যেসব চরিত্র নিজস্ব সত্তার গন্ডি পেরিয়ে অভিনয় দক্ষতা দিয়ে মানুষের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে, তারাই যুগ যুগান্তরে বেঁচে থাকে ইতিহাসের পাতায়। তেমনই এক চরিত্রের নাম ‘মি. বিন’। ৯০’র দশকে কমেডিয়ান হিসেবে টিভির পর্দায় যার বিচরণ ছিল একচেটিয়া এবং আজও যিনি নিজের অভিনয় দিয়ে বেঁচে আছেন দর্শক হৃদয়ের সিংহাসনে।
মি. বিন চরিত্রের স্রষ্টা রোয়ান সেবাস্টিয়ান এটকিনসন। ডাকনাম রো। এরিক এটকিনসন এবং এলা মে দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন রো। তার জন্ম ১৯৫৫ সালের ৬ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের নিউক্যাসলে। কৃষক পরিবারে জন্ম হওয়া রো আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যেই বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। পড়াশোনার প্রতিও তার আগ্রহ ছিল প্রবল। শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন ডারহামের ক্যাথেড্রাল স্কুল ও নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবশেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে ইতি ঘটে রোয়ের শিক্ষাজীবনের।

রোয়ের অভিনয় করা কিংবা কমেডিয়ান হওয়ার কখনোই তত আগ্রহ ছিল না। এমনকি ১২ বছর বয়স অবধি নিজের চোখে কখনো টেলিভিশন দেখার সৌভাগ্যও হয়নি রোয়ের। কিন্তু ঐ যে ড্রাইভেন বলেছিলেন, “প্রতিভার তৈরি সম্ভব নয়, প্রতিভা জন্ম হয়।” ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল রো এর জীবনে।
ডারহামের ক্যাথেড্রাল স্কুলে পড়াকালীন সেখানকার এক ফিল্ম সোসাইটি কর্তৃক হাসির ও শিশুতোষ বিষয়ক সিনেমা দেখানো হতো। রো এর জীবনে অভিনয়ের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল তখনই। স্কুলে চার্লি চ্যাপলিন এবং অন্যান্য কমেডি অভিনেতাদের মুভি দেখে নকল করতেন তিনি। একসময় মঞ্চের বেকস্টেজে কাজও শুরু করেন। নিজের অভিনয়শৈলী দিয়ে মূলমঞ্চে জায়গা করে নিতে বেগ পেতে হয়নি রো কে। মঞ্চে তার কাজ দেখে স্কুলের প্রধান শিক্ষক রোকে পরামর্শ দিয়েছিলেন অভিনয়কে সে যেন সিরিয়াসভাবে নেয়। যদিও ঐ সময় রো বিষয়টিকে ততটা আমলে নেননি।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে রিচার্ড কার্টিসের সাথে পরিচয় হয় রোয়ের। রিচার্ড যদিও একজন নাট্যকার এবং গীতিনাট্য অভিনেতা ছিলেন। তবে সাধারণত কমেডি চরিত্রেই তিনি অভিনয় করতেন। রিচার্ড ও রো মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তোলেন ‘অক্সফোর্ড নাট্যশালা’। সে সময় নাট্যশালার জন্য নাটক লেখাও শুরু করেন রো। লেখক হিসেবে রো এর আবির্ভাব ঘটেছে এভাবেই। অভিনয় দক্ষতার পাশাপাশি তার লেখনীও ছিল অসাধারণ। ১৯৭৯ সালে তার লেখা স্কেচ কমেডি শো ‘নট দ্যা নাইট’ ও ‘ক্লক নিউজ’ পাঠকদের কাছে এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে বেস্ট সেলিং বই হিসেবে অল্প সময়েই জায়গা করে নিয়েছিল। এ বইয়ের জন্য ব্রিটিশ একাডেমিক অ্যাওয়ার্ড ও এমি অ্যাওয়ার্ডও লাভ করেছিলেন রো। পরবর্তীতে এই বই থেকে টিভি কমিক অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় এবং সেখানে অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং রো!

মি. বিন হিসেবে খ্যাতি লাভ করা রোয়ান এটকিনসনের অভিনয় জীবনের শুরু ততটা মসৃণ ছিল না। পেশাগত জীবনে অভিনয়ের শুরুতে তোতলামির সমস্যার কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন বারবার। সময়ের সাথে সে সমস্যা যদিও রো কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু চেহারা সুন্দর না হওয়ায় এবং শারীরিক গড়ন বলিষ্ঠ ছিল না বলে অভিনয়ে আবারও হোঁচট খেতে হয় তাকে। একটা সময় রো ভেঙে পড়েছিলেন। তবে নিজের ওপর বিশ্বাসটা রেখেছিলেন সবসময়। যেমনটা মাইকেল জর্ডান বলেছিলেন, “আমি ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারি। কিন্তু আমি চেষ্টা না করাকে মেনে নিতে পারি না।”
১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় রোয়ান এটকিনসন অভিনীত প্রথম ছবি। জেমস বন্ড সিরিজের সেই ছবিটির নাম ছিল, ‘নেভার সে নেভার এগেইন’। রো প্রথম লিডিং চরিত্রে অভিনয় করেন তার দ্বিতীয় ছবি ‘ডেড অন টাইম’ এ। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কুড়িটির অধিক ছবিতে অভিনয় করেন রো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হলো ‘দ্য টল গায়’, ‘মে বি বেবি’, ‘জনি ইংলিশ’, ‘স্কুবি ডু’, ‘কিপিং মাম’, ‘দ্য লায়ন কিং’ ইত্যাদি।

১৯৯০ সালে মি. বিন চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন রোয়ান। আইটিভিতে প্রচারিত এই ব্রিটিশ ধারাবাহিকের প্রথম নাম ছিল ‘মি. হোয়াইট’। পরবর্তীতে নাম রাখা হয় মি. বিন। দীর্ঘ বিশ বছর এই টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেন রো। মূলত চরিত্রটির অস্বাভাবিক আচরণ ও হাস্যরসাত্মক অঙ্গভঙ্গি সর্বস্তরের মানুষের কাছে একে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানটির নির্বাহী প্রযোজক পিটার বেনেট জোনাস বলেন, “মি. বিন যে সব বয়সের দর্শকদের কাছে এবং এতগুলো দেশে জনপ্রিয় হয়েছে তার কারণ হলো এর সার্বজনীনতা।” প্রথম সম্প্রচারের পর থেকে আজ অবধি বিশ্বের ২০০টি দেশে অনুষ্ঠানটি বিক্রি হয়েছে। মি. বিন কেবল সিরিয়ালেই আবদ্ধ থাকেনি। এ চরিত্রকে কেন্দ্র করে ১৯৯৭ সালে ‘বিন: দ্যা আলটিমেট ডিজাস্টার’ ও ২০০৭ সালে ‘মিস্টার বিন’স হলিডে’ নামে দুটি সিনেমাও তৈরি করা হয়েছে।

সিরিয়ালটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে ২০০২-২০০৪ সাল পর্যন্ত আইটিভি মিস্টার বিন কার্টুন সম্প্রচার করে। ২০০৩ সালে রোয়ান এটকিনসন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এ চরিত্রের একটা বড় অনুপ্রেরণা ছিল ফরাসী কমেডিয়ান জ্যাক আতির সৃষ্ট চরিত্র- মি. উলো।” গোল্ডেন ড’ওর সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করে সবার প্রিয় ‘মি. বিন’। সর্বশেষ ২০১২ সালের নভেম্বরে এই অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব ‘হেয়ার বাই মি. বিন অব লন্ডন’ প্রচারিত হয়। এ প্রসঙ্গে রোয়ানের বক্তব্য ছিল, এ চরিত্র তাকে শিশুতে পরিণত করে দিচ্ছে। তাছাড়াও চরিত্রটি করতে যে শারীরিক শক্তির প্রয়োজন তা তিনি আর পাচ্ছেন না। ডেইলি টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের সময় রো বলেন, “একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তির জন্য শিশুসুলভ অভিনয় করা একেবারেই বেমানান। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে আমি সিরিয়াসধর্মী চরিত্রগুলোতেই শুধু অভিনয় করব।”

‘মি. বিন’ ছাড়াও ‘দ্যা ব্ল্যাক অ্যাডার’ এবং ‘ফানি বিজনেস’ সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় টিভি সিরিজে অভিনয় করেন রোয়ান এটকিনসন। যদিও বিনই তাকে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে দিয়েছিল। সত্যি বলতে, রোয়ানের চুপচাপ স্বভাবই তাকে মি. বিন হয়ে উঠতে সহায়তা করেছিল।
বাস্তব জীবনে রোয়ান বেশ হাসিখুশি মানুষ। ইংল্যান্ডের রাণী এবং রাজপরিবারের সাথে তার ভালোই সখ্যতা আছে। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ডারহামের ক্যাথেড্রাল স্কুলে রোয়ানের ভালো বন্ধু ছিলেন। বিবাহিত জীবনে রোয়ানের জীবনসঙ্গী মেকআপ আর্টিস্ট সুনেত্রা শাস্ত্রী। ১৯৯০ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। বেনজামিন এবং লিলি তাদের দুই সন্তান।

রোয়ান এটকিনসন সর্বকালের সেরা সেলিব্রিটিদের একজন। ২০০৫ সালে রম্য দর্শকদের ভোটে ব্রিটিশ কমেডি ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ৫০ কমেডিয়ানের তালিকায় নাম ওঠে রোয়ানের।
ব্যক্তি রোয়ান এটকিনসন কতদিন দর্শকদের মাঝে বেঁচে থাকবেন তা জানা না থাকলেও সামাজিক রীতিনীতির বাইরের মি. বিন তার নির্বাক চরিত্রের মধ্য দিয়ে দর্শক হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকবেন চিরকাল। হাসির রাজা হয়ে বিন হাসাবেন বিশ্বকে।
Feature Image Courtesy: hollywoodreporter.com