ভাবুন তো, বাঙালির চিরায়ত খাবার পান্তা ভাত, মাছ ভাজি, আলু ভর্তা আর শুকনো মরিচ পোড়া আন্তর্জাতিক মানের কোনো রান্নার প্রতিযোগিতার একজন ফাইনালিস্টের প্রধান ডিশ!
হ্যাঁ, ঠিক তাই। গত ১৩ জুলাই, ২০২১ এ ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’র ১৩তম আসরের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। দুই পর্বের এই ফাইনালের প্রথম পর্বে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয় কিশোয়ার চৌধুরী ‘স্মোকড ওয়াটার রাইস, আলু ভর্তা ও সার্ডিন’ যাকে সহজ বাংলা ভাষায় বলে পান্তা ভাত, আলু ভর্তা আর মাছ ভাজি উপস্থাপন করেন বিচারকদের সামনে। এই রেসিপি দিয়ে তিনি বিচারকদের মনও জয় করে নেন যার প্রমাণ মেলে তাকে দেয়া বিচারকদের নম্বর থেকে। চলুন, জেনে নেয়া যাক বিশ্বমঞ্চে বাংলার রান্নাকে তুলে ধরা এই বঙ্গ তনয়ার গল্প।

কিশোয়ার চৌধুরী নুপূরের বয়স ৩৮। ১৯৮৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কামরুল হাসান চৌধুরীর পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অস্ট্রেলিয়া সরকারের সর্বোচ্চ খেতাব ‘অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া মেডেল’ এ ভূষিত প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি। মা লায়লা চৌধুরী কলকাতার বর্ধমানের মেয়ে। ৫০ বছর আগেই অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমান এই দম্পতি। কিশোয়ার মেলবোর্নের মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতক এবং লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অফ আর্টস থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি একজন বিজনেস ডেভেলপার। এছাড়াও পারিবারিকভাবে তিনি প্রিন্টিং ব্যবসার সাথেও যুক্ত।

মেয়ে সেরাফিনা(৪), ছেলে মিকাইল(১২) এবং স্বামী এহতেশাম নেওয়াাজ কে নিয়ে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মেলবোর্ন শহরে বসবাস করছেন। তবে কিছুকাল তিনি জার্মানি ও বাংলাদেশেও বসবাস করেছেন। দীর্ঘসময় ধরে কিশোয়ারের বামা-মা প্রবাসে জীবনযাপন করলেও শিকড়ের টানকে তারা নিজেদের মধ্যে থেকে বিলীন হয়ে যেতে দেননি। পারিবারিক আবহে শতভাগ বাঙালিয়ানাই ধরে রাখতে চেয়েছেন তার বাবা-মা। সবসময় চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বীজ উত্তরসূরীদের মাঝে বপন করতে। যার অন্যতম দৃষ্টান্ত কন্যা কিশোয়ার চৌধুরী।
কিশোয়ারের রান্নার হাতেখড়ি তার মায়ের কাছ থেকেই। ছোটোবেলায় মাকে কেক বানাতে সাহায্য করতে গিয়েই রান্নার প্রতি তার আগ্রহ গড়ে ওঠে। পেশাদার রান্নার কোনো কোর্স কখনোই করা হয়ে ওঠেনি তার। মা ও বোনদের রান্নায় সাহায্য করতে করতে সময়ের সাথে সাথে বাঙালি রান্নার প্রতি তার ভালোবাসাটাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। মূলত, পরিবারই কিশোয়ারের রান্নার অনুপ্রেরণা।

রান্না নিয়ে কখনোই কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল না কিশোয়ারের। তবে মন থেকে চাইতেন দেশের প্রতি তার ভালোবাসা ও সম্মান যেনো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝেও ছড়িয়ে দিতে পারেন। এরই ফলশ্রুতিতে পরিবারের বিশেষত ছেলের উৎসাহে তিনি নাম লেখান ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’ সিজন-১৩ তে।
প্রতিযোগিতার প্রথমেই তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পেছনে তার কারণ কী?

উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমি অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশের খাবারের প্রচলন করতে চাই। একই সাথে বাংলাদেশি খাবারের ওপর একটি বইও লিখতে চাই যাতে করে যে কেউ সহজেই বাংলা খাবার তৈরি করতে পারেন।”
এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। আন্তর্জাতিক মানের এই রান্নার প্রতিযোগিতার মূলমঞ্চে দীর্ঘ সাত মাস ধরে ৫৭টি এপিসোডের প্রায় প্রতিটিতেই অস্ট্রেলিয় খাবারের সঙ্গে বাংলার খাবারের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি বাংলার হেঁশেলকে তুলে ধরেছেন বিশ্বমঞ্চে। কালা ভুনা থেকে শুরু করে মাছের ঝোল, আলুর দম, চটপটি, ফুচকা, সমুচা, লাউ চিংড়ি, ভর্তা, খিচুড়ি, আমের টক, খাসির রেজালা, কুলফি এমনই একের পর এক বাঙালি রান্না দিয়ে কিশোয়ার জয় করেছেন বিচারকদের মন।

প্রতিযোগিতার বিচারক আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শেফ আ্যান্ডি এলেন, জক জনফ্রিলো, মেলিসা লেয়ং কিশোয়ারের রন্ধনশৈলী, দক্ষতা, কৌশল ও অভিনবত্বের প্রশংসা করেছেন বারংবার। কিশোয়ার তার রান্না দিয়ে শুধু বিচারকদের নয় দেশ ও বিদেশের কোটি মানুষের ভালোবাসাও অর্জন করেছেন। প্রতিটি রান্নার শেষে তিনি সেই রান্নার উৎপত্তি ও বর্ণণা করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখ আর রুদ্ধ কন্ঠে বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করেছেন একাধিকবার। যা দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছে কোটি বাঙালির হৃদয়।
১১৪ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় রানারআপ নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে এই রন্ধন জাদুকরের ‘মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া’র দীর্ঘ পথ।

কিশোয়ারের মতে, ট্রফি জয় করতে না পারলেও বাঙালির হৃদয় জয় করতে পেরেছেন, যা তার বড় পাওয়া। প্রবাসে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করায় সম্প্রতি সিডনি প্রেস এন্ড মিডিয়া কাউন্সিলের কার্যকরী পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যে রান্না নারীকে চার দেয়ালের জীবনে আটকে থাকতে শিখিয়েছে, আজ সেই রান্না দিয়েই নারী বিশ্ব জয় করে চলেছে। কিশোয়ারের এই সাফল্য বাংলার ঘরমুখী নারীদের জন্য কেবল যে এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে তাই নয়, ভবিষ্যতে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলার পথে নারীকে সাহসও জোগাবে। একই সাথে বাঙালি হয়েও বাংলা সংস্কৃতির প্রতি আমাদের যে তীব্র বিমুখতা, একজন প্রবাসী হয়েও সেই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা আরও একবার আমাদের আত্মপরিচয়ের দৃষ্টিকোণকে সুগম করেছে।

কিশোয়ার বলেন, “আমার ছেলের বয়স এখন বারো। এরকম একটা বয়সে নিজের সংস্কৃতি, পূর্বপুরুষ এই বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি সবসময়ই ভাবতাম ওদের জন্য কি রেখে যাওয়া যায়।”
এই বঙ্গ তনয়ার হাত ধরে বাংলার স্বাদ আগামীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে এই প্রত্যাশা আজ সকলের।
Feature Image Courtesy:banglatribune.com