালনায় ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’ কে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য সংবলিত চলচ্চিত্র। ছবিটির পোস্টারে ছিল ‘একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা, একটি আন্দোলন’। পারিবারিক সংকট ও কিছুটা হাস্যরসপূর্ণ একটি বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়েও জহির রায়হান পাকিস্তানি অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন তা ১৯৭০ এর সেই সংকটপূর্ণ সময়ে আর কোনো পরিচালক দিতে পারেননি। এই ছবির শুটিং চলাকালে একদিন ছবির নায়ক রাজ্জাককে আর্মিরা গ্রেফতার করে। এমনকি মুক্তির পরদিনই সব হলে নিষিদ্ধ করা হয়। এই সিনেমাটি ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এর স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এবং বড় পর্দায় বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। এ সিনেমাতেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারির ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটি ছিল। আবার একই সাথে সিনেমার একটি দৃশ্যে প্রতিবাদী বাঙালির রূপ বোঝাতে আনোয়ার হোসেনের কন্ঠে নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটিও ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার হাস্যকরভাবে রেডিও টিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করে দেয়। এর কয়েক বছরের মাথায়ই জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে প্রথম বারের মত কোন সিনেমায় ব্যবহার করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর এ গানটিই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায়। ‘জীবন থেকে নেয়া’ই ছিল জহির রায়হানের শেষ সিনেমা।
‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি জহির রায়হানের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমাও বটে। এই সিনেমায় জহির রায়হান, সের্গেই আইজেনস্টাইনের বিখ্যাত ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ চলচ্চিত্র অনুসরণে ক্লোজ আপ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য শট ব্যবহার করেন। জহির রায়হান তার সিনেমা জীবনে সোভিয়েত চলচ্চিত্র দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত ছিলেন।
সারা বিশ্বকে চমকে দেয়া প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’
জহির রায়হান কর্তৃক নির্মিত তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র। ২০ মিনিটের এই ডকুমেন্টারিতে তিনি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচারের নির্মম চিত্র তুলে ধরেছেন।
জহির রায়হান এই ডকুমেন্টারিটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসে। জুন মাসে মাত্র এক মাসের মধ্যে তিনি এর কাজ শেষ করেন। এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে তাকে সহায়তা করেন আলমগীর কবির। তিনি এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন সাংবাদিকের নেয়া ফুটেজ থেকে বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে দিয়ে। সেখানে বিদেশি সাংবাদিকেরা পাকিস্তানিদের বাংলাদেশিদের উপর অত্যাচার ও নির্বিচারে মানুষ হত্যা করার এবং হাজার হাজার গৃহহীন বাঙালি ও শরনার্থীদের ভিডিও ধারণ করেছেন। জহির রায়হান সেইসব ফুটেজ থেকে এমনভাবে ‘স্টপ জেনোসাইড’ নির্মাণ করেন যা বাইরের বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় পাকিস্তানিদের নির্মমতা সম্পর্কে। প্রামাণ্যচিত্রে ফুটেজে একটি মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প কমান্ডারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে যিনি বলেন যে এই যুদ্ধ অন্যায়ভাবে বাংলাদেশিদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরে তীব্রভাবে জানানো হয় যে ইয়াহিয়া খান তার নৃশংসতায় হিটলার, মুসোলিনী, গজনীর সুলতান সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই সাথে তিনি বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র প্রত্যাশা ও দৃঢ়তা বর্ণনা করেছেন।
জহির রায়হান এখানে এক পর্যায়ে দেখান এক ১৬ বছর বয়সী কিশোরীর মুখ যাকে ৬ জন পাকিস্তানি সেনা ধর্ষণ করে এবং কিশোরীটি সেই প্রচন্ড শক থেকে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ যখন ভাবছে যে আধুনিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং মানুষের ওপর মানুষের শোষণ শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় পাওয়া যায়, ঠিক তখনি পাকিস্তানিদের এই নৃশংসতা যেন মধ্যযুগীয় এক বর্বরতা। ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রটি শেষ হয়েছে শতকন্ঠের ‘স্টপ জেনোসাইড! স্টপ!’ বলার মাধ্যমে এবং পুরো ফ্রেম জুড়ে ‘স্টপ’ কথাটি প্রকাশের মাধ্যমে যা দ্বারা জহির রায়হান নিজের জোরালো দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশের উপর হওয়া এই অন্যায় বন্ধের।
জহির রায়হান তার জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং তিনি ছিলেন একজন মুক্তিকামী মানুষ। জহির রায়হান এর এক মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় যেখানে তিনি সাহসী কন্ঠে বলেছেন,
“আমি কোনো রাজনৈতিক দল-মতের নই, আমি একজন সাধারণ বাংলাদেশি এবং ফিল্মমেকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি দেখেছি যে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশিদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তার ভিডিও করেছে মুভি ক্যামেরা দিয়ে। তারা বাংলাদেশিদের নিজেদেরই জিনিস লুট করতে বাধ্য করেছে এবং সেটির ভিডিও করেছে, ছবি তুলেছে। আমি পরবর্তীতে জানতে পারি যে এগুলো তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই বলে ছেড়েছে যে বাঙালিদের উপর অবাঙালিরা আক্রমণ করছে যার ফলে তাদের এই ব্যাপারে বাধা দিতে হচ্ছে। এই পুরোটাই ছিল একটি চরম মিথ্যা।”
জহির রায়হান ‘Let There Be Light’ নামে আরেকটি সিনেমার কাজ শুরু করেছিলেন যা তিনি শেষ করতে পারেননি। এটিও ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক।
জহির রায়হানের সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’ কলকাতায় একটি শো হয়, সেসময় তিনি কলকাতা যান। এই সিনেমা দেখার পরেই সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের মতো পরিচালকেরা তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। অত্যন্ত অর্থকষ্টে থাকা সত্ত্বেও জহির রায়হান এই সিনেমার শো থেকে পাওয়া সব অর্থ বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে সাহায্য করেন।
পুরস্কার
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য নিম্নোক্ত পুরস্কারসমূহ লাভ করেন:
- ১৯৬৪: হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
- ১৯৬৫: কাচের দেয়াল চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র বিভাগে নিগার পুরস্কার
- ১৯৭২: গল্প সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার – ১৯৭১ (মরণোত্তর)
- ১৯৭৭: শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক (মরণোত্তর)
- ১৯৯২: সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর)
- ২০০৫: হাজার বছর ধরে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (মরণোত্তর)
যেভাবে হারিয়ে গেল নক্ষত্র!
১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধের একদম শেষ দিকে পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারলো যে এই যুদ্ধে বাংলাদেশিদের জয় সুনিশ্চিত, তখন তারা শেষ চেষ্টা করলো ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে। সেই দিনে জহির রায়হানের বড় ভাই লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারকেও ধরে নিয়ে যায় তারা এবং হত্যা করে। যুদ্ধ শেষ হবার পর জহির রায়হান বাড়ি ফিরে জানতে পারেন এই সংবাদ। ১৯৭২ এর ২৮ শে জানুয়ারি এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ফোনে তাকে জানান যে মিরপুর ১২ নং হাউজিং এ তার ভাইকে আটকে রাখা হয়েছে। জহির রায়হান নিজের কথা চিন্তা না করে সাথে সাথেই ছুটে যান সেখানে। ধারণা করা হয় যে সেদিন মিরপুরে বিহারী ক্যাম্পে গোলাগুলির মধ্যেই হয়তো জহির রায়হান নিহত হন কিংবা পাকিস্তানিরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন থেকেই নিখোঁজ হয়ে যান বাঙালির এই ক্ষণজন্মা নক্ষত্র। সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩৭ বছর। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনেই জহির রায়হান আমাদের যা দিয়েছেন, তিনি বেঁচে থাকলে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র যে সাফল্যের শীর্ষ শিখরে পৌঁছে যেত এবং বাংলা চলচ্চিত্রের জন্যে দর্শকরা হলমুখী হতো তা বলাই বাহুল্য।
Feature Image Courtesy: newsbangladesh.com