গ্রীক স্থাপত্যশৈলীর ইতিহাস বেশ পুরনো। খ্রিস্টের জন্মের অন্তত দুই হাজার বছর আগে থেকে সেখানকার বিভিন্ন স্থাপত্যকর্মের বিবরণ পাওয়া যায়।
প্রধানত তিনটি ধাঁচ সেখানকার স্থাপত্যে পাওয়া যায়। এর ভেতর একটি হলো ডরিক ধাঁচ। আর এই ধাঁচে নির্মিত অনন্য একটি স্থাপত্য নিদর্শন গ্রীসের পার্থেনন মন্দির। অ্যাক্রোপলিস পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি। দেবী অ্যাথেনা পার্থেনোস এর উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল মন্দিরটি। পার্থেনোস অর্থ কুমারী। দেবী অ্যাথেনা ছিলেন তাদের সৌন্দর্যের দেবী।
তৎকালীন শাসক পেরিক্লিসের নির্দেশনা অনুযায়ী মন্দিরটি তৈরি করেন ইকনিটাস ও ক্যালিক্র্যাটাস। তারা এখানে অনুসরণ করেন প্রখ্যাত গ্রীক স্থাপত্যবিদ ফিডিয়াস এর স্থাপত্য-দর্শন।
৪৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর কাজ শুরু হয়ে চলেছিল ৪৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। পরবর্তীতে ৪৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিডিয়াস দেবী অ্যাথেনার একটি মূর্তি তৈরি করেন সোনা ও পিতলের সমন্বয়ে।

মন্দিরটির ভূমিতে তিনটি ধাপ করা আছে। ছাদে আছে পাথরের পর পাথর দিয়ে তৈরি স্তর। মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে আয়তাকার, সাদা মার্বেলে। ছাদে আছে আলাদা বিভিন্ন নকশা, যা উপবৃদ্ধির মত সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে।
এর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তজুড়ে আছে নিচু ত্রিকোণাকৃতির পেডিমেন্ট। পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তে আটটি ও উত্তর-দক্ষিণ প্রান্তজুড়ে সতেরোটি কোলোনেড বিদ্যমান। মূলত এখানকার মূল কাঠামোর স্তম্ভগুলোকেই এক-একটি কোলোনেড বলা হয়। এর ভেতর রয়েছে আয়তাকৃতির একটি সেল বা প্রকোষ্ঠ। প্রতি দুটি কলোনেড মিলে এই সেলকে তিনটি করে ভাগে ভাগ করেছে।

প্রকোষ্ঠ বা সেলের ভেতরটি অন্ধকার। শুধু পূর্বদিকের দরজা দিয়ে অল্প একটু আলো আসে। প্রকোষ্ঠটির ছাদ ও সিলিং এর দিকটায় মার্বেল পাথর দিয়ে টাইলস করা আছে। এই প্রকোষ্ঠের পেছনে পশ্চিম প্রান্তে আছে আরেকটি বর্গাকৃতির চেম্বার।
স্থাপনাটির দৈর্ঘ্য ২২৮.১৪ ফুট ও প্রস্থ ১০১.৩৪ ফুট। স্তম্ভগুলোর নকশায় একরকম যৌগিকতা আছে। অর্থাৎ, বিভিন্ন রকম দ্রব্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে।
স্থাপনাটিতে আছে বিভিন্নরকম নকশা। আছে পাথরে খোদাই করা মূর্তি। পূর্বদিকে দেখানো হয়েছে দেবতাদের সাথে দানবদের যুদ্ধের চিত্র। দক্ষিণে খোদাই করা হয়েছে গ্রীকদের সাথে রোমান সেনচুয়ারদের যুদ্ধের চিত্র। সেনচুয়ারদের প্রতি বাহিনীতে থাকত একশো সদস্য, তাই এমন নাম। পশ্চিমে খোদাই করা আছে গ্রীক ও আমাতোনদের লড়াইয়ের দৃশ্য। তবে উত্তরদিকের দৃশ্য হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।

সেল বা প্রকোষ্ঠটির দেয়ালের শীর্ষে আছে দেবী অ্যাথেনার জন্য আয়োজিত বার্ষিক অনুষ্ঠানের চিত্র। সেখানে দেখা যায় দেবীকে পরিবেষ্টন করে বসে আছেন যাজক ও তার সহকারী যাজিকারা। আর তাদের চারপাশে দুটি সারিতে সমবেত হয়েছেন সকল দেব-দেবীরা।
সেলের পূর্বের দেয়ালে দেখা মেলে অ্যাথেনার জন্মের সময়ের চিত্রের। আর পশ্চিমের দেয়ালে আছে রাজ্যদখলের জন্য সমুদ্রের দেবতা পোসেইডন এর সাথে দেবীর তুমুল যুদ্ধের দৃশ্য।
পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত এই স্থাপনাটি প্রায় অবিকৃত ছিল। তবে রোমানদের দখলে আসার পর ফিডিয়াস এর তৈরি করা ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা হয়। স্থাপনাটিকে একটি চার্চের মত ব্যবহার করা শুরু হয়। তবে সে সময়ের রোমানদের ধর্মবিশ্বাস ছিল এখনকার ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। তারা ছিলেন প্যাগান অর্থাৎ, পৌত্তলিক। কিন্তু তাদের দেব-দেবীরা ছিল গ্রীক দেব-দেবীদের চেয়ে আলাদা। আর তাই, গ্রীকদের হটিয়ে অ্যাক্রোপলিস এর দখল নেবার পর সোনা ও পিতলের সমন্বয়ে ফিডিয়াস এর বানানো মূর্তিটি ভেঙে ফেলা হয়। সপ্তম শতাব্দীতে ভেতরের অনেক কিছুই পরিবর্তন করে ফেলা হয়। মন্দিরের ভেতরের চিত্রগুলো থেকে শুরু করে ছাদের দিকের নকশা কিংবা সেলারের ভেতরের খোদাই করা চিত্রগুলোর ভেতর অনেক কিছুই নষ্ট হয়।

১৪৫৮ সালে তুর্কিরা এক্রোপলিস দখল করলে পারথেনন ব্যবহৃত হতে শুরু করে মসজিদ হিসেবে। তারা মূল স্থাপনাটি অক্ষুণ্ণ রেখেছিল, সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমে বানিয়েছিল একটি মিনার। এখানে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে। ইসলামে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। সেক্ষেত্রে তুর্কিরা স্থাপনাটিকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করলো কী করে? এক্ষেত্রে তারা পশ্চিমদিকের কিছু মূর্তি ভেঙে ফেলে। যে জায়গাটি নামাজের জন্য ব্যবহৃত হতো সেখানে কোন মূর্তি রাখা হয়নি। তবে পশ্চিমের যে দেয়াল-চিত্রগুলো ছিল সেসবসহ বাদবাকি সব খোদাইকৃত ছবিই কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। স্থাপনাটি দুই বছর মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৬৮৭ সালে ভেনেসীয়দের সাথে তুর্কিদের যুদ্ধে বোমাবর্ষণে দালানের মূলকেন্দ্রটি ধ্বংস হয়ে যায়। মূলকেন্দ্রটিতে ভেনেসীয়রা গান পাউডার রেখেছিল। গান পাউডার বিস্ফোরিত হওয়াতেই এ অবস্থা হয়। ১৮০১-১৮০৩ সালের মধ্যে এর বড় একটি অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেটাও যুদ্ধেরই ফল। বারংবার যুদ্ধের কবলে পড়ে মন্দিরটির অনেক নিদর্শনই ধ্বংস হয়ে যায়।

১৮১৬ সালে ব্রিটিশ নাগরিক থমাস ব্রুস ও লর্ড এলজিন তুর্কিদের সাথে আলোচনা করে এটা কেনার সিদ্ধান্ত নেন। সে বছরই ব্রিটিশ মিউজিয়াম এটি কিনে নেয় ও এর অভ্যন্তরীণ প্রায় সব নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। বাদ-বাকি নিদর্শন যা ছিল তা দিয়ে দেয়া হয় ফ্রান্সের প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে। এছাড়া কোপেনহেগেন জাদুঘরেও রয়েছে এর কিছু নিদর্শন। গ্রীসের এথেন্সের জাদুঘরেও স্থাপনাটির বিভিন্ন নিদর্শনের দেখা মেলে।
আর বর্তমানে মূল কাঠামোটির যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাক্রোপলিস পাহাড়ের উপরে। সূর্যাস্তের সময় বিশেষত অপার্থিব সুন্দর লাগে স্থাপনাটি দেখতে।
Feature Image Courtesy: hexapolis.com
Reference: