শিল্প বিপ্লবের পর প্রত্যেক জাতিকে যে দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে যেতে হয়েছে তাহলো যুদ্ধ পরবর্তী কালের গুছিয়ে ওঠার সময় টা। ভারতীয় উপমহাদেশের তিন তিনটি যুদ্ধপরবর্তী ফলাফল ছিল বিপর্যস্ত, হাহাকার, এবং দুর্দশাময়। খাবার এবং আয়-উপার্জনের অভাব যেন গ্রাস করে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব জায়গাতেই। দুর্ভিক্ষে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় জীবন।
বাংলাদেশ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই অবস্থার শিকার হয়েছে। এই যে দুঃখ-দুর্দশা এবং তা থেকে পেয়ে বসা হতাশা তা সঞ্চারিত হয় সাহিত্য বা পারফর্মিং আর্টেও। গল্প-উপন্যাস কবিতায় তার ছাপ পাওয়া যায়। তাইতো প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতায় দেখতে পাই কবি কী যেন ভাঙতে চাইছেন। কারণ ভাঙলেই নতুন করে গড়ার শক্তি পাওয়া যায় আর এ শক্তি তিনি সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষ সরাসরি অংশ না নিলেও বৃটেনের পক্ষ হয়ে ঘানি টানতে হয়েছে বেশ। কলকাতা, ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরী। জাপানি বোমার আঘাত এ নগরীতেও পড়েছে। এদিকে ভারতের খাদ্য গুদামজাত করে চালান হয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ সেনাদের জন্য। চারিদিকে এত অশৃংখল, হাহাকার সবকিছু মিলিয়ে বাংলায় নেমে এলো এক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। পরবর্তীতে দেশ বিভাজন।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো বটে তবে রেশ রয়ে গেল। সেই রেশটাকে উপজীব্য করে তুলির আঁচড় দিলেন এক অখ্যাত বাঙালি পরিচালক নাম ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিক ঘটক অবশ্য পরে আর অখ্যাত থাকেননি। তবে এখন যতটুকু নাম তার তা তিনি জীবদ্দশাতেই পাননি। অবশ্য গুণীর কদর সবসময় মৃত্যুর পর তুলে রাখা হয় কি-না তাই হয়তো সেই তুলির আচড়ের ক্যানভাসে করা ‘নাগরিক’ ছবিটি ১৯৫২ সালে তৈরি হলেও মুক্তি দিতে হয়েছে ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে।

এত দেরিতে চলচ্চিত্রটি মুক্তির পেছনে যে কারণ বলা হয় তা ঐ সময়ের পারফর্মিং আর্ট গ্রহণের দৈন্যতা বলে মনে হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল এ ছবি দেখালে জনগণ দেখবে না, পয়সা আসবে না, এ ছবি ব্যবসা করবে না, এ ছবি জনগণ বুঝবে না। মেঘে ঢাকা তারা (২০১৩) নামে ঋত্বিক কুমার ঘটকের জীবনী নিয়ে একটি ছবি আছে। যদিও তারা ডিসক্লেইমার এ বলে রেখেছে এটি তার জীবনী নিয়ে ছবি নয়। তবে যে কেউ দেখলেই বুঝবে যে এটি ঋত্বিক ঘটক কে নিয়েই বানানো ছবি। সেখানে একটি সংলাপ আছে, পাড় মাতালরা ঋত্বিক ঘটকের সাথে বসে মদ খাচ্ছে এবং বলছে “গুরু তোমার ছবি বুঝিনা, তাই দেখি না।”
সংলাপ শুনে মনে হয় অভাব দুর্দশার মধ্যে জনগণ যে বিনোদন চায় সেটা নিছক বিনোদনই। কোন সামাজিক বার্তা গ্রহণ করতে তখন তারা প্রস্তুত নয়। অথবা যে সমাজ সমাধান চায় তাকে সমস্যার গল্প বলে মানসিক পীড়া নিতে তারা আর রাজী নয়। শিল্পীরও তো দায়ভার আছে। গল্প বলে যাওয়া, সময়ের গল্প বলে যাওয়া। ঋত্বিক ঘটক শুধুমাত্র ছবি বানানোর জন্য পরিচালক হতে চাননি। তিনি চেয়েছেন তাঁর গল্পগুলো যেন খুব সহজেই অনেক মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া যায় তার একটি মাধ্যম হিসেবে তিনি চলচ্চিত্র কে ব্যবহার করেছেন। যাই হোক ‘নাগরিক’ এ ফিরে আসি। বাংলার প্রথম আর্ট ফিল্ম হওয়ার কথা ছিল। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী তৈরি হওয়ার আগে নির্মিত এ ছবিটি। ছবিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এবং দেশভাগের পর বিপর্যস্ত কলকাতা শহর কে নিয়ে। বিপর্যয়টা ঠিক বাহ্যিক নয়। ট্রাম, নগরীর ব্যাস্ততা, কোলাহল সবই রয়েছে তবুও ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ে যাচ্ছে কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণী। ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু হওয়া চাকরির বিপ্লবে যখন সকল শ্রেণীর মানুষ যুক্ত হচ্ছে তখন দেখা গেল এক অদ্ভুত সংকট।

বেকারত্ব, এমন ভয়াল থাবা, যে কর্মের জন্য মেট্রিক পাশ ছাত্র চাওয়া হচ্ছে সেই জায়গায় বিএ পাস এমএ পাস ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না। একটি শিক্ষিত ছেলের উপর নানা চাহিদা থাকে সেটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের। সে যদি সেই চাহিদা পূরণ করতে না পারে তাহলে তার মানসিক অবস্থা হয়ে যায় এক অবরুদ্ধ কারাগার। এই কারাগারের সে একা নয়। তার মতো আরও বহু জন কিন্তু এই অবরুদ্ধতা তো একদিন ভাঙতে হবে।
প্লট
রামু একজন বিএ পাস গ্রাজুয়েট। দেশভাগ পরবর্তী ভারতের হন্য হয়ে চাকরি খুঁজছে কিন্তু চাকরি ধরা দিচ্ছে না। তবু সে ভীষণ আশাবাদী। সে আশা দেখায় তার পরিবারকে যে দিন ঘুরবে এবং তারা আরো ভালো বাড়িতে উঠবে যদি তার চাকরি হয়ে যায়। ঘরে তার একটি বোন যার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে তবুও বিয়ে হচ্ছে না। এ নিয়ে তার বোনটি অর্থাৎ সীতা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। রামুর প্রেমিকা উমা, উমার বোন শেফালী এবং তার মা পাশের গলিতে থাকে। তাদের অবস্থাও নাজুক। রামু তাদেরও সাহায্য করতে পারে না। উমা বসে আছে রামুর কবে চাকরি হবে, কবে ওরা বিয়ে করবে। এদিকে রামুর পরিবারের অবস্থা দিনকে দিন আরো খারাপ হয়। আর মা যেন সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। ঘরে নতুন করে একজনকে ভাড়া দেয়া হয় যিনি বেকার কেমিস্ট। তার নাম সাগর। এই সাগর মাঝেমধ্যে কিছু টাকা উপার্জন করে রামুর পরিবারকে সহায়তা করে যা রামুর মনে আরও তীব্র আঘাত হানে। বাবা মারা যায়, চাকরি আর হয় না। ভালো ঘরের যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল সেটি পরিবর্তে এখন তাদের যেতে হচ্ছে বস্তিতে একটু থাকার জন্য। সেই উমা বলে ওঠে সেই গিয়ে ঘর গুছিয়ে দিতে পারবে। রামু যেন নতুন শক্তি পায়, জীবনকে অন্যভাবে দেখার এবং এই দুর্গম পথ তারা একসাথে পাড়ি দিবে।

বস্তিতে ওঠার আগে সাগরকে চলে যেতে হবে। তবে সীতা এসে স্বীকার করে সাগরকে সে ভালবাসে। সাগরও সীতা কে ভালবাসে। তবে এই বেকারত্বের অভিশাপের জীবনে সীতাকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবে? তাই সে সীতাকে গ্রহণ করতে অপারগ। কথোপকথনের কিছু অংশ শুনে ফেললে, রামু সাগরকে বলে সীতাকে গ্রহণ করে তাদের সাথে আসতে। এই দুর্গম পথ, বিপর্যস্ত জীবন তাদের একসাথে পাড়ি দিতে হবে। দৃশ্যের শেষ অংশে বৃষ্টিকে চিহ্ন হিসেবে দেখানো হয়েছে যেন পুরাতনকে ধুয়েমুছে নতুন কিছু স্বপ্ন দেখায়।
ছবিটির বার্তা
নাগরিকের মূলত চিত্রিত হয়েছে ওই সময়ের দুর্দশা, বেকারত্বের হতাশা। ছবিটি দেখলে মনে হবে সমস্যার যেন শেষ নেই। সামাজিক সমস্যা, শিল্প বিকশিত হওয়ার সমস্যা, একজন বিএ পাস ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার সমস্যা, পরিণয় সমস্যা, মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। প্রত্যেক সমস্যার মূলে যেন একটাই সমস্যার সমাধান রয়েছে আর তা হলো অর্থনৈতিক। এই সমস্যাটা এমনভাবেই ছড়িয়ে গেছে যে অর্থনৈতিক সমস্যাটার সমাধান হলেই সকল সমস্যা দূর হয়ে যায় আর না হলে আরো সমস্যা এসে যুক্ত হয়।

তবে একইসাথে ‘নাগরিক’ সিনেমায় এমন কিছু উপাদান ঋত্বিক ঘটক তুলে ধরেছেন যা এখন পর্যন্ত সত্য। সকলে কেন চাকরির পিছনে ছুটছে? এই অবস্থা পরিত্রাণের উপায় বার্তা ঋত্বিক খুব সূক্ষ্মভাবে দিয়ে গেছেন। নগর জীবন নিয়ে ষাটের দশকে যা নির্মাণ করেছেন তা এখনও ধ্রুপদী এবং কালজয়ী। এই ছবি দেখে জনসাধারণ ভাববে, যেন সমস্যা দেখিয়ে পরিচালক চলে গেলেন। সমাধান বললেন না। সমাধান কী হবে? এই জায়গাতে ঋত্বিক ঘটকের বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করি, “ভাবো! ভাবো! ভাবা প্র্যাকটিস করো।”
Feature Image Courtesy: mediaindia.eu