বিশ্বব্যাপী প্যাণ্ডেমিকের মাঝে নিউ নরমালে সোশাল ডিসটেন্সিং যখন অপরিহার্য তখন তুমুলভাবে আমাদের সময় কাটানোর সঙ্গী সোশাল মিডিয়া; ইন্সটাগ্রাম এর মধ্যে অন্যতম। আশেপাশের মানুষ বা সেলিব্রেটিরা কীভাবে সময় কাটাচ্ছে তা জানতে এবং আপডেটেড থাকতে প্রায়ই আমরা চোখ বুলাই এই অ্যাপ এ। ২০১৯ সালেও ইন্সটাগ্রামে সবচেয়ে বেশি আয় করা ইনফ্লুয়েন্সারের তালিকায় প্রথমে ছিলেন কাইলি জেনার, অনলাইনে সবচেয়ে বেশি ফলো করা আইডির মধ্যে চতুর্থ অবস্থান রয়েছে যার (বর্তমানে ফলোয়ার সংখ্যা ১৮১.১৯ মিলিয়ন)। তো কিছুদিন আগেও কাইলি জেনারের বিভিন্ন পোস্টের কমেন্ট অপশনে গেলেই একটি জিনিস সবচেয়ে বেশি চোখে পড়তো, তা হচ্ছে #payup.
মার্চের শুরুর দিকে যখন বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় তখনো মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ছিলো যে লকডাউন দেওয়া হবে কি হবেনা। ততোদিনে বিদেশের নানা দেশগুলোতে চলছে ভয়ংকর অবস্থা। অবশেষে ২৫ তারিখ সরকার লকডাউন জারি করলেও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লকডাউনের মেয়াদ; কয়েক সপ্তাহের কথা ভেবে প্রায় সবাই ব্যাপারটা মেনে নেয়। কিন্তু এই মার্চেই লকডাউনের ঠিক আগে কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে আসতে থাকে কিছু মেইল, যার বক্তব্য খুব স্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত। অধিকাংশ মানুষ ঘুণাক্ষরেও জানতোনা কতোটা দুঃসংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে এই ছোট্ট মেইলগুলো।
এপ্রিলের শুরু থেকেই বাংলাদেশের বড় বড় পত্রিকাগুলোর শীর্ষ সংবাদ ছিলো এদেশের প্রধান রপ্তানিমুখী শিল্প গার্মেন্টস ইণ্ডাস্ট্রি এর চরম দুর্দশার কথা। কোভিড-১৯ এর জন্য বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে সত্য, ধারণা করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার আসতে পারে বিশাল মন্দা। এর ফলে বাংলাদেশের মতোন উন্নয়নশীল দেশেও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে সত্য, কিন্তু লকডাউনের সাথে সাথেই গার্মেন্টস শিল্পে যে অরাজকতা আমরা দেখি তা অনেকের কাছেই ছিলো বিস্ময়কর। আর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয় পে আপ।
করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা জোরদার করবার জন্য বিভিন্ন বিদেশী ব্র্যাণ্ড তাদের রিটেইলার দোকানগুলো বন্ধ করে দেয়। আর যেহেতু কেনাবেচার ব্যাপারটা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ, সেই হিসেবে নতুন প্রোডাক্ট এর অর্ডার না দেওয়া স্বাভাবিক মনে হতে পারে, বিশ্বের কাছে অনেকটা এভাবেই নিজেদের পদক্ষেপ তুলে ধরতে চেয়েছিল ব্র্যাণ্ডগুলি।
কিন্তু সমস্যা হলো নতুন অর্ডার না দেওয়া আর প্রোডাক্ট এর অর্ডার ক্যান্সেল করা এক জিনিস নয়। দেখা গেল, অধিকাংশ ব্র্যাণ্ডগুলিই তাদের পূর্বে অর্ডার দেওয়া পণ্য যার অনেকগুলোই পুরোপুরি তৈরি এবং শিপমেন্ট হয়ে গিয়েছে, নিতে চাচ্ছে না।
এর ফলে রেডিমেড গার্মেন্টস ইণ্ডাষ্ট্রিতে চায়নার পর শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ একাই প্রায় ৩.৭ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে। এছাড়া পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইথিওপিয়া, ক্যাম্বোডিয়া, মায়ানমারসহ সারা বিশ্বে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে।
প্রায় ১৩৮০ ছোট-বড় ব্র্যাণ্ড যারা এদেশে নানামূল্যের অর্ডার দিয়েছিল তারা হুট করেই অর্ডার ক্যান্সেল করেছে। বিজিএমইএ এর হিসাব মতে, প্রোডাক্ট ক্যান্সেল করা ব্র্যাণ্ডের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে প্রাইমার্ক, যারা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য ক্যান্সেল করেছে। তারা এখনো কোন সাপ্লায়ারের সাথে টাকার হিসাব চুকায়নি, অদূর ভবিষ্যতে এর সুরাহা হবে কিনা ঠিক মতোন বলা যাচ্ছে না। H&M বাতিল করেছে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফ্রেঞ্চ ব্র্যাণ্ড ‘লা হলে’ ১৪ জন সাপ্লায়ারের কাছ থেকে প্রায় ৮ মিলিয়ন ডলার সমমানের পণ্যের অর্ডার বাতিল করেছে। এমনকি তারা তাদের এশিয়া ব্রাঞ্চের অফিসও হুট করে বন্ধ করে দিয়েছে। ধারণা করা যাচ্ছে ব্রাণ্ডটি দেউলিয়া হতে চলেছে। এরকম আরো কিছু ব্রান্ডের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে তাও স্পষ্ট নয়।
ফাস্ট ফ্যাশন বলতে একটি নতুন ট্রেণ্ড চালু হয়েছে ফ্যাশন ইণ্ডাষ্ট্রি তে, যেখানে বিভিন্ন সময়ে তারকাদের পরিহিত কাপড় বা এর স্টাইলকে নকল করে তুলনামূলক কম দামে পোশাক বিক্রি করা হয়। এর ফলে একই পোশাকের বাজার বেশিদিন থাকে না। বাংলাদেশের অনেক ফ্যাক্টরিতেই যেহেতু এরকম পোশাক তৈরি হয় তাই ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া কাপড়গুলো যা ব্র্যাণ্ডগুলো নিতে চাইছে না তা পরবর্তী মৌসুমে কেউ কিনতে চাইবে না, এগুলো হয়ে পড়বে অব্যবহারযোগ্য। ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ড ছাড়াও সব মৌসুমে সমান ব্যবসা করা ব্র্যাণ্ডগুলি (যেমন: Levi’s) পণ্য নেবার ক্ষেত্রে বিশাল ছাড় চেয়েছে, অনেকে পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত এই কাপড়গুলো সংরক্ষণ করতে বলেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ফ্যাক্টরি এর উপযোগী না হওয়ায় কাপড়ের মান পড়ে যেতে বাধ্য, যার ফলে তারা পরবর্তীতে বিশাল মূল্যছাড় আদায় করতে পারবে। আবার অনেকে রিটেইলার শপে সব পণ্য বিক্রি হয়ে যাবার পর টাকা দেবার কথা বলেছে, যেক্ষেত্রে সময় লাগতে পারে চার থেকে ছয় মাস।
যেই ব্যাপারটা তারা বুঝতে চাইছে না তা হলো, এই কোভিড-১৯ এর ফলে এদেশীয় শিল্পখাত এতোটাই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে যে মাত্র ৩০ দিনের ব্যবধানেই এক বিশালসংখ্যক গোষ্ঠীর মানুষ আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় নেমে আসবে। তাদের সন্তানেরা অনাহারে থাকবে এবং বাড়িভাড়া না মেটানোর কারণে মাথার ওপর কোন ছাদও থাকবে না।
ব্র্যাণ্ডগুলো দাম দেবার ক্ষেত্রে গড়িমসি দেখালেও ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিগুলো যাদের কাছ থেকে কাঁচামাল নেয় তাদের সাথে সাথেই পেমেন্ট করতে হওয়ায় মুনাফার বদলে বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ছে এদেশীয় কোম্পানিগুলো। ব্র্যাণ্ডগুলো এক মাস পরে টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রেও শিল্পখাতে যে বিশাল ক্ষতি হবে তা সামাল দিতে আঠারো মাসের চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশে আরএমজি খাত ধসে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
বর্তমানে গ্লোবাল ফ্যাশন ইণ্ডাষ্ট্রি এর মূল্য ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রতিবছর মিলিয়ন ডলারের অর্ডার করা পণ্য থেকে ব্র্যাণ্ডগুলোর মুনাফা হয় কয়েক বিলিয়ন ডলার, এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার প্রভাব কমে যাওয়ায় খুলতে শুরু করেছে বিভিন্ন রিটেইলার স্টোর, এর ফলে কাপড় চোপড়ের কেনাকাটায় একদম প্রথম দিকের অচলাবস্থা আর নেই, একইসাথে বাইরে গিয়ে কেনাকাটা না করলেও এইসব ব্র্যাণ্ডের অনলাইনে কেনাকাটা করার হার আগের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে, তাই আর্থিক অচলাবস্থার যেই কারণ বিভিন্ন বিদেশী ব্র্যাণ্ডগুলি দেখাচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিক শ্রেণির সাময়িক ছুটি ও নির্দিষ্ট ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতোন দেশের পক্ষে সর্বস্তরে, সুষ্ঠুভাবে তা করা সম্ভব না। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক তাদের চাকুরি হারিয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে কয়েক মাসের মধ্যে এই সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির হিসাবে সারাবিশ্বে এ সংখ্যা হতে পারে প্রায় ৫০ মিলিয়ন। এর ফলে শ্রমশক্তিতে যে ক্ষতি দেখা দেবে তা নিষ্পন্ন করতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজনও হতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে সবাই চুপ, তাই অনেকেই বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোকে একটি বিশাল অপরাধের শিকার বলে মনে করছেন।
প্রশ্ন তোলা হয়েছে ব্র্যাণ্ডগুলোর বিজনেস ইথিকস নিয়ে।
এতোকিছু হবার পরেও অধিকাংশ উৎপাদন কোম্পানি চুপ থাকবার পিছনে একটি কারণ হলো ব্র্যাণ্ডগুলোর সাথে এদেশীয় কোম্পানির কনট্রাক্ট। এই চুক্তিগুলোতে সাধারণত সকল ক্ষমতা ব্র্যাণ্ডগুলোরই থাকে। গার্মেন্টস শিল্পে এখনো অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, তাই কোন অন্যায়ের ক্ষেত্রে উৎপাদন কোম্পানি যদি সোচ্চার হয় তবে তার সাথে আর কোন ব্র্যাণ্ড কাজ করতে চায়না, দেউলিয়া হবার সম্ভাবনা থেকে যাওয়ায় ব্র্যাণ্ডগুলোর অনাচার মেনে নেওয়ার একটি অসুস্থ প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তাই এই মহামারীর সময়েও যখন তারা টাকা দেবার ক্ষেত্রে গড়িমসি দেখাচ্ছে তখন তাদেরকে অর্থের জন্য বারবার অনুরোধ করলেও সরাসরি ব্র্যাণ্ড এর কুকীর্তি এর হিসাব ফাঁস করবার কথা বললে অনেকেই রয়ে যাচ্ছেন নিশ্চুপ।
২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন ও ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ধসের ঘটনায় প্রথম শুরু হয় পে আপ ক্যাম্পেইন। ব্র্যান্ডগুলোর পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য যাতে শ্রমিকদের কাজের জায়গা সুরক্ষিত হয় এবং সাসটেইনেবল ফ্যাশন ইণ্ডাষ্ট্রি তৈরি হয়, এটাই এই ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য। সময়ের সাথে এটি স্তিমিত হয়ে পড়ে।
বর্তমান সময়কে মাথায় রেখে বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডগুলোর কুকীর্তি জানাতে ও টাকা পরিশোধের চাপ প্রয়োগ করবার জন্য বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপোর্ট লিমিটেড এর মালিক মফিজ উদ্দীন, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি এর প্রতিষ্ঠাতা কল্পনা চাকমা এবং মার্কিন এনজিও রিমেক মিলে নতুন করে নিয়েছে #payup এর উদ্যোগ; এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে যাতে মানুষ এই ব্যাপারে একাত্বতা পোষণ করতে পারে। মার্চ মাসে শুরু হওয়া পে আপ আন্দোলনের পাশাপাশি ওয়ার্কার রাইটস কন্সোর্টিয়াম (WRC) ব্র্যাণ্ড ট্র্যাকার এর জন্য আলাদা ওয়েবপেইজ খোলে যেখানে কোন কোন ব্র্যান্ড পে করতে রাজি হয়েছে/হয়নি তার বিস্তারিত লিস্ট প্রকাশিত হয়।
এতে কাজ হয় নিঃসন্দেহে। এখন পর্যন্ত পে আপ নিয়ে হাজারের ওপরে পোস্ট করা হয়েছে এবং এসব পোস্ট শেয়ার দেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার বার। একইসাথে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান ইউটিউবার নাবেলা নুর যখন তার বিশাল ফ্যানবেইজের কাছে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ব্যাপারের সমস্যাগুলো তুলে ধরেন এবং অন্যদের এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে নানা পোস্টে বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডকে মেনশন করতে বলেন তখন এর গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়।
এর ফলে ইন্সটাগ্রাম, টুইটারসহ নানা সোশাল মিডিয়ায় কাইলি জেনার, কার্ডি বি, পি ড্যাডির মতোন সেলিব্রেটি যারা এসব ব্র্যাণ্ডের সাথে কাজ করেছেন তাদেরকে #payup ব্যবহার করে নানাভাবে টাকা প্রদানের জন্য চাপ দেওয়া হয়। তাদের পোস্ট বা ছবির কমেন্টে গিয়ে নানা দেশের মানুষ তাদের টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিতে থাকেন। পাবলিক স্টেটমেন্ট দেবার বদলে কমেন্ট বক্স বন্ধ করে দেন তারা। কাইলি ও কেন্ডাল জেনারের কোম্পানি থেকে অফিসিয়াল স্টেটমেন্ট দেওয়া হয় যে তারা বাংলাদেশে কাজ করে এমন ব্র্যাণ্ডের সাথে পূর্বে কাজ করলেও এখন করছেন না; যদিও এর সত্যতা পুরোপুরি প্রমাণ হয়নি। বাকিরা এখনো কোন তথ্য দেননি। এর ফলে তাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
এর পাশাপাশি ফ্যাশন ইণ্ডাস্ট্রি নিয়ে কাজ করা নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন রিমেক এপ্রিলের ৪ তারিখ #payuppetition নামে একটি পিটিশন চালু করে যা একইসাথে ব্র্যাণ্ডগুলোকে পে করবার জন্য চাপ দেয় এবং টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত এই ব্র্যাণ্ডগুলোকে বাতিল করবার কথা জানায়। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ সত্তর হাজার মানুষ এই পিটিশনে সাইন করেছেন।
পে আপ কাজ করেছেও চমৎকারভাবে। WRC এর হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি অর্ডার ক্যান্সেল করা ৫০ টি ব্র্যাণ্ডের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১০টি তাদের অর্ডার এর টাকা পুরোপুরি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল। এর মধ্যে রয়েছে H&M, Ralph Lauren, Mark Spencer, kiabi ইত্যাদি। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক এর তথ্যনুযায়ী, মে এর ২০ তারিখ পর্যন্ত কোম্পানিগুলো ৫৮ শতাংশ তাদের ক্যান্সেল হওয়া অর্ডারের ৫৮ শতাংশ নিতে রাজি হয়েছিল। এখন পর্যন্ত পে আপ এর চাপে পড়ে প্রায় ১৯টি বৈশ্বিক ব্র্যাণ্ড তাদের টাকাপয়সার হিসাব পুরোপুরি চুকিয়ে দিতে রাজি হয়েছে, যারমধ্যে levi, nike, adidas, UNIQLO ও রয়েছে। এরফলে বিশ্বব্যাপী ২২ বিলিয়ন ডলার উন্মুক্ত হবে, যার মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ১ বিলিয়ন। তবে অনেক কোম্পানিই ঠিক কবে এই হিসাব চুকাবে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন সময় দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে টাকা পরিশোধের আগ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। একইসাথে শ্রমিকদের জন্য ব্র্যাণ্ডের তরফ থেকে ইমার্জেন্সী ফাণ্ড গঠনের কথাও বলা হচ্ছে, যাতে এরুপ সমস্যা আর না হয়।
payup ব্যবহৃত হয়েছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। গিগ ইকোনমি এর ওয়ার্কফোর্সে ফ্রিল্যান্সারদের সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়েছে এই হ্যাশট্যাগ। uproar, instacart এর মতোন কোম্পানি তাদের বিতর্কিত টিপিং পলিসি এর জন্য প্রচুর সমালোচনার মুখে পড়ে, তাদের কর্মীরা ফেসবুক ও রেডিট এ নানা গ্রুপের মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এর ফলে এই কোম্পানির ক্রেতারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। চাপের মুখে পড়ে দুই সপ্তাহের মাঝে টিপিং পলিসি তুলে নতুন বেতন কাঠামো তৈরি করতে হয় কোম্পানিকে। Uber, Lyft, Postmate এর মতোন কোম্পানিকেও পিছু হটতে হয়।
এর আগেও ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার, মি টু প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নানা আন্দোলন বিশ্ববাসী দেখেছে। সোশাল একটিভিজম এর ফলে মানুষ যেকোন অন্যায় সম্পর্কে জানতে ও প্রতিবাদ করতে পারছে দ্রুত, কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। ২০১৮ সালের শেষ দিকে হঠাৎ ইউটিউব চ্যানেল এআইবি এর উৎসব চক্রবর্তীর নামে অনলাইনে হ্যারাজমেন্টের অভিযোগ আসে। এই ঘটনার পরপরই ভারতে জোরদার হয় মি টু আন্দোলন। অভিযুক্ত উৎসবের ক্যারিয়ার শেষ হয় সেখানেই, অপরদিকে মাহিমা কুকরেজা রাতারাতি হয়ে যান সেলিব্রেটি। এর পর শোনা যায়, মাহিমা কুকরেজার শেয়ার করা স্ক্রিনশটের অনেকগুলিই বানানো, এছাড়া আসল তথ্য ফাঁস না করার জন্য মাহিমার তরফ থেকে উৎসবকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও জানা যায়। এছাড়া তাদের এই অভিযোগের ঘটনাটি পুরোটাই হয় ‘অনলাইন কোর্ট’ টুইটারে। পরবর্তীতে ভারতের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, #মিটু আন্দোলনের সময়ে পুরুষ কর্তৃক নির্যাতন বা হ্যারাজমেন্টের নামে দাখিল হওয়া কেসের মধ্যে ৮৯% ই ছিলো মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে। এর ফলে যেই ব্যাপারটি ঘটে তা হচ্ছে, সেক্সুয়াল এলিগেশন এর সম্ভাবনা আসতে পারে ভেবে চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের নিয়োগের সংখ্যা উল্লেখজনক ভাবে কমে; আবার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করলে দেখতে পাওয়া যায়, এই ব্যাপারে আলোচনার সংখ্যা খুব উল্লেখজনক নয়। ফেমিনিজম এর মূল ধারণা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে, অনেকে একে ভণ্ডামি বলে আখ্যা দেন। আবার হালে নতুন করে আলোচনায় আসা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মুভমেন্ট এর ক্ষেত্রেও একে খারাপভাবে কাজে লাগিয়ে লুটপাট, ভাংচুর করবার নানা দৃশ্য আমাদের সামনে এসেছে।
নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সবযুগে, সবসময়ই থাকবে। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিমাণ একটি বড় দিক, অর্থাৎ অনলাইন আন্দোলন এর হ্যাশট্যাগ আমাদের বাস্তবজীবনে কতোটা ভূমিকা রাখছে। এই হিসাবটা ভৌগোলিক পরিবেশভেদে ভিন্ন। তাই ইউরোপীয় ও পশ্চিমা বিশ্বে এইসব আন্দোলন খুব চটকদার মনে হলেও আমাদের এই ভূখণ্ডে, যেখানে এখনো একটি বিরাট অংশ ইন্টারনেট ব্যবস্থাই হাতে পায়নি বা পেলেও মূল জনগোষ্ঠী অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন না; অনলাইন আন্দোলনের মাধ্যমে বিরাট কিছু পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখাটা এখনি উচিত কিনা তা ভাবার বিষয়।
payup আন্দোলনের ফলে বিশ্বজুড়ে ফ্যাশন ইণ্ডাষ্ট্রি এর দাপুটে ব্র্যাণ্ডগুলোর অরাজকতা সম্পর্কে জানতে ও সচেতন হতে পেরেছে সবাই। এটা অবশ্যই ভালো কিন্তু অনেকেই এই আন্দোলনকে শ্রমিকের আন্দোলন না বলে মালিকের সাথে মালিকের লড়াই বলতেই বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ছিলো ৬৩০ টাকা, গত চার দশকে এই বেতন বেড়ে দাড়িয়েছে মাত্র ৮০০০ টাকা (৯৬ ডলার)। একজন গার্মেন্টস শ্রমিক সারামাসে যেই কয়েকশ পোশাক উৎপাদন করেন তার প্রত্যেকটির দামই ৫০ ডলার থেকে শুরু করে ২০০ ডলার। এই পোশাক থেকে মিলিয়ন ডলার উপার্জন করে মালিকেরা, যা আবার বিভিন্ন ব্র্যাণ্ড কিনে নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। বছরের পর বছর ধরে মিলিয়ন ডলারের মুনাফা উপার্জন করা গার্মেন্টস শিল্পের মালিকেরা তাই কয়েকদিনের ব্যবধানেই দেউলিয়া হয়ে যাবেন এটা বিশ্বাসযোগ্য না। এরপরেও বাংলাদেশ সরকার এই খাতের কর্মীদের বেতন দেবার জন্য প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার সমমূল্যের প্রণোদনা ঘোষণা করে। এরপরেও এই মহামারীর মধ্যে সামাজিক দূরত্ব না মেনেই শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে একপ্রকার বাধ্যই করে মালিকপক্ষ, আসতে অপারগ ব্যক্তিদের করা হয় বরখাস্ত। ঈদের সময় এসব শ্রমিকদের বাড়ি ফেরা নিয়ে প্রহসন আমরা দেখেছি। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এতোকিছুর পরেও অনেক গার্মেন্টসে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়নি। অনেকের বেতন থেকে নির্দিষ্ট অঙ্ক কেটে রাখা হয়েছে। বেতন বকেয়া রেখে কারখানা বন্ধও করে দিয়েছেন কেউ কেউ। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তথ্য দেয়নি অনেকেই। কোভিড-১৯ এর কারণে শ্রমিকেরা এক হয়ে আন্দোলন ও করতে পারছেন না। অনাহারে আছে কয়েকশ মানুষ, গ্রামে চলে যেতে হচ্ছে অনেককে। শ্রম আইনের বাতিলের কথাও বলছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশে আরএমজি সেক্টরে শ্রমিকদের আন্দোলন নতুন নয়। বিভিন্ন সময়ে আমরা তাদের মাঠে নামতে দেখেছি। তাদের নিয়ে মালিকপক্ষের প্রহসনও নতুন নয়। বিদেশি ব্র্যাণ্ডদের এই চৌর্যবৃত্তি অবশ্যই তিরষ্কার করা উচিত, কিন্তু আন্দোলনের এজেন্ডা হিসেবে দেখানো হয়েছে যেই শ্রমিকদের, পে আপ এর মাধ্যমে তারা আদৌ লাভবান হবেন কিনা এই প্রশ্ন থেকেই যায়।
ধারণা করা যাচ্ছে দেশীয় বাজারে এই অর্থমূল্য না চুকানোর ফলে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, তা ২০২১ স্থিতিশীল হওয়া সম্ভব না (যদি পরিস্থিতি অনুকূলে আসে)। কিন্তু পে আপ এর কারণে ব্র্যাণ্ডগুলো পূর্বের মতোন বাংলাদেশে অর্ডার করবে কিনা সেই প্রশ্ন আর অনিশ্চয়তাও থেকে যায়। সত্যিকার অর্থে আমাদের শিল্পখাতের অবকাঠামোর কিছু দিক পরিবর্তনও জরুরী, যার জন্য প্রয়োজন সরকারী হস্তক্ষেপ। শ্রমিক আইন সংরক্ষণের জন্য আইনজীবী নিয়োগ, বিজিএমইএ কে পুনর্গঠন করা, শ্রমিক আইন শক্তিশালী করা এবং বিদেশী ব্র্যাণ্ডগুলোর সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে আরো স্বাধীনতার দাবি’র মতোন নানা সময়সাপেক্ষ ও দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে পারলেই আমাদের শিল্পখাত ও এর সাথে জড়িত মানুষদের জীবন নিরাপদ হবে।
পারফর্মেটিভ একটিভিজম বলে একটি কথা রয়েছে; যেখানে সোশাল মিডিয়ায় মানুষ কোন একটি নিদির্ষ্ট বিষয়ে আন্দোলন ট্রেণ্ডিং থাকলে শুধু নিজেদের ফেস ভ্যালু বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তাকে সমর্থন করে থাকেন। এই ব্যাপারটাকে ভণ্ডামির চূড়ান্তও বলেছেন কেউ কেউ। হালের বিএলএম আন্দোলনে কাইলি জেনার বা কার্ডি বি’র জনসচেতনতামূলক অনেক পোস্ট আমরা দেখতে পেয়েছি অনলাইনে। আবার বিভিন্ন ব্র্যাণ্ড বিএলএম আন্দোলনের সাথে একাত্বতা পোষণ করে বিভিন্ন অনুদান দিয়েছে। পরবর্তীতে ঘাটাঘাটি করে দেখা যায় এসব তারকা ও ব্র্যাণ্ডগুলিই তাদের কর্মীদের ন্যায্য পাওনা মিটাননি। যেহেতু ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যে রেসিজম কে দমন করা তাই অনেকের মতে, নিজেদের অধস্তন ব্রাউন বা ব্ল্যাক কর্মীদের টাকা না দিয়ে পরোক্ষভাবে রেসিজমকে উসকে দেবার কাজই করেছেন তারা। পে আপ এর ফলে বিশ্বের মানুষের কাছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুর্দশা প্রকাশিত হয়েছে। চাপের মুখ পড়ে অনেক ব্র্যাণ্ড হিসাব চুকাতে চেয়েছে, এটা অবশ্যই সুখের কথা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। যাদের জন্য এই আন্দোলন, যাদের পরিশ্রমেই ঘুরছে এদেশের অর্থনীতির চাকা; সেইসব গার্মেন্টস কর্মীরা আসলেও তাদের ন্যায্য পাওনা ঠিকমতো পাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে। আর যেহেতু বিষয়টি ঘটছে আমাদের দেশে, তাই এ ব্যাপারেও অগ্রবর্তী হতে হবে আমাদেরকেই। #payup বাংলাদেশেও ট্রেণ্ডিং হয়েছে, অনেক মানুষ কথা বলেছে এ ব্যাপারে। কিন্তু যদি মনে করেন এখানেই দায়িত্ব শেষ, তাহলে এতোদিন ধরে নানাভাবে যাদের সোশাল মিডিয়ায় গালাগাল করে চলেছি হিপোক্রিসির জন্য, সেই একই পারফর্মেটিভ একটিভিজম এর জন্য আমরাই হয়ে উঠবো তাদের সমগোত্রীয়!
Feature Image Courtesy: Instagram, Remake