মাথাটা ষাঁড়ের আর দেহটা মানুষের, বিকট-দর্শন এক মূর্তি। শরীরে সাতটা প্রকোষ্ঠ। নিচের দিকে জ্বালিয়ে দেয়া হতো আগুন। আগুনের লেলিহান শিখা পৌঁছে যেতো সব প্রকোষ্ঠে। আর সেই শিখায় দগ্ধ হতো শিশুরা! আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নিতো তাদের!
শুনতে হয়ত খুবই অবাক লাগছে। কিন্তু বাস্তবে এমনটা ঘটেছে বহুকাল আগে, বড় একটা সময় ধরে। মোলক নামের এক অপদেবতার সন্তুষ্টির জন্য এভাবেই শিশুদের উৎসর্গ করতো কার্থেজের মানুষ!
কার্থেজ অঞ্চলটি ছিল আজকের তিউনিসিয়ার উপকণ্ঠে। ক্যানানাইট অঞ্চলের মানুষজনের উপাস্য এক দেবতা ছিল মোলক। ক্যানানাইট বলতে বোঝায় আজকের সিরিয়া, লেবানন, মিশরসহ আরবের বড় একটা অঞ্চলকে। সেমেটিক বিশ্বাস ছিল তাদের মাঝে। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল বিভিন্ন কাল্ট। মূলত তারা ছিলেন পৌত্তলিক। তাদের প্রধান দেবতা গণ্য হতো বা’ল হামোন বা বা’ল হাদাদ। বা’ল বলতে মূলত বোঝানো হয় প্রভু। এই দেবতাকে তারা মনে করতো জলবায়ু ও কৃষির নিয়ন্ত্রক। ঝড়-বৃষ্টি, রোদ-খরা কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে তারা শরণাপন্ন হতো বা’লের। তবে এই দেবতার অধীন ছিল আরো বিভিন্ন দেবতা। একেকজনের একেকরকম চাহিদা। তারা মূলত বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিষয় যা তাদের নিয়ন্ত্রণের পুরোপুরি বাইরে- সেসব থেকে বাঁচতেই তৈরি করেছিল বিভিন্ন দেবতারূপী কাল্ট। আর তার প্রতীক হিসেবে গড়ে নিয়েছিল তাদের মূর্তি।
তেমনি তারা বিভিন্ন দুর্যোগ বা সমস্যা থেকে বাঁচতে ও নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে উৎসর্গ করত শিশু- তাদের উপাস্য আরেক দেবতা মোলকের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে কোন কোন গবেষক মনে করতেন মোলক বা’ল হামোনেরই আরেকটি রূপ। তবে এমন বহু প্রমাণ পাওয়া যায় যাতে বোঝা যায় মোলক ভিন্ন আরেক দেবতা।
মোলকের নামকরণের বিষয়টি আগে দেখে নেয়া যাক। তারপর আমরা জানবো শিশু বলিদানের সেই নিষ্ঠুর ইতিহাস।
মোলক শব্দটির মূল ধাতু mlk, যার অর্থ king বা রাজা। আরবিতে মালিক বলে একটি শব্দ আছে- যার অর্থ অধিপতি। সেখান থেকেই এসেছে Melek শব্দটি, যার মানেও রাজা। এই শব্দটিই ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে উচ্চারিত হয় Moloch. এই অপদেবতার নাম অঞ্চলভেদে মোলেক, মোলোক, মেলেচ, মিলকম ইত্যাদি হিসেবেও পরিচিত।
হিব্রু বাইবেলে উল্লেখ পাওয়া যায় মোলকের। লেভিটিকাস (১৮:২১) এ উল্লেখিত হয়েছে, “ইসরায়েলের সন্তানেরা যেন শিশুবলি না করে, এটা জঘন্যতম অপরাধ। তারা যেন অপদেবতা মোলক এর কাছে কখনই বলি না দেয় নিজ সন্তানদের।” এছাড়াও আরো বিভিন্ন রেফারেন্সে এসেছে মোলকের জন্য শিশু উৎসর্গ করলে ভয়াবহ শাস্তির কথা। মোলককে চিত্রিত করা হয়েছে একজন নৃশংস অপদেবতা বা শয়তানের প্রতীক হিসেবে। কিন্তু সেসময়ের ক্যানান বা কার্থেজের অধিবাসীরা বিরত থাকেনি এই জঘন্য পাপ থেকে। বরং তারা বিভিন্ন বিপর্যয় থেকে মুক্তি ও নিজেদের পবিত্রতার জন্য বলি দান করত শিশুদের।
বলির প্রক্রিয়াটিও ছিল খুব নৃশংস। মোলকের মূর্তির শরীরে থাকতো সাতটি প্রকোষ্ঠ। প্রথম প্রকোষ্ঠে আটা, দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠে বন্য ঘুঘু, তৃতীয় প্রকোষ্ঠে ভেড়ি, চতুর্থ প্রকোষ্ঠে ভেড়া, পঞ্চম প্রকোষ্ঠে গাভী, ষষ্ঠ প্রকোষ্ঠে ষাঁড়। সর্বশেষ অর্থাৎ সপ্তম প্রকোষ্ঠে থাকত মানবশিশু।
মোলকের মূর্তির দুই হাত থাকতো দুইদিকে ছড়ানো। যন্ত্র চালনার সাহায্যে হাত দুটোকে নিয়ে আসা হতো কাছাকাছি। তারপর সেই হাতদুটিতে রাখা হতো শিশুদের। একবারে সাধারণত বলি দেয়া হতো একজন শিশুকে। যন্ত্রের সাহায্যে মোলকের হাত দুটিকে নিয়ে আসা হতো বুকের কাছাকাছি। হাতে ধরা শিশুটি তখন পড়ে যেতো ভেতরে। দগ্ধ হতে থাকতো লেলিহান আগুনে। শিশুদের কান্নায়, আর্ত চিৎকারে ভারি হয়ে উঠতো বাতাস। আর সেই কান্না, আর্তনাদ চাপা দিতে জোরে, অনেক জোরে বাজানো হতো ড্রাম-ট্যামবুরিনজাতীয় বাদ্যযন্ত্র!
তবে বাইবেল বা হিব্রু ভাষার বিভিন্ন গ্রন্থে মোলকের এই নৃশংস রূপের কথা বর্ণিত হলেও অনেক গবেষক আবার মনে করেন পুরো বিষয়টিই অতিরঞ্জিত। সেসময়ের যে ইতিহাস আমরা জানতে পারি তা মূলত রোমানদের লেখা ইতিহাস। ক্যানানাইটের অধিবাসীদের পরাজিত করে একসময় জায়গাটি দখলে নেয় রোমান সৈন্যরা। তাই তাদের লেখা ইতিহাস কতটা বস্তুনিষ্ঠ- তা নিয়ে অনেক গবেষকই প্রশ্ন তুলেছেন।
আবার, রা’ব্বি বা ইহুদী ধর্মগুরুদের অনেকেই মনে করেন মোলক বলে আসলে এমন কোন দেবতা ছিল না। এটা শুধু একটি কাল্ট। তাদের অনেকেরই মত এমন, মূলত জেরেমিয়াহ বা এমন বিভিন্ন গ্রন্থে Passing through Fire বলে শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছে, তা মূলত শিশুদের পবিত্র করা বা আগুনের পাশে ধরে রেখে হালকা আঁচে পবিত্র করানোকে বোঝায়। তারা মনে করেন এভাবে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে শিশুহত্যার তেমন কোন সত্যতা নেই।
তবে এই মত সমর্থন করেননি দ্বাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত রা’ব্বি স্কোলোমো ইয়েতচিজ, যিনি রাশি নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। তিনি জেরেমিয়াহ (৭:৩১) এর রেফারেন্স দিয়ে বলেন মোলকই টোফেট। তার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো শিশুদের। তথাকথিত পবিত্রতার নামে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হতো শিশুদের।
এখানে টোফেট শব্দটির মানে পরিষ্কার হওয়া দরকার। টোফেট বলতে মূলত এমন জায়গা বোঝানো হয় যেখানে এই শিশু বলিদানের ঘটনা ঘটানো হতো। এটা হতে পারতো কোন মন্দির বা উপাসনার স্থান, অথবা এমন কোন জায়গা যাকে পবিত্র মনে করা হয়। জেরুজালেমের বেন-হিনোম উপত্যকা ছিল এমন একটি স্থান। সেখানে সমাধিসম্ভগুলো আলাদাভাবে ভল্ট নির্মাণ করে ঘিরে রাখা হয়েছিল। আজও ঘৃণ্য শিশুবলির একটি প্রতীক হয়ে রয়ে গেছে জায়গাটি।
সেই ৫৪৬ খি.পূর্বাব্দে সেকেণ্ড টেম্পল পিরিয়ড এর সময় থেকে যে ঘৃণ্য উপায়ে অপদেবতা মোলকের পূজার প্রথা চলে আসছিল, তা অন্তত ৭০-১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্তও বেশ ভালোভাবেই প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ অস্বীকার করলেও সামগ্রিক প্রমাণ সাক্ষ্য দেয় মোলকের উপাসনায় উৎসর্গিত অপরিমেয় শিশু মৃত্যুর।
সাহিত্যেও বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে মোলকের প্রসঙ্গ। জন মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট থেকে শুরু করে এলেন গিন্সবার্গের হউল পর্যন্ত বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে মোলককে চিত্রিত করা হয়েছে রক্তলিপ্সু ও শয়তানের সহযোগী হিসেবে।
এখনো পৃথিবীতে মোলক বা এ ধরণের অপদেবতাদের কিছু গোপন অনুসারী আছে। তবে এই বিভীষিকাময় শিশুবলির প্রথা থেমেছে অনেক আগেই। আর কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে বিভিন্ন মূর্তি, সমাধি-স্তম্ভ এবং বিভিন্ন স্থাপত্য ও সেগুলোর ভগ্নাবশেষ।আর এগুলোই এখনো চিহ্ন বহন করছে অগণিত নিষ্পাপ শিশুর পুড়ে ছাই হওয়া লাশের।
Feature Image Courtesy: wp.com
References:
- Britannica.com
- Allthatsintersting.com
- Ancient-origins.net
- Genies.fandom.com