”নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে, ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে…” কবিগুরুর এই কথা শুনে বৃষ্টিভেজা দিনে মনটা ঘরে আয়েশ করতে চাইলেও, শহুরে মানুষদের ঘরে বসে থাকার জো নেই। জীবিকার তাগিদে কিংবা দৈনন্দিন কর্মে, বাইরে বের যে হতেই হবে। বর্ষা বাংলার এক অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক, চারপাশের প্রকৃতি-গাছপালা সব বৃষ্টিস্নাত হয়ে সজীব হয়ে যায় এ সময়ে। ক্যালেন্ডারের হিসেবে আগস্টের মাঝামাঝিতে বর্ষা শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশে বর্ষা থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিংবা তারও বেশি। প্রকৃতি তো নিজেকে নতুন রূপে মেলে ধরে, কিন্তু নাগরিক জীবনে বর্ষার রূপটা একটু অন্যরকম। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হোক বা মুষলধারে বৃষ্টি, বাইরে পা রাখলেই পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। তাই বর্ষায় নিজেকে সবদিক থেকে বাঁচিয়ে সতেজ আর প্রাণবন্ত রাখাটা সহজ কাজ নয়। তাই সবকিছু মিলিয়ে কীভাবে নিজেকে সুস্থ-সুন্দর রাখবেন এই ঋতুতে, চলুন জেনে নেয়া যাক তার কিছু সহজ উপায়।
পোশাকে বর্ষা
বর্ষাকালে যেহেতু বাইরে বের হলে যেকোনো সময় ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই এসময়ে পোশাকও বেছে নিতে হবে সেই অনুযায়ী। বর্ষার প্রকৃতির সাথে মিল রেখে পোশাক বেছে নিলে নিজেকে স্নিগ্ধ লাগবে এবং নিজেও আরামদায়ক ভাবে থাকা যাবে। বর্ষার ফুল যেমন: কদম, বেলী ইত্যাদির মোটিফে পোশাক বেছে নিতে পারেন মেয়েরা। পোশাকে হালকা বা গাঢ় নীল, সবুজ ইত্যাদি রঙ প্রাধান্য পাবে। সুতির বদলে শিফন বা জর্জেট জামা পরা যেতে পারে। তবে কেউ যদি জর্জেটে কমফোর্টেবল না হন, তাহলে সুতি সালোয়ার কামিজ বা কুর্তি পরতে পারেন।
ছেলেরা দৈনন্দিন ব্যবহারে হালকা রঙ এর শার্ট পরতে পারেন। উৎসবে বা পার্টিতে মেয়েরা সিল্ক এর শাড়ি বা কামিজ বেছে নিতে পারেন। রাতের অনুষ্ঠানে খানিকটা কাজ করা জমকালো পোশাক আর দিনের পার্টিতে ছিমছাম সুন্দর পোশাক আপনাকে এনে দেবে প্রশান্তি।
বর্ষাকালে চামড়ার জুতা পরিহার করা উচিত। মেয়েদের জন্য ফ্লিপ-ফ্লপ স্যান্ডেল পাওয়া যায়, এছাড়াও রেক্সিনের জুতা ব্যবহার করতে পারেন। পুতি বা সুতা ইত্যাদির কাজ করা জুতা পানিতে ভেজানো যাবে না। বর্ষাকালে এমন জুতা ব্যবহার করুন যেন পানিতে ভিজলে সহজে নষ্ট না হয়।
বর্ষায় ত্বক ও চুলের যত্ন
বর্ষার হাওয়ায় জলীয় বাষ্প বেশি থাকে, তাই অনেকের চুল কোঁকড়ানো দেখায়৷ আবার চুল সহজেই বাইরের ধুলোবালিতে ময়লাও হয়ে পড়ে। তাই নিয়মিত যারা বাইরে বের হবেন তারা নিয়মিত শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। তৈলাক্ত চুলে বেশি শ্যাম্পু করার দরকার হয়৷ প্রতিদিন শ্যাম্পু করলে মাইল্ড হার্বাল শ্যাম্পু ব্যবহার করুন৷ আর শুষ্ক চুল হলে সপ্তাহে তিন দিন শ্যাম্পু করতে পারেন। নিজের চুলের ধরণ বুঝে অবশ্যই কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে। চুলের যত্নে যেকোনো একটি প্যাক ব্যবহার করতে পারেন:
১) তিনটি পাকা কলা ও এক টেবিল চামচ মধু একসঙ্গে মিশিয়ে একটা প্যাক তৈরি করে মাথায় ৫০ মিনিট লাগিয়ে রাখবেন। এরপর শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে নেবেন। এতে চুলের রুক্ষতা কমে এবং চুল হয়ে ওঠে চকচকে।
২) দু’টেবিল চামচ অলিভ অয়েল ও এক টেবিল চামচ মধু একটি পাত্রে নিয়ে হালকা গরম করে নেবেন। এরপর ওই তেল চুলের লেংথে ভাল করে লাগিয়ে নেবেন, খেয়াল রাখবেন স্ক্যাল্পে যেন না লাগে, কারণ এর ফলে বর্ষাকালে চুল বেশি অয়েলি হয়ে যেতে পারে। ১৫-২০ মিনিট রাখার পর চুল ভাল করে শ্যাম্পু করে নেবেন।
৩) বর্ষাকালে অনেক সময় স্ক্যাল্প খুব অয়েলি হয়ে যায়। এর সমাধানের জন্য একটা পাতিলেবুর রস স্ক্যাল্পে ভাল করে লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে চুল ধুয়ে নেবেন।
৪) মেথি চুলের জন্য খুব উপকারী। এজন্য সারারাত একটা পাত্রে মেথি ভিজিয়ে রেখে সকালে পানিটা ছেঁকে নেবেন। এরপর ছেঁকে নেওয়া পানিটা আলাদা করে রাখবেন। এরপর শ্যাম্পু করে চুল ধোয়ার পর সবশেষে ওই মেথি ভেজানো পানি দিয়ে চুল ধুয়ে নেবেন। এর ফলে চুল পড়া কমে, খুশকি দূর হয় এবং চুলের উজ্জ্বলতাও বাড়ে।
বর্ষা হোক বা যেকোনো ঋতুতে, ত্বকের যত্ন নেয়া অবশ্যই দরকার। কিন্তু বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে ত্বক ময়লা হয়ে যেতে পারে কিংবা লোমকূপ বন্ধ হয়ে গিয়ে ব্রণ দেখা দিতে পারে। তাই বর্ষায় ত্বকের যত্ন নেয়া উচিত। অবশ্যই বাইরে যাওয়ার আগে এবং বাইরে থেকে আসার পরে মুখ ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। এক্ষেত্রে পছন্দসই ফেসওয়াশ ব্যবহার করলে ভালো হয়। মুখ ধোয়ার পর একটা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা অত্যাবশ্যক। বর্ষাকালে হালকা মেকাপ ব্যবহার করা ভালো, এতে ত্বক সুন্দর থাকবে এবং মুখের ওপর ভারী কোনো আবরণ পড়বে না আর ব্রণ হবার সম্ভাবনা কম থাকবে। চোখের সাজে নীল বা কালো কাজল আর হালকা বাদামি বা নীল আইশ্যাডো দিতে পারেন। রেগুলার ব্যবহার এর জন্য হালকা গোলাপি, পিচ রং, বাদামি রং এর লিপস্টিকই ভালো।
সপ্তাহে দুদিন বা তিন দিন মুখের যত্নে একটা প্যাক বা স্ক্রাব ব্যবহার করতে পারেন। মনে রাখবেন, ত্বকে অ্যালার্জি হয় বা মানায় না এমন কোনো উপাদান ত্বকের যত্নে ব্যবহার করবেন না। এখানে ত্বকের ধরন অনুযায়ী কয়েকটা প্যাক এর নাম দেয়া হলো:
• শুষ্ক ত্বক:
প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এক চা-চামচ গোলাপজল ও এক চামচ গ্লিসারিন মিশিয়ে মুখে লাগাতে হবে। কিছুক্ষণ পর পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। এতে ত্বক থাকবে শুষ্ক, কোমল আর মসৃণ।
• তৈলাক্ত ত্বক:
গোলাপজল অথবা দুধের সঙ্গে বেসন মিশিয়ে পুরো মুখে ২০ মিনিট লাগিয়ে রাখতে হবে। মুখ ধুয়ে ত্বক উপযোগী ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলেই হলো।
• মিশ্র ত্বক:
পেস্তা বাদামের গুঁড়ো, গোলাপজল ও দুধ একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। মুখের ত্বকে ভালো করে মিশ্রণটি লাগিয়ে রাখুন। মিনিট কয়েক অপেক্ষা করে ধুয়ে নিলেই হবে।
শুধুমাত্র মুখের যত্ন নেয়াকেই অনেকে যথেষ্ট বলে মনে করেন, যা আসলে ঠিক নয়। বর্ষায় বাইরে বেরোলে হাত ও পায়ের যত্ন নেয়াও অবশ্যই দরকার। নিজের ত্বক অনুযায়ী মাইল্ড একটা ছোট্ট সাবানও ব্যাগে রাখতে পারেন। বারবার হাত ধোয়ার ফলে হাতের চামড়া রুক্ষ হয়ে যেতে পারে। ছোট একটা ময়েশ্চারাইজার এর বোতল সাথে রাখলে হাত ধোয়ার পর ব্যবহার করতে পারেন। সপ্তাহে একদিন সময় করে গরম পানিতে দশ মিনিট হাত-পা ডুবিয়ে রেখে স্ক্রাব করে নিলে হাত-পা সুন্দর থাকবে। বর্ষায় যেহেতু পায়ে কাদা লাগার সম্ভাবনা থাকে পুরোদমে, তাই অবশ্যই পা পরিষ্কার করতে হবে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে। ভেজা জুতা বা মোজা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুলে ফেলতে হবে।
আনুসঙ্গিক: বর্ষাতি ও রেইনকোট
শহরে ব্যস্ত জীবনে বর্ষা যতটা না উপভোগ্য, তার চাইতে বেশি ঝক্কি পোহানোর নাম। রাস্তায় হাঁটছেন, হুট করে নেমে গেলো বৃষ্টি। তাই এই মৌসুমে সঙ্গে আনুসঙ্গিক কিছু জিনিস রাখলে ভালো হয়। এদিক থেকে বর্ষাতি বা ছাতা থাকবে পয়লা নম্বরে। একটি ভালো ছাতা থাকলে হুটহাট ভিজে যাওয়া থেকে যেমন রক্ষা পাওয়া যাবে, তেমনি কড়া রোদের সময় ছাতা মেলে নিজেকে সুরক্ষাও দেয়া যাবে। বাজারে নানা ধরনের ছাতা কিনতে পাওয়া যাবে, তবে বর্ষার জন্যে টেকসই এবং ছোট ছাতা কেনাই ভালো। এতে করে সহজে বহন করা যাবে সব জায়গায়। বর্ষায় হালকা রঙ, যেমন: নীল, আকাশি, সবুজ বা হালকা গোলাপি ইত্যাদি রঙ এর ছাতা দেখতে সুন্দর দেখায়। ফ্লোরাল প্রিন্ট এর চল এখন খুব বেশি, ছেলে বা মেয়ে উভয়েই ব্যবহার করতে পারেন এগুলো। ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা নির্ধারিত রঙই লাগবে, এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা ভালো। ছাতা ব্যবহারের পর অবশ্যই মেলে দিয়ে ভালো করে শুকিয়ে রাখতে হবে। সহজে খোলা ও বন্ধ করা যায় এরকম বর্ষাতি কিনতে হবে কেনার সময়। এলাকার দোকান থেকে শুরু করে রাজধানীর নিউমার্কেট, সব জায়গায়ই পাবেন হরেক রকমের ছাতা।
ছাতা ব্যবহার যদি ঝামেলা মনে হয়, তবে রেইনকোট ব্যবহার করতে পারেন। রেক্সিনের এবং জলে ভিজে নষ্ট হবেনা এরকম রেইনকোট বেছে নিন। রেইনকোট একটু লম্বা হলে সুবিধে হবে বেশি। বর্তমানে ছেলেমেয়েরা অনেকেই রেইনকোট ব্যবহারের দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
ঘরময় থাকুক বর্ষার স্নিগ্ধতা
নিজের শরীর ও ত্বকের যত্ন নেয়ার পাশাপাশি যদি নিজের ঘরটাও একটু সুন্দর-গুছিয়ে রাখা যায় তবে দিনশেষে নীড়ে ফিরে মনটাই ভালো হয়ে যায়। বর্ষাকালে নিজের ঘরকে পরিষ্কার তো রাখতে হবেই, চেষ্টা করতে হবে কোথাও যেন স্যাঁতসেঁতে ভাব না থাকে।
জানালা-দরজায় হালকা রঙ এর পর্দা, ঘরের কোণে সবুজ একটা মানিপ্ল্যান্ট বা বারান্দায় টবে সবুজ, ছোট্ট ফুলের গাছ রাখতেই পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন কোথাও যেন পানি জমে না থাকে এবং পোকামাকড় বা মশার উপদ্রব না হয়। ঘরের সাজে প্রকৃতির ছোঁয়া রাখলে শহুরে বন্দী জীবনের একঘেয়েমি অনেকটাই কেটে যাবে। অবসর সময়ে হাতে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভুলে যাওয়া যাবে সারাদিনের শ্রান্তি।
Feature Image Courtesy: wallpaperaccess.com