২৭ নভেম্বর, ২০২০।
তেহরানের ৯০ মাইল দূরের গ্রাম আবসার্দ, ইরানের এলিটদের অবকাশযাপনের স্থান। সকালে এক নিশান সেডানের চড়ে যাচ্ছিলেন ৫৯ বছর বয়সী বিজ্ঞানী মোহসিন ফখরিহজাদে। হঠাৎ তার গাড়ির পাশে এক পুরনো ট্রাকে কাঠের স্তূপের নিচে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হয়। তার গাড়ির গতি ধীর হতেই অটোমেটিক রিমোট কন্ট্রলোড মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয় ফখরিহজাদেকে।
ফখরিহজাদের নাম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং আমেরিকার অবরোধের তালিকায় ছিল আগে থেকেই। প্রায়ই তাকে দেখা যেত আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সাথে বৈঠকে। ফখরিহজাদেকে তুলনা করা হত রবার্ট ওপেনহাইমারের সাথে। ইরানের নিউক্লিয়ার প্রজেক্টের অন্যতম প্রধান কর্তা ছিলেন এই বিজ্ঞানী। ইরানের নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট আরো কতটুকু পিছিয়ে গেল এ হত্যাকাণ্ডে- তা সময়ই বলে দেবে।
এর ঠিক কয়েক ঘণ্টা পরই পেন্টাগন জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে তারা পুনরায় বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস নিমিটজকে মোতায়েন করতে যাচ্ছে। ইরান এ ঘটনার জন্য যথারীতি দায়ী করে ইজরাইল এবং তার মিত্র আমেরিকাকে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট বাধা দেয়ার কাজ ইজরাইল সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই করে আসছে। মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং ইরানের অনেক বিজ্ঞানীকে মোসাদ হত্যা করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই অদৃশ্য যুদ্ধ ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে ইজরাইলের শত্রুদের। ইজরাইলের এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের এই দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করব আজকে।
ইজরাইলের এমন নোংরা যুদ্ধের প্রথম শিকার মিশর। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মিশর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৫২ সালের মিশরীয় বিপ্লবের পর ক্ষমতা দখল করেন গামাল আবদুল নাসের। মধ্যপ্রাচ্যে দু’টো ভাগ সৃষ্টি হয়- একদিকে আরব রিপাবলিক মিসর, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া; আরেকদিকে রাজতন্ত্রী সৌদী আরব, জর্দান, মরক্কো, কুয়েত। নাসের সেক্যুলার, সমাজতান্ত্রিক আরব ভ্রাতৃত্বের ডাক দেন। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ ও পরবর্তী রাজনৈতিক পটভূমিতে বিজয় লাভ করে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন তিনি। তিনি তার মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজস্ব মিসাইল প্রোগ্রাম শুরু করেন।

নাৎসি জার্মানির ভি-১ ও ভি-২ রকেট প্রোগ্রামের সাথে জড়িত কয়েকজন বিজ্ঞানী জড়িত ছিলেন এ প্রোগ্রামে। হাসান সাইয়েদ কামাল ছিলেন একজন মিশরীয় বংশোদ্ভূত সুইস আর্মস ডিলার। তিনিই ওয়েস্ট জার্মানি আর সুইজারল্যান্ড থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে দেন, যদিও দু’টো দেশই মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। মরুভূমির মধ্যে গড়ে তোলা ফ্যাক্টরি-৩৩৩ নামের গোপন ল্যাবে তৈরি করা হয় মিসাইল। ইজরাইল তখনো ঠাহর করে উঠতে পারেনি কী হতে যাচ্ছে।

১৯৬২ সালের জুলাই মাসে কায়রোর রাস্তায় দুটো নবনির্মিত মিসাইল প্রদর্শন করেন নাসের; একই সাথে চারটি সফল মিসাইল টেস্টের কথা ঘোষণা করেন। মিসর নির্মাণ করেছিল আল কাহের ১, ২, ৩ এবং আল-রাঈদ নামক চার রকমের মিসাইল। এসকল মিসাইল ইজরাইলের যেকোনো স্থানে আঘাত করতে সক্ষম ছিল। ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়েন মোসাদকে নির্দেশ দেন মিসরের মিসাইল প্রোগ্রাম বন্ধ করার জন্য।

মোসাদের অপারেশনাল সেলের নেতৃত্ব দেন ইৎজাক শামির, যিনি পরবর্তীতে ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী হন। অপারেশনের নাম দেয়া হয় অপারেশন ডেমোক্লিস। এই সেল আগস্ট মাসে প্রজেক্টের সাথে জড়িত বিজ্ঞানী উলফগ্যাঙ পিলজের অফিস থেকে ডকুমেন্ট চুরি করে আনে। ১৯৫৭ সালে মোসাদের স্পাই উলফগ্যাঙ লটজ মিসাইল প্রোগ্রামে অনুপ্রবেশ করেন। তিনি প্রচুর তথ্য পাচার করতে সক্ষম হন। জানা যায়, মিসর এমন ৯০০ মিসাইল তৈরি করছে।

ইৎজিয়াক শামির; Image Courtesy: Wikipedia.org
সেপ্টেম্বরে ফ্যাক্টরি-৩৩৩ এর প্রধান বিজ্ঞানী হাইঞ্জ ক্রুগকে মিউনিখ থেকে অপহরণ করা হয়। এই কাজে মোসাদ ব্যবহার করে সাবেক নাৎসি কমান্ডো অটো স্কিউয়ার্নিকে; ইনি মুসোলিনিকে উদ্ধার করে জার্মানিতে নিয়ে এসেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। অটো তাকে হত্যা করে লাশের ওপর এসিড ঢেলে দেন। নভেম্বর মাসে উলফগ্যাঙের অফিসে লেটার বোম্ব পাঠানো হয়, বিস্ফোরণে মারা যান তার সেক্রেটারি। ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইটজারল্যান্ডে আরেকজন বিজ্ঞানী হ্যান্স ক্লেইনওয়াচারের ওপর আক্রমণ হয়। এপ্রিলে প্রজেক্ট ম্যানেজার পল গোর্কে আর তার মেয়ের ওপর হামলা করা হয়। এরপর বিদেশি বিজ্ঞানীরা ভয়ে মিসরের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। ১৯৬৬ সালে শেষ হয়ে যায় প্রোগ্রামটি।

১৯৬৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব জার্মানির রাষ্ট্রপতি মিশর ভ্রমণে আসেন। তখন ত্রিশজন পশ্চিম জার্মান নাগরিকের সাথে সাথে লটজকেও গ্রেফতার করা হয়। ধরা পড়ে গেছেন মনে করে লটজ সব ফাঁস করে দেন। তখন সবকিছু জানা যায়।
মিসরীয় বিজ্ঞানীদের ওপর আক্রমণ আরো আগে থেকে শুরু হয়েছিল। ড. সামিরা মুসা ছিলেন মিসরের প্রথম নারী পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি কাজ করতেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৫২ সালে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দেশে ফিরে আসার কিছুদিন আগে ক্যালিফোর্নিয়াতে একটা দাওয়াত পান তিনি। সেই দাওয়াতে যাবার সময় তার গাড়ি খাদে পড়ে গেলে তিনি নিহত হন। ড্রাইভার পালিয়ে যায়। পরে তদন্তে বের হয়ে আসে, দাওয়াতটি ভুয়া ছিল। এই মৃত্যুর পেছনে ইজরাইলের হাত আছে বলে দাবি করে মিশর।

ড. সামিরা মুসা; Image Courtesy: Wikipedia.org
ড. সামির নাগুইব ছিলেন আরেকজন মিসরীয় নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট। ১৯৬৭ সালে তিনিও দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে আসার কয়েকদিন আগে ডেট্রয়েটের এক মোড়ে তার গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া হয়, নিহত হন তিনি। এই মৃত্যুর পেছনেও মোসাদের হাত থাকার কথা দাবি করে মিসর।
ইরাকের নিউক্লিয়ার প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত মিসরীয় নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট ইয়াহিয়া আল-মাশাদ। তিনি ১৯৮০ সালের ১৩ জুন প্যারিসে আসেন ইরাকের ওশিরাক নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের জন্য নিউক্লিয়ার ফিউয়েল টেস্ট করার জন্য। সকালে হোটেল রুম থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছিল। সেই রাতে তার ঘরে ছিল মেরি এক্সপ্রেস নামের এক এস্কর্ট; প্রাথমিক জবানবন্দি দেবার পরই সে গাড়িচাপায় মারা যায়।

১৯৮৯ সালের ১৪ জুলাই মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় মিসরীয় পদার্থবিজ্ঞানী সাঈদ বেদাইরের লাশ হোটেলের ব্যালকনি থেকে পড়ে যায় নিচে। তাকে শ্বাসরোধ করে ও হাতের রগ কেটে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি মিসরের মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেমে কাজ করতেন। তার ঘর থেকে খোয়া যায় তার কম্পিউটারটি।

এই তালিকায় সর্বশেষ নাম আবু বকর রামাদান। তিনি মিসরের নেটওয়ার্ক অব রেডিওলজি মনিটরিং এর প্রধান ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল ইরানের বুশাহের আর ইজরেলের দিমোনা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট পরিদর্শন করার। এছাড়াও তিনি ছিলেন রাশিয়ার সহযোগিতায় তৈরি হতে থাকা মিসরের মাল্টাই-বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট দাবাহ নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট কমিটির সদস্য। ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মরক্কোর মারাকেশ শহরে একটি কনফারেন্সে যান তিনি। কনফারেন্সের দিন সকালে তিনি জুস পান করার পর অসুস্থতা অনুভব করেন। হোটেল রুমে যাবার পর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তিনি।

আশির দশকের শুরুতে ইরাকের তিনজন নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্টকে হত্যা করেছিল মোসাদ। এর ফলে ইরাকের ওশিরাক নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর ওশিরাকে বিমান হামলা করে ইরাকের নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট নস্যাত করে দিয়েছিল ইজরাইল। এরপর সাদ্দাম হোসেন সুপারগান তৈরিতে মনোযোগ দেন। স্যাটেলাইট ধ্বংস করার জন্য বিশেষ আর্টিলারি গান তৈরির পরিকল্পনা নেন তিনি। ১৯৬০ এর দশকে গ্রহণ করা আমেরিকান হার্প প্রজেক্টের ওপর ভিত্তি করে এমন সুপারগান তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম সেরা আর্টিলারি এক্সপার্ট জেরাল্ড বুলকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। জেরাল্ড বুল ছিলেন কানাডার নাগরিক। এই প্রজেক্টের নাম দেয়া হয় প্রজেক্ট ব্যাবিলন।

১৯৮৯ সালে একটা প্রটোটাইপ তৈরি করা হয়। একই সাথে তিনি ইরাকের বালিস্টিক মিসাইল প্রোগ্রামেও কাজ করছিলেন। এমন সময় ইজরাইলের প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক শামির মোসাদকে নির্দেশ দেন বুলকে হত্যা করার জন্য। ১৯৯০ সালের ২২ মার্চ ব্রাসেলসে তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে তিনজন মোসাদ এজেন্ট সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে তাকে হত্যা করে। থেমে যায় ইরাকের প্রজেক্ট ব্যাবিলন এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রোগ্রাম। লেবাননের প্রথমসারির নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট ছিলেন রামাল হাসান রামাল। ফ্রান্সে কাজ করতেন তিনি। ১৯৯১ সালের ৩১ মে রহস্যজনকভাবে তিনি মারা যান। তার মরদেহ যেসব ফরাসি কর্মকর্তা লেবাননে ফিরিয়ে এনেছিলেন, তারা লেবানিজ সরকারকে রামাল হাসানের লাশ দেখতে দেননি। গোপনেই তার নিজ পৈত্রিক বাসভূমে দাফন করা হয়েছিল। এর পেছনে মোসাদের হাত ছিল বলে দাবি করে লেবানন।

২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিস থেকে ২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের ছোট্ট শহর ফাক্সে নিজের বাসার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে। ফাক্সের সবাই তাকে চিনতেন এভিয়েশন এক্সপার্ট মুরাদ নামে; এমনকি তার স্ত্রীও জানতেন না যে তার নাম মুরাদ না। হত্যাকাণ্ডের পর একটা সারপ্রাইজ পায় সবাই। হামাস তার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে জানায়- জাওয়ারি ছিলেন হামাসের মিলিটারি উইং কাসসাম ব্রিগেডের ড্রোন প্রোগ্রামের প্রধান। তিনি হামাসের হয়ে আবাবিল-১ ড্রোন ডেভেলপ করেছেন, যেটা ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ইজরেলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে হামাস।

ফাদি মুহাম্মদ আল-বাতশ ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি ইঞ্জিনিয়ার। হামাসের রকেট ডেভেলপমেন্টের সাথে ছিলেন তিনি। তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি কুয়ালালামপুর ব্রিটিশ মালয়েশিয়ান ইন্সটিটিউটের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৮ সালের ২১ এপ্রিল ফজরের নামাজের জন্য বাসা থেকে বের হলে দুজন মোটরবাইক আরোহী তাকে গুলি করে হত্যা করে।

এছাড়াও আরো কয়েকজন আরব বিজ্ঞানীর নাম পাওয়া যায়, যাদের মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় নি।
এবার আসা যাক ইজরাইলের বর্তমান নেমেসিসের ব্যাপারে– ইরান।
১৯৮০ সালে ইরানের নিউক্লিয়ার প্রজেক্টে দাড়ি টেনে দিয়েছিলেন খোমেনি; বলেছিলেন নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট অনৈসলামিক। পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে খোমেনির ফতোয়া এখনো ইরান ব্যবহার করে; প্রায়ই ইরানকে বলতে শোনা যায়, তাদের হাতে পারমাণবিক বোমা নেই কারণ খোমেনি এই ফতোয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু আশির দশকের শেষের দিকে ইরান সিদ্ধান্ত নেয় পারমাণবিক বোমা তৈরি করার এবং এরপর থেকেই ইরান সবার চোখে ধুলো দিয়ে শুরু করে তাদের আয়োজন। ১৯৮৮ সালের পয়লা জুন প্রথমবারের মত আমেরিকা ইরানের এই আয়োজনের কথা টের পায়। কিন্তু নানা কারণে তা নিয়ে আর আগায় নি আমেরিকা বা ইজরেল। ২০০২ সালের অগাস্টে ইরানের মার্ক্সবাদী আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন মুজাহেদীন-এ খালক প্রথমবারের মত ইরানের দুটো নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের কথা প্রকাশ করে। আর ইজরেল কাজে নামতে নামতে ২০০৫ সাল এসে পড়ে। মোশে দাগান দায়িত্ব নেন ইরানের নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট পিছিয়ে দেয়ার কর্মযজ্ঞের।

২০০৫-০৬ সাল জুড়েই চলে স্যাবোটাজ আর ইরানের সামরিক অফিসারদের হত্যার কাজ। বিজ্ঞানীদের ওপর প্রথম আঘাত আসে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে।
২০০৬ সালে ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদক পেয়েছিলেন ড. আর্দশির হোসেইনপুর। এর দুই বছর আগে তিনি পেয়েছিলেন সামরিক গবেষণা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদক। তিনি ইরানের ইস্পাহানের এক গোপন ল্যাবের দায়িত্বে ছিলেন, যেখানে ইরানের প্রধান নিউক্লিয়ার ইনস্টলেশান নাতাঞ্জের জন্য ইউরেনিয়ামকে গ্যাসে পরিণত করা হত। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে তেজস্ক্রিয় বিষক্রিয়ায় মারা যান তিনি। ইরান সাথে সাথেই দাবি করে, তিনি ঘরে আগুন লেগে মারা গেছেন। কিন্তু তখন থেকেই তার স্ত্রী দাবি করছিলেন, এ কাজে জড়িত মোসাদ। বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থা স্ট্র্যাটফর দাবি করে, এই কাজে জড়িত মোসাদের কায়সারিয়া ইউনিট। এই গ্রুপটাই ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ইজরেলি অ্যাথলেটদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে অপারেশন র্যাথ অব গড পরিচালনা করেছিল। মোসাদের হয়ে খুনোখুনির কাজ করে একটা স্পেশাল ইউনিট- কিডন। হিব্রুতে কিডন শব্দের অর্থ বর্শার ফলা।

ইরান তখন থেকেই দাবি করছিল, তাদের বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। কিন্তু এটা ফাপা বুলি হিসেবে প্রমাণিত হয় ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে।
ওবামা সরকারের আমলে মোসাদ একে একে হত্যা করে পাঁচজন ইরানি বিজ্ঞানীকে।
নিউক্লিয়ার প্রজেক্টের উপদেষ্টা ছিলেন ইরানের বিখ্যাত কোয়ান্টাম ফিজিসিস্ট প্রফেসর মাসুদ আলী মোহাম্মদী। একইসাথে তিনি ইরানের রেভিউলেশনারি গার্ড কোরের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি সকালে অফিসে যাচ্ছিলেন তিনি। তার গাড়ির পেছনে একটা ম্যাগনেটিক বোমা লাগিয়ে দেয়া হয়, বিস্ফোরণে মারা যান তিনি। ইরানি সরকার নিউক্লিয়ার প্রজেক্টের সাথে তার সম্পৃকতার কথা অস্বীকার করলেও দেখা যায়, তার জানাযায় আসা অর্ধেক মানুষ গার্ড কোরের অফিসার। তার লাশও বহন করে গার্ড কোরের অফিসাররা।

২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর সকালে একইভাবে বোমা আটকে দেয়া হয় ড. মাজিদ শাহরিয়ারী আর ড. ফিরেইদুন আব্বাসী-দাভানির গাড়িতে। দুজনই সস্ত্রীক যাচ্ছিলেন অফিসে। বোমা বিস্ফোরণে মারা যান ড. শাহরিয়ারী; আহত হন ড. আব্বাসী। সুস্থ হবার পর ড. আব্বাসীকে ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত করেন।

দারিউস রেজাইনেজাদ ছিলেন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। তিনি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা কার্যক্রমে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। ২০১১ সালের ২৩ জুলাই তিনি তার স্ত্রীর সাথে গেছিলেন তার পাচ বছরের বাচ্চাকে কিন্ডারগার্ডেন স্কুল থেকে পিক আপ করতে। মোটরবাইকে চড়ে একজন আততায়ী এসে পরপর পাঁচবার গুলি করে তাকে হত্যা করে। তার স্ত্রীও আহত হন। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি, প্রফেসর মোহাম্মদীর মৃত্যুর ঠিক দুইবছর পর আরেকজন বিজ্ঞানী মোস্তফা আহমদী রোশানের গাড়িতেও বোমা লাগিয়ে হত্যা করে মোসাদ।

২০১১ সালে ইরানের জাতীয় টেলিভিশনে আনা হয় মজিদ ফাসি নামের এক সুদর্শন যুবককে। প্রফেশনাল কিকবক্সিং ছেড়ে সে মোসাদের হয়ে কাজ শুরু করে। সে স্বীকার করে, প্রফেসর মোহাম্মদীর গাড়িতে বোমা সে-ই ফিট করেছিল। সে বলে, ২০০৭ সালে সে ইস্তাম্বুলের ইজরেলি কনস্যুলেট থেকে মোসাদে যোগ দেয়। তেল-আবিবে মোসাদ কম্পাউন্ডে প্রফসর মোহাম্মদীর বাড়ির সামনের রাস্তার একটা অবিকল মডেলে তাকে ট্রেনিং দেয় মোসাদ।
২০১২ সালের মে মাসে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। একই সময়ে আরো চৌদ্দজনকে গ্রেফতার করে ইরানের গোয়েন্দারা। এই রিংটা ২০১০-২০১২ সালের মধ্যে বিজ্ঞানীদের হত্যা করে। প্রতিটা কেসেই আততায়ী একতা বাজাজ পালসার মোটরবাইকে চড়ে বিজ্ঞানীদের গাড়িকে ফলো করে তাতে বোমা লাগিয়ে দেয়। এ বোমাগুলোকে তারা বলত ম্যাগনেটিক স্টিকি বোম্ব। সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এসকল রিক্রুটমেন্টের কাজ করে মোসাদের হাৎজোমেট ইউনিট।

ইরানের কুদস ফোর্সের সিক্রেট অপারেশন্স ডিভিশন- ইউনিট ৪০০ প্রতিশোধ নেবার জন্য সারাবিশ্বে ইজরেলের বিশটা কনস্যুলেটে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। তড়িঘড়ি করে এই কাজটা করতে গিয়ে সবগুলো মিশনই ব্যর্থ হয়।
২০১৫ সালে ইরান দাবি করে, আরেকজন বিজ্ঞানীর ওপর হতে যাওয়া আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়েছে তারা।
ইরান তার নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট রক্ষার জন্য নিজস্ব কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ওগাব-২ (ঈগল-২) তৈরি করে ২০০৫ সালে। এর বর্তমান কমান্ডার কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কিন্তু এই এজেন্সিও তেমন কিছু করে দেখাতে পারেনি।
ইজরেলের এই নোংরা যুদ্ধ শেষ হবার নয়, কারণ এটা তাদের অস্তিত্ত্ব রক্ষার লড়াই। এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিজেদের বিজ্ঞানী ও নিজেদের গবেষকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। নয়ত বছরের পর বছর ধরে গড়ে তোলা মূল্যবান মানবসম্পদ নিমেষেই হারিয়ে যাবে ঘাতকের বুলেট বা গাড়ি বোমা হামলায়। Feature Image Courtesy: unitedwithisrael.org