এমন একটি সিরিজ সম্পর্কে চিন্তা করুন যেখানে আছে একজন রহস্যময় ও বুদ্ধিদীপ্ত চরিত্র, আছে টুইস্ট এর পর টুইস্ট, বিপ্লব, হ্যাকটিভিজম, অনন্য সিনেমাটোগ্রাফি এবং দুর্দান্ত সংলাপ। বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে, তাই না? হ্যাঁ, কথা বলছি সিরিজ জগতের অন্যতম আন্ডাররেটেড শো মি.রোবট নিয়ে।
মি. রোবট এর জনরাটিকে কাল্ট ক্লাসিক হিসাবে বিবেচনা করা হয় কারণ ব্রেকিং ব্যাড বা গেম অফ থ্রোনস এর মতো এটি মূলধারার দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি। সিরিজটির পরীক্ষামূলক সিনেমাটোগ্রাফি ও কিছুটা দুর্বোধ্য প্লট এর অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে যারা হ্যাকিং, টুইস্ট ও রহস্য নির্ভর সিরিজ দেখতে ভালোবাসেন তাদের কাছে এটি একটি মাস্টারপিস এর কম বলে মনে হবে না।
মূল চরিত্র এলিয়ট এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রামি মালেক। প্রথম কেউ সিরিজটি দেখলে মনে হবে এই চরিত্রটি রামি মালেক এর চেয়ে ভালো আর কেউ হয়তো ফুটিয়ে তুলতে পারতো না। মূল চরিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য রামি মালেক ২০১৬ সালে এমি এওয়ার্ড লাভ করেন। সিরিজটির পরিচালক ছিলেন স্যাম এসমায়েল। সিজন সংখ্যা মোট ৪ টি এবং মোট পর্ব সংখ্যা ৪৫ টি।

সিরিজের অন্যতম ইন্টারেস্টিং একটি বিষয় হলো হ্যাকিং এর যতোগুলি ঘটনা এতে দেখানো হয়েছে, প্রত্যেকটি হ্যাকিং প্রক্রিয়াই আসলে বাস্তবসম্মত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাক করার ক্ষেত্রে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে একটি পদ্ধতির ব্যবহার সিরিজে করা হয় যা বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তার জগতে বহুল পরিচিত৷ আজকাল প্রায় সকলেই কম বেশি ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। এগুলি যে মানুষের বিরুদ্ধে কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, বা মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেয়ার, বা হ্যাক হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে পারে সেই বিষয়টি এই সিরিজটি দেখে বোঝা যায়।
“I’ve never found it hard to hack most people. If you listen to them, watch them, their vulnerabilities are like a neon sign screwed into their heads.” -Elliot Alderson
প্লট
মূল চরিত্র এলিয়ট একজন তরুণ প্রোগ্রামার যিনি দিনে একজন সাইবার-নিরাপত্তা প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু রাতে সে হয়ে যান একজন হ্যাকার। কিন্তু সে হ্যাকিং এর মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচন করেন ও আইনের কাছে সোপর্দ করেন। তবে তিনি রাতের আড়ালে এসব কিছুই করেন নিজের পরিচয় গোপন রেখে।

মনে মনে এলিয়ট আবার ক্যাপিটালিস্ট সমাজ ও এর নিয়ন্ত্রকদেরকে নিজের শত্রু মনে করেন। দেশের অর্থনৈতিক সিস্টেম কীভাবে মানুষের জীবনের সর্বস্ব নিয়ন্ত্রণ করে তা তিনি সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করেন এবং মনে মনে তিনি এই সিস্টেমকে গুড়িয়ে দিতে চান।
সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী কর্পোরেশনকে নামিয়ে আনতে হ্যাকারদের একটি গোপন দলে এলিয়টকে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু এই সিস্টেম এর কলকাঠি যারা নাড়ে তাদের ধারেকাছে যাওয়া তো খুব কঠিন। এলিয়ট কী কখনো সফল হয় এই মিশনে?
এলিয়ট অলডারসন এর মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা (স্পয়লার এলার্ট)
পুরো সিরিজটির আকর্ষণ এর মূল হল এর মূল চরিত্র এলিয়ট অলডারসন। এলিয়ট এর মধ্যে বিষন্নতা ও সোশ্যাল এংজাইটি খুব প্রকট। তাই তিনি মানুষের সাথে মিশতে পারেন না। সমাজের প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ। তার পরিচিত অনেকেই আবার তাকে অনুভূতিহীন বলেও মনে করেন।

এলিয়ট তার নিসঙ্গতা কাটাতে তার নিকটজনদের ব্যক্তিগত তথ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ই-মেইল হ্যাক করেন। প্রতিটি মানুষ বাইরে থেকে একরকম হলেও তাদের নিজস্ব দুনিয়ায় তারা অন্যরকম, এই বিষয়টি এলিয়ট উপলব্ধি করেন যখন তিনি অন্যদের ব্যক্তিগত মেসেজ, কার্যক্রম লক্ষ্য করেন।
“I’m good at reading people. My secret, I look for the worst in them.” – Elliot Alderson
তবে এসবের মাধ্যমে তিনি তার নিকটজনদের সাথে নিজের একাত্মতা খুঁজে পান। তার কাছে মনে হয়, তিনি তার নিকটজনদের চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়। কেননা তিনি নিজেও তার একটি পরিচয় সমাজের সকলের থেকে আড়াল রাখেন।

মাঝেমাঝে এলিয়ট স্বপ্ন দেখেন একটি পারফেক্ট পৃথিবীর, যেই পৃথিবীতে কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রণ করে না। যেই পৃথিবীতে তার সব নিকটজনেরা সুখে থাকে। আর এলিয়ট সেখানে নিজেকে একা মনে করেন না।
তিনি তার ছোট বেলার বান্ধবী এঞ্জেলা, তার সাইকোলজিস্ট ক্রিস্টার মতো খুবই সামান্য কিছু চরিত্রকে কাছের মানুষ হিসেবে মনে করেন এবং তাদেরকে তিনি সব সময় প্রোটেক্ট করতে পান।
কিন্তু এলিয়ট কখনো তাদের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করেন না। তিনি যখন দেখেন ক্রিস্টা যেই লোকটির সাথে সম্পর্কে যেতে চাচ্ছে সে আসলে পূর্ব থেকেই বিবাহিত, তখন এলিয়ট লোকটির সব ব্যক্তিগত তথ্য হ্যাক করে তা দিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করেন ও ক্রিস্টার কাছে সত্য স্বীকার করতে বলেন, কিন্তু ক্রিস্টাকে কিছু জানান না। এভাবে অগোচরেই এলিয়ট তার নিকটজনদেরকে সাহায্য করেন, তারা না চাইলেও। এক্ষেত্রে এলিয়ট কে কিছুটা স্বৈরাচারী বলা যায় বৈকি, কিন্তু এসবের মাঝে এলিয়টের অনুভুতিপ্রবণ মনের একটি পরিচয় আমরা পাই।

এলিয়ট চান মানুষকে সমাজের প্রভাবশালী লোকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে রক্ষা করতে। কিন্তু এর জন্যে তিনি বে-আইনি সব পথ অবলম্বনে দ্বিধাবোধ করেন না। কারণ ধর্ম, আইন, নিয়ম সবকিছুকে তিনি অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হিসেবে দেখেন।
“Control can sometimes be an illusion. But sometimes you need illusions to gain control. Fantasy is an easy way to give meaning to world. To cloak our harsh reality with escapist comfort. After all, isn’t that why we surround ourselves with so many screens? So we can avoid seeing? So we can avoid each other? So we can avoid truth.”-Elliot alderson
এজন্যই একপর্যায়ে তিনি নিজেই যখন সবকিছুর নিয়ন্ত্রক বনে যান, তখন তার মধ্যে আত্মপরিচয় সংকট দেখা যায়।

এলিয়ট সমাজের অন্যায়কে তুলে ধরেন, প্রশ্ন তোলেন যে আমরা কি সত্যিই স্বাধীন নাকি আমরা অদৃশ্য কলকাঠির নিয়ন্ত্রণে আছি? সিরিজটি আমাদের দিকে অনেক অনেক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, আমাদেরকে ভাবায়।
এই পুরো শো টিতে আছে কিছু দুর্দান্ত চিন্তার উদ্রেককারী সংলাপ। এছাড়াও এলিয়টের অন্তর্মুখী স্বভাব, একাকিত্ব, সামাজিক ভীতি সবকিছুই সোশ্যাল এংজাইটি তে ভোগা মানুষদের চিন্তাভাবনাকে বুঝতে সহায়তা করে। সিরিজটিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট জনরায় ফেলা যায় না। সংলাপনির্ভর, রহস্য, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, ড্রামা ইত্যাদি বিভিন্ন জনরার বৈশিষ্ট্য এতে রয়েছে। এর সিনেমাটোগ্রাফিতেও নতুনত্ব দেখা যায়।

ক্যামেরার ফ্রেমে চরিত্রদের কে অল্প পরিসরে দেখানো হয়েছে এবং ব্যাকগ্রাউন্ডকে বেশি দেখানোর মাধ্যমে গল্পটিকে চরিত্রদের ব্যক্তিগত কাহিনী নির্ভর না দেখিয়ে এসবের উর্ধ্বে একটি আইডিওলজির গুরুত্বকে মূখ্য বোঝানো হয়েছে।
শুরুতে গল্পটি হ্যাকিং ঘিরে আবর্তিত হলেও ধীরে ধীরে এটি আরো দুর্দান্ত সব ঘটনায় মোড় নেয়। মি. রোবটের চাঞ্চল্যকর দুনিয়ায় ডুব দিতে দেখে ফেলতে পারেন সিরিজটি। পুরো সিরিজটি দেখতে পাবেন নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে।
Feature Image Courtesy: variety.com