একজন নারীর আসল ঠিকানা কোনটা? কী তার আসল পরিচয়? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কারো কন্যা, কারো বোন, কারো মা হয়ে অতিবাহিত হতে থাকে তাদের জীবন। কিন্তু এই সমস্ত সাংসারিক দায়িত্বের বাইরে তারও তো আছে একটি ব্যক্তিসত্ত্বা। তারও আছে একটি ব্যক্তিগত জীবন। কিন্তু সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে শেষপর্যন্ত কি থাকে তাদের ব্যক্তিগত কোন পরিচয়?
১৯৮৫ তে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পরমা’ সিনেমায় সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন নন্দিত নির্মাতা ও অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। ছবির মুখ্য চরিত্র পরমা-র রূপদান করেছেন রাখী।

ছবিতে দেখা যায় পরমা বছর চল্লিশের এক গৃহবধূ। তাঁর রয়েছে স্বামী, তিন সন্তান, শ্বাশুড়ি ও আরো কিছু আত্মীয়দের নিয়ে বিরাট সংসার। আঠারোর বছরের দিকে পরমার বিয়ে হয়েছিল। অবশ্যই এরেঞ্জড ম্যারেজ ছিলো সেটি। তখনও ভালোবাসার মানে কী তা বুঝে উঠতে পারেনি সে। তার আগেই কাঁধে চেপে বসেছিল সংসারের বড় বড় সব দায়িত্ব৷ দায়িত্বশীল পুত্রবধূ, স্ত্রী কিংবা মা- সবকিছুই হলো পরমা। কিন্তু এর বাইরে পরমার একান্ত নিজস্ব কিছু কি ছিলো?- তা নিয়ে আর চিন্তা করার অবকাশ সে পায়নি।

এ সময়ে আবির্ভাব ফটোগ্রাফার রাহুলের (মুকুল শর্মা)। রাহুল এসেছেন একটি এসাইনমেন্ট নিয়ে, একজন চিরাচরিত ভারতীয় গৃহবধূর ওপর কভার স্টোরি করতে। পরমাকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন। প্রস্তাব করেন মডেল হতে। প্রথমে পরমার সংকোচবোধ হয়। কিন্তু পরিবারই তাকে বলে কাজটা করতে। এতে তাদের নাম-যশ বাড়বে বৈকি!
রাহুলের সাথে শ্যুট করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে পরমা চলে যায় তার শৈশবে। একসময় সেতার শিখত সে। কিন্তু বিয়ের পর আর হলো কই! সংসারের চাপে সেতার শেখা আর হয়ে ওঠেনি তার৷ পরমার স্বামীকে কি এমন কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে? না, করতে হয়নি। কিন্তু পরমার যেন বিয়ে করতে হয়েছে পুরো একটি সংসারকে। আর সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে তার ব্যক্তিগত সবকিছু।

ঘটনাচক্রে রাহুলের সাথে চুম্বন বিনিময় হয়ে যায় তার! অনুতপ্ত পরমা সাথে সাথেই চলে যায় সেখান থেকে। এরপর তাকে দেখা যায়, সবার অলখে কাঁদতে। সে তো একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের বউ, সে এমন কাজ কীভাবে করতে পারলো? – এ নিয়ে তার ভেতরে চলতে থাকে দ্বন্দ্ব৷
তবে সাথে সাথে আরেকটা জিনিসও ঘটে৷ সংসারের এত চাপ সামলাতে গিয়ে কখনোই ভালোবাসার বিষয়টাকে তেমনভাবে অনুভব করতে পারেনি পরমা। এবার যেন রাহুলের সংস্পর্শ পেয়ে এই চল্লিশ বছর বয়সে পরমার মনে হয় সে পেতে যাচ্ছে আরাধ্য ভালোবাসার ছোঁয়া। পরবর্তীতে আমরা দেখি পরমার কাছে কাজের সূত্রে রাহুলের আগমন এবং তাদের শারীরিক সংসর্গে জড়িয়ে যাওয়া।
যে পরমা বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্তব্যপালন করতে করতে হয়ে উঠেছিল অনুভূতিশূণ্য যন্ত্রসদৃশ একজন মানুষ; সেই পরমা যেন রাহুলের ভেতর খুঁজে পেলো মানসিক সম্পর্কের এক নতুন দ্বার উন্মোচনের সুযোগ। রাহুলের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর পর কেটে গেলো তার জড়তা। এরপর মাঝে মাঝেই দেখা হতে থাকলো তাদের।

সম্পর্কটি যখন আরো গভীরতা পাচ্ছে, তখন হঠাৎ-ই লাপাত্তা রাহুল। তার আর কোন খোঁজ আমরা পাইনা। কিন্তু পরমার জীবনে নেমে আসে নতুন এক ঝড়।
রাহুলের অণুপ্রেরণায় কিছু গ্ল্যামারাস ফটোশুট করে পরমা। রাহুল কথা দিয়েছিলেন এসব কোন পত্রিকায় ছাপার জন্য না, এসব শুধুই তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এক পত্রিকার মোটা টাকার অফারের বিনিময়ে ছবিটি দিয়ে দেন রাহুল। আর ঘটনাচক্রে সেই ছবিটি চোখে পড়ে পরমার স্বামীর (অভিনয়ে দীপংকর দে।)

এবার যেন পরমার পুরো পৃথিবীটির উল্টো ঘূর্ণন শুরু হয়। যে পরমা ছিলো সংসারের সকলের আরাধ্য, সকলের প্রিয়- তাঁকে অসতী আখ্যায়িত করে ছুঁড়ে ফেলতে চান সবাই! শুধু পরমার সবচেয়ে ছোট ছেলে শিশুটি বাদে। সে এখনো ‘অবুঝ’, তাই মাকে কেন পরিত্যাগ করতে হবে- তা ভেবে পায়না৷
আর এদিকে পরমা- সবার প্রত্যাখান দেখে দেখে বুঝতে পারে, সে আসলে তাদের কাছে কর্তব্য পালনের হাতিয়ারমাত্র; ব্যক্তি পরমাকে ভালোবাসেনি কেউ-ই। এমনকি যে রাহুলের মাঝে সে খুঁজে পেয়েছিল মানসিক সম্পর্কের সুযোগ, সেও প্রতারণাই করলো তার সাথে।
অব্যাহত প্রত্যাখানের ফলে একসময় নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার হয় পরমা। তাকে পাঠানো হয় এসাইলামে। তারপর একসময় মোটামুটি সুস্থ হয় সে। কিন্তু তারপর পরমা কী করলো? সে কি তার সংসারের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে ফিরে গেলো সেখানে, নাকি নিজেই করে নিলো নিজের ব্যবস্থা?

পাঠক, এটুকু আর ভেঙে বলবো না। সিনেমাটি দেখলেই বিষয়টি আপনাদের কাছে পরিষ্কার হবে।
মুক্তির পর ছবিটি সে সময়ে ব্যবসায়িক সাফল্য ও জাতীয় পুরষ্কার, দুই-ই পেয়েছিল। পেয়েছিল সমালোচকদের আনুকূল্যও। কিন্তু তখনও এই ছবির গল্পকে মেনে নিতে পারেনি রক্ষণশীল অনেক মানুষ। কোলকাতায় বিক্ষোভ হয়েছিল। কিছু সমালোচক বলেছিলেন ছবিটি উসকে দিচ্ছে পরকীয়াকে, এমন ছবি ভেঙে দেবে পারিবারিক বন্ধন! তবে তাতে করে দমে যাননি অপর্ণা সেন। তিনি পরিষ্কারভাবেই জানান যে, ছবিটিতে তিনি দেখাতে চেয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকা নারীদের, সংসারের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে যাদের মানুষ হিসেবে আর কোন ব্যক্তিগত সত্ত্বা অবশিষ্ট থাকেনা। পরমা মূলত তেমনই একজন, নারীর শুধুমাত্র নারী পরিচয়কে অতিক্রম করে একজন মানুষ হয়ে ওঠার গল্প৷
Feature Image Courtesy: Youtube.com