বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। গোলটেবিল বৈঠকের নামে পাকিস্তান সরকারের টালবাহানা, বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ। বাঙ্গালীদের মুখে মুখে শ্লোগান ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। পরিষ্কার হয়ে গেছে পাকিস্তান টিকবে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যরা এসে হাজির। ২৫ শে মার্চের কালরাতে শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ঘুমন্ত নিরীহ বাঙ্গালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। শুরু হয় বাঙ্গালীদের প্রতিরোধ। শুরু হয় যুদ্ধ। ১০ ই এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানীর যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সমগ্র দেশকে ৪ টি এবং পরে ১১ ই এপ্রিল ১১টি সেক্টর ও ৬৪ টি সাব সেক্টরে ভাগ করেন। ঢাকা-কুমিল্লা, আখাউড়া, ভৈরব, নোয়াখালী ও ফরিদপুরে কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় সেক্টর ২। এই সেক্টর ২ এর-ই কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এম খালেদ মোশাররফ।

মেজর কে এম খালেদ মোশাররফকে ক্র্যাকডাউনের সময়ই মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে কুমিল্লা থেকে সিলেটের শমশেরনগরে পাঠানো হয়েছিল। ২৪ মার্চ সকালে খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড অফিস কুমিল্লা তে উপ-প্রধান হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল খিজির হায়াত খান তাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি খালেদ মোশাররফকে জানান, সিলেটের শমসেরনগরের নকশালপন্থীদের বেশ তৎপর দেখা যাচ্ছে এবং ভারত থেকে অনুপ্রবেশ ঘটছে। এসব কারণে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি নিয়ে তাকে সেখানে যেতে হবে তাদের দমন করতে।

খালেদ মোশাররফ; Image Courtesy: ittefaq.com.bd

খালেদ মোশাররফ সন্দেহ করেছিলেন পাকিস্তানিরা কিছু একটা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই কোম্পানির জন্য পাঠানো হয়েছে আবার তাকে আরেক কোম্পানির সৈন্য নিয়ে শমশেরনগর যেতে বলা হচ্ছে। খালেদ মোশাররফ একটুখানি সাবধান হয়েছিলেন। তিনি মেইন রোডে না গিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে শমশেরনগর যান। গিয়ে দেখেন সেখানে কোন নকশালপন্থীদের চিহ্নই নেই। তাকে মিথ্যে সংবাদ দিয়ে এখানে পাঠানো হয়েছে। পরে তিনি জানতে পারেন, মৌলভীবাজারের কাছে মেইন রোডের পাশে এক কোম্পানি পাকিস্তানী সৈন্যের ভেতর লুকিয়ে ছিল তাকে এম্বুস করার জন্য। দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।

২৬ শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদ মোশাররফের নির্দেশে মেজর শাফায়াত জামিল, লেফটেন্যান্ট কবির আর লেফটেন্যান্ট হারুন বিদ্রোহ ঘোষণা করে পাকসেনাদের গ্রেপ্তার করেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রু মুক্ত করেন তারা। আর ২৭ মার্চ সিলেট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছেন মেজর খালেদ মোশাররফ। সেখানে তিনি তার বাহিনীকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের যোগদানের প্রস্তুতি নেন। কৌশলগত কারণে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তার বাহিনীর সদর দপ্তর তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থানান্তর করেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত খালেক মোশাররফ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। কিন্তু তার বাহিনীর ওপর শত্রুর ঘন ঘন বিমান হামলার কারণে তিনি তার বাহিনী নিয়ে এপ্রিলের শেষের দিকে ত্রিপুরা রাজ্যের মেলাঘর এ অবস্থান গ্রহণ করেন। এই মেলাঘর-ই ছিল সেক্টর 2 এর হেডকোয়ার্টার। মেজর খালেদ মোশাররফ একাধারে ছিলেন 2 নং সেক্টরের কমান্ডার, কে ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক।

যুদ্ধের রণকৌশল ঠিক করছে খালেদ মোশাররফ; Image Courtesy: thedailystar.net

খালেদ মোশাররফ জানতেন এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে। এজন্য দরকার নিয়মিত আর্মির পাশাপাশি গেরিলা বাহিনী। গেরিলা বাহিনী সংগঠনে খালেদ মোশাররফকে সাহায্য করেছিলেন শহিদুল্লাহ খান বাদল। তিনি বাদলকে বলেন, “এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে। এর জন্য দরকার রেগুলার আর্মির পাশাপাশি গেরিলা বাহিনী। তুমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে ছেলেদের সাথে যোগাযোগ করো। যারা আসতে চায়, মুক্তিযুদ্ধ করতে চায়, তাদের এখানে পাঠাতে থাকো।” তিনি আরো বলতেন, “যুদ্ধ হবে 3 ফ্রন্টে- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক। সামরিক ফ্রন্টের জন্য রয়েছে নিয়মিত সেনাবাহিনী, অন্য দুটি ফ্রন্টের জন্য দেশের সকল স্তরের স্বাধীনতাকামী মানুষ। তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসতে হবে।” এই দিকটা পুরোপুরি সংগঠনের ভার খালেদ মোশাররফ শহীদুল্লাহ খান বাদলের উপরে দিয়েছিলেন। প্রচন্ড মেধাবী ছাত্র বাদল নিজের সুনিশ্চিত ভবিষ্যত একপাশে ঠেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে। খালেদ মোশাররফের পরামর্শ ও অনুপ্রেরণাতেই বাদল বারবার ঢাকা এসেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এক করেছিলেন ঢাকা তরুণদের। যারা যুদ্ধে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু পারছিল না, তাদের কাছ থেকে পথের নির্দেশ নিয়ে একে একে ছোট দলে ভাগ হয়ে ওপারে গিয়েছিলেন কাজী, মায়া, ফতে, গাজী, সিরাজ, মনু, রুমি, বদি, জুয়েল সহ আরো অনেকে।

মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অস্ত্র হাতে খালেদ মোশাররফ; Image Courtesy: thedailystar.net

সামরিক ও অবস্থানগত দিক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে 2 নং সেক্টর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর আওতায় ছিল ঢাকা মহানগর অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী এবং কুমিল্লা সেনানিবাস। সারা বিশ্বের নজর থাকতো ঢাকাতেই। মিডিয়া কভারেজ পেত এই ঢাকাই। আর তাই পাকিস্তান সরকার চাইতো ঢাকার পরিবেশ শান্ত রেখে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভবিক। সবকিছু স্বাভাবিক চলছে দেখানোর জন্য জায়গায় জায়গায় সেনাটহল, চেকপোস্ট। এর মধ্যেও খালেদ মোশাররফ একজন গেরিলা কে পাঠিয়ে দিতেন ছোট ছোট অপারেশন করার জন্য। খালেদ মোশাররফ এসব হামলার নাম দিয়েছিলেন সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার। মূলত পাকিস্তানী বাহিনীকে মানসিক শান্তি না দেওয়া, ক্রমান্বয়ে চাপের মধ্যে রাখা ও বিশ্ববাসীর কাছে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা যে স্বাভাবিক নেই তা বোঝানোই ছিল এই হামলাগুলোর উদ্দেশ্য। জুন মাসের প্রথম দিকে বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তারা পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন এর পরিস্থিতি দেখে অর্থ সহায়তা দেবে বলে। অর্থ সহায়তা দিলে পাকিস্তানিরা তা দিয়ে সমরাস্ত্র কেনার ও যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে যথেষ্ট সুবিধা পেত। আর তাই বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বোঝাতে হবে যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই, যুদ্ধ চলছে। তাই গেরিলারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর সামনে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কর্মকর্তারা যখন ভিতরে মিটিং করছিল তার বাইরে তাদের পার্কিং করা গাড়ি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে এবং গাড়ি ধ্বংস করে দেয়। এ ঘটনায় বিশ্ব ব্যাংক কর্মকর্তারা খুব সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বুঝতে পারে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরান ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কার্যক্রমের একটি ছবি; Image Courtesy: Kishor Parekh

খালেদ মোশাররফের হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি বিরাট এক গেরিলা বাহিনী। প্রশিক্ষণের সময় তিনি গেরিলাদের বলতেন, কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না, চায় রক্তস্নাত শহীদ। তার হাতে গড়া এই গেরিলারা ঢাকা আশেপাশে হামলা করে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া, পেট্রোল পাম্প, আর্মি চেকপোস্ট, ডিআইটি ভবনে হামলা, পাকিস্তানি আর্মির নাকের ডগায় ব্যাঙ্গালোর সহ আরো অনেক অপারেশন চালিয়ে যেত। কাকডাকা ভোরে কিংবা রৌদ্রোজ্জ্বল অপরাহ্ণে কিংবা গভীর রাতে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে এই গেরিলারা অপারেশন করে পাকিস্তানি আর্মির ভিত নাড়িয়ে দিত এবং মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের মনোবল দৃঢ় রাখত।

খালেদ মোশাররফ ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। ছিলেন শক্তিমান, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের জন্য যা ভাল মনে করেছেন তাই তিনি করেছেন। ঢাকার গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য তার প্রচুর ছেলের প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে তিনি আওয়ামী লীগের ক্লিয়ারেন্স বা ভারত সরকারের বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করেননি। তার এই দুঃসাহস, আত্মবিশ্বাস, ভবিষ্যতের দিকে নির্ভুল নির্ভীক দৃষ্টিপাত করার ক্ষমতা তাকে গেরিলা ছেলেদের কাছে করে তুলেছিল অসম্ভব জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন সেক্টর ২ এর প্রাণ।

খালেদ মোশাররফকে নিয়ে লেখা একটি বই; Image Courtesy: goodreads.com

২২ অক্টোবর কসবা যুদ্ধ পরিচালনার সময় খালেদ মোশাররফ আহত হয়েছিলেন। শেলের স্প্রিন্টার তার কপাল ফুটো করে মুখের উপর দিক ঘেঁষে লেগেছিল। প্রথমে তাকে আগরতলা হাসপাতালে নেয়া হয় এবং পরে অবস্থার অবনতি দেখা দিলে তাকে লখনৌতে সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য খালেদ মোশাররফকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান এর মধ্যে ৭ ই নভেম্বর তিনি নিহত হন। অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, মত- দ্বিমত থাকলেও ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ হারিয়েছিল একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক সৈনিককে। তার মতো অসংখ্য সাহসী দেশপ্রেমিক সৈনিকের কারণেই আমরা পেয়েছি এই মুক্ত স্বাধীন দেশ। এ দেশ ঋণী থাকবে আজীবন খালেদ মোশাররফের মত বীর সৈনিকদের কাছে।

Feature Image Courtesy: thedailystar.net