অমর একুশে গ্রন্থমেলা- ২০২২ এ ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে লেখক ও সাংবাদিক জান্নাতুল নাঈম পিয়ালের অনুবাদগ্রন্থ ‘নারীর কলমে নারী’।
সাতজন নারী লেখকের আটটি গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। লেখিকারা হলেন: কেট শঁপ্যা, মনসুরা শরিফজাদে, এ.আর.খাতুন, অনিতা দেশাই, ডরোথি পার্কার, মার্গারেট অ্যাটউড, স্বাভা ইয়াকবসদত্তিরের।
লেখকদের মধ্যে কেউ আমেরিকান, কেউ ইউরোপিয়ান, কেউ উপমহাদেশীয় (ভারতীয়/ পাকিস্তানি), কেউ ইরানি। তবে গল্পগুলোতে নারীদের জীবনের বিবিধ সংকট উঠে এসেছে দারুণ বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে।

কেট শঁপ্যার ‘অপ্রত্যাশিত’ গল্পে আমরা দেখি একজন নারীর প্রেমকে। সাধারণত আমাদের কাছে নারীদের সতী-সাধ্বীরূপ প্রত্যাশিত। কিন্তু সব নারী কি তেমন হবেন? না-ই হতে পারেন তারা। পুরুষেরা যেমন মুভ-অন করে, তেমনি একজন নারীর প্রেমও তো মুছে যেতে পারে সময়ের সাথে সাথে। পুরুষ যেমন অনেক সময় রূপ দেখে ভালোবাসে, তেমনি স্বার্থপর তো একজন নারীও হতে পারেন।
আবার, সমাজে আমরা অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে পুরুষকেই মূলত সক্ষম মনে করি। কিন্তু নারীরা কি পারবেন না তা? তারা কি হতে পারেন না বটবৃক্ষের ছায়া? এসব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কারভাবে মেলে এ. আর খাতুন এর ‘সম্মান’ গল্পে। তবে একজন মানুষ দিনশেষে রক্ত-মাংসের মানুষ। তাই সীমাবদ্ধতা- হোক তা চিন্তার বা সম্পর্কের- তা থাকে মানুষের। যেমন: সম্মান গল্পের সালেকা (কল্পিত নাম) একসময় অর্থ উপার্জনকেই সম্মান পাবার একমাত্র পথ ধরে নিচ্ছেন। যদিও এর আগে অনেক সংগ্রাম-অশ্রু-ঘাম পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাকে।

আবার ‘আমার যত রেপ ফ্যান্টাসি’ গল্পে মার্গারেট অ্যাটউড নারীমানসকে বহুমাত্রিক দিক থেকে তুলে ধরেছেন। একই ব্যক্তি যে একসময় কোন একটা ধর্ষণ সংঘটন করছে, পাশবিক লালসায় জানোয়ার হয়ে উঠছে; সেই মানুষটি আবার অন্য কোন সময় হয়তো সিনেমার পর্দায় ভালোবাসার বিচ্ছেদ দেখে চোখের পানি ফেলে! তাহলে মানুষ কার কাছে ভালো আর কার কাছে খারাপ?
মানুষ কতটুকু সহৃদয় আর কতটুকু পৈশাচিক- তা আমরা একটা সরলরেখায় থেকে বুঝতে পারিনা।
আবার একজন নারীর কাছে কোনটা বড় হবে- আত্মসম্মানের সাথে কষ্টের জীবন, নাকি জীবনে সাচ্ছন্দ্যর জন্য তার নিজস্ব সত্ত্বা বিসর্জন দেয়া- এমন প্রশ্নও উঠতে দেখবো আমরা অন্য একটি গল্পে।
আবার অনিতা দেশাইয়ের লেখা ‘কাজের বুয়া’ গল্পে শ্রেণিচেতনার নিরীখে আমরা মানুষের গড়া সম্পর্কগুলোর মূল্যায়ন দেখতে পাই। খুব বেশি স্পষ্ট না হলেও অনেকক্ষেত্রে ‘প্রিভিলেজড’ আর প্রান্তিক নারীদের জীবনের সংগ্রামগুলো যে এক বিন্দুতেই এসে মেলে- তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি।

সামাজিকভাবে আমরা নারীদের ভেবেছি মা, বোন, কন্যাসহ এমন অনেক পারিবারিক ও বৈবাহিক সম্পর্কের নিরীখে। কিন্তু একজন নারীর এসব পরিচয়ের আড়ালে যে কখন তার ভেতরের ‘মানুষটা’ মরে যায়- তা আমরা টেরও পাইনা।
বইয়ের একেবারে শেষ গল্প ‘বাচ্চাদের জন্য’-তে এমন একটা সংকট উঠে এসেছে। একজন নারী তার মাতৃত্বকে জীবনের অংশ হিসেবে না নিয়ে জীবনই বিলীন করে দেন মাতৃত্বের ভেতর। তারপর সেই অর্জিত অভ্যস্ততা বয়ে নিয়ে চলেন আজীবন।
আমাদের মা-দের কি কখনো আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখে মনে দোলা লাগে? তাদের কি নতুন রান্না করা মাংসের বড় টুকরা বা বড় মাছের মাথা খাওয়ার ইচ্ছা থাকে? এসব উত্তর খোঁজার সময় আমাদের নেই। আমরা মাতৃত্বকে মহান করতে গিয়ে আমাদের মা-দের ঐশ্বরিক এক সত্ত্বার মত মনে করি। তারপর একসময় তাদের নিঃসঙ্গতার সাগরে ডুবিয়ে রেখে আমরা নিজেদের মত ব্যস্ত হয়ে যাই। এমন আরো অনেকরকম সংকটকে নারীদের চোখ দিয়েই দেখা হয়েছে বইটিতে।

অনুবাদে যথেষ্ঠ সাবলীলতার পরিচয় দিয়েছেন জান্নাতুল নাঈম পিয়াল। অনুবাদগ্রন্থে লেখক গল্পনির্বাচন করেছেন বেশ সতর্কতার সাথে। অনুবাদে রয়েছে একরকম কাব্যময়তা, যা বাক্যগুলোকে আরো সাবলীল করেছে। যেমন: বাবাকে ইরানীরা ‘আকা জান’ ডাকে। এখানে ‘মায়ের বিয়ে’ গল্পে তিনি ‘আকা জান’ ডাকটাই রেখেছেন।
পরীক্ষায় ‘গ্যাপ দেয়া’ কিংবা ‘বিটকেলে জ্বর’ এর মত শব্দবন্ধ অনুবাদকে পাঠকের আরো কাছের করেছে। অহেতুক কঠিন শব্দের প্রয়োগ থেকে তিনি মুক্ত থেকেছেন। অনুবাদে মূল ভাব বেশ ভালোভাবে রক্ষা করেই সাবলীল ভাবানুবাদ করেছেন। নারীর চোখে নারীকে দেখা, জানা, বোঝা ও নারীর হৃদয়ের অন্দরে প্রবেশের জন্য বইটি ভীষণ উপযোগিতা রাখে।
Feature Image Courtesy: oitijjhya.com