আপনি যদি ইউরোপের মানচিত্র ভালো লক্ষ্য করেন তাহলে বাল্টিক সাগরের পাশ ঘেঁষে পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ার মাঝখানে মাত্র ৫,৮০০ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট রাশিয়াকে খুঁজে পাবেন। হ্যাঁ, ছোট্ট রাশিয়া, ভুল পড়েননি! রাশিয়ার এই প্রদেশের নাম কালিনিনগ্রাদ, রুশ ভাষায় যাকে কালিনিনগ্রাদ অবলাস্ট বলা হয়। রাশিয়ার মূল ভূখন্ড থেকে কালিনিনগ্রাদ অবলাস্টের দূরত্ব প্রায় ৪,৬৭৭ কিলোমিটার! সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ প্রদেশ হয়ে উঠেছে ইউরোপের ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ গুলোর গলার কাটা। কিন্তু কেন কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, কেনই বা কালিনিনগ্রাদ ইউরোপের ন্যাটো জোটভুক্ত দেশ গুলোর চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? চলুন তাহলে ইতিহাস থেকে জানি।
কালিনিনগ্রাদের ইতিহাস:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাম্রাজ্যের পতন
মধ্যযুগ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত কোনিসবার্গ (বর্তমান কালিনিনগ্রাদ) ছিল প্রুশিয়া তথা জার্মান সাম্রাজ্যের (১৮৭১-১৯১৮) দখলে৷ কোনিসবার্গ ছিল পূর্ব প্রুশিয়ার রাজধানী। শুধু সাংস্কৃতিক, স্থাপত্যে বা বন্দরের জন্য নয়, ভৌগোলিক কৌশলগত কারণেও কোনিসবার্গ ছিল জার্মান সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী। আধুনিক জার্মানির জনক অক্টো ফন বিসমার্কের দক্ষ ও চতুর বৈদেশিক নীতি এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কারের ফলে জার্মান সাম্রাজ্য ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটায়।

কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সাম্রাজ্যের পরাজয় ও পতনের ফলে জার্মানিকে বাধ্য হয়ে একপেশে, মানহানিকর ভার্সাই চুক্তিতে সাক্ষর করতে হয়। ১৯১৯ সালের এই ভার্সাই শান্তি চুক্তির মাধ্যমে জার্মান সাম্রাজ্যের অনেক ভূখণ্ড মিত্র শক্তি ক্ষতিপূরণ হিসেবে দখল করে নেয়। পশ্চিম প্রুশিয়ার কিছু অঞ্চলের পাশাপাশি পোসেন, বাল্টিক সাগরের একটি করিডোর এবং সাইলেশিয়ার কিছু অঞ্চলও পোল্যান্ডকে দিয়ে দিতে হয়। তবে পূর্ব প্রুশিয়া জার্মান দখলেই থেকে যায়। পশ্চিম প্রুশিয়া ও বাল্টিক সাগরে করিডোর পাওয়ার ফলে পোল্যান্ড সমুদ্র সংযোগ লাভ করে এবং জার্মানি তার মূল ভূখন্ডের সাথে কোনিসবার্গের সংযোগ হারায়। ভৌগোলিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ডানজিক বন্দরও জাতিপুঞ্জকে দিয়ে দিতে হয় এবং বন্দরের সকল অর্থনীতিক কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ পায় পোল্যান্ড।

২য় বিশ্বযুদ্ধ ও রাশিয়ার কোনিসবার্গ দখল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর জার্মানিতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। নাৎসি বাহিনী জার্মানির ক্ষমতা দখলের পর হিটলার জার্মানির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে মরিয়া হয়ে পড়ে৷ হিটলার ভার্সাই চুক্তির শর্ত একের পর এক ভাঙতে থাকে। হিটলার ডানজিক বন্দরের মালিকানা দাবি করে এবং পোল্যান্ডের ভেতর দিয়ে বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সংযোগ পথ দাবি করে। পোল্যান্ডের হিটলারের দাবি না মানাই পরবর্তীতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৯ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ও ১৯৪২ সালে নাৎসি বাহিনী পোল্যান্ড দখল করে নেয়। এর ফলে ২৪ বছর পর প্রুশিয়া আবারও জার্মানির সাথে মিলিত হয়। পোল্যান্ড দখলের পর কোনিসবার্গ হয়ে উঠে বাল্টিক সাগর ও পূর্ব ইউরোপে জার্মান আধিপত্য বজায় রাখার দূর্গ। বাল্টিক সাগর ও পূর্ব ইউরোপের সমর অভিযান কোনিসবার্গ থেকেই পরিচালনা করা হতো। ১৯৩৯ সালে জার্মানি-সোভিয়েত নিজেদের মধ্যে নন-আগ্রেশন চুক্তি করলেও হিটলার ২ বছর পর ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করে। এর ফলে জোসেফ স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি ২য় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৩ সাল নাগাদ সোভিয়েত রেড আর্মি ধীরে ধীরে নাৎসি বাহিনীকে পরাজিত করে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্তৃত্ব কায়েম করে। ১৯৪৫ এর এপ্রিলে রেড আর্মির কাছে কোনিসবার্গের পতন ঘটে। যুদ্ধ শেষে পূর্ব প্রুশিয়া পোল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে ভাগ করা হয়৷ কোনিসবার্গ সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে যায়। সাবেক বলশেভিক নেতা মিখাইল কালিনিনের স্মরণে সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনিসবার্গের নাম পরিবর্তন করে রাখে কালিনিনগ্রাদ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং কালিনিনগ্রাদের ভাগ্য
কালিনিনগ্রাদ দখলের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সেখানকার জার্মানদের বিতাড়িত করে এবং প্রচুর রুশ নাগরিককে সেখানে অভিবাসন করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয় এবং ১৫ টি নতুন রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। পূর্ব ইউরোপ অংশে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার সাথেই থেকে যায়। এর ফলে রাশিয়ার মূল ভূখন্ডের সাথে তৈরি হয় হাজার মাইলের দূরত্ব।
কেন কালিনিনগ্রাদ এত গুরুত্বপূর্ণ ?
অর্থনৈতিক কারণ:
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধ হারার পাশাপাশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হারায়। বিশেষ করে উষ্ণজলের সমুদ্রবন্দর গুলো হারায়। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম বড় শর্ত হচ্ছে সমুদ্রপথে সহজ ও সাবলীল বানিজ্য। কালিনিনগ্রাদ ছাড়া রাশিয়ার কোন অঞ্চলের সমুদ্রবন্দর গুলো উষ্ণজলের নয়। সেন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর, ভালডিভস্টক বন্দর শীতকালে সম্পূর্ণ বরফে আচ্ছাদিত থাকে। তাই সে সময় সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য কালিনিনগ্রাদের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়।

সামরিক কারণ:
সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের পাশাপাশি মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক সংগঠন ন্যাটোতেও যোগদান করে। এর ফলে পূর্ব ইউরোপে আমেরিকান বলয় তৈরি হয়েছে যা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য সবসময়ই একটি চাপের কারণ।

ভূ-রাজনীতিক অবস্থানের কারণে কালিনিনগ্রাদ কৌশলগত দিক দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। কালিনিনগ্রাদের চেরনিয়াখভস্ক বিমানঘাঁটি এবং এর ভৌগলিক অবস্থান মস্কোকে বাল্টিক সাগর অববাহিকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়। রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোকে চাপে রাখতে কালিনিনগ্রাদে প্রায় ১১ হাজার রুশ প্রতিরক্ষা বাহিনী সবসময় মোতায়েন করে রাখে। ২০১৬ সালে রাশিয়া প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করার জন্য সেখানে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ও ভোরোনেজ ডিএম রেইডার সিস্টেম মোতায়েন করে যা কিনা ৬০০০ কিলোমিটারের বেশি মনিটর করতে সক্ষম। রাশিয়ার এরোস্পেস ডিফেন্স ফোর্সের ৭০৫৪ তম বিমানঘাঁটিটিও এখানে অবস্থিত। ২০১৬ সালে মস্কো কালিনিনগ্রাদে পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম ইস্কান্দার মিসাইলও মোতায়েন করে। এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ফলে বাল্টিক সাগরে এখনও রুশ আধিপত্য রয়ে গেছে।
কালিনিনগ্রাদ ভূ-রাজনীতিক কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া বনাম ন্যাটো ইস্যুতে আঞ্চলিক প্রভাব ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় কালিনিনগ্রাদ একটি স্টেলমেট অবস্থার সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার পশ্চিমে আমেরিকা যেমন ন্যাটো বলয় সৃষ্টি করে ক্রেমলিনকে চাপে রাখছে ঠিক তেমনি রাশিয়াও কালিনিনগ্রাদ নেভাল এয়ার বেসকে শক্তিশালী করা ও পারমানবিক ক্ষেপনাস্ত্র মোতায়েন করার মাধ্যমে ন্যাটো জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে অদৃশ্য হুমকি প্রদান করছে।
Feature Image Courtesy: RussiaTrk.org