প্লাসিবো ইফেক্ট

খুব অপিরিচিত এক মহামারী, কোভিড-১৯, এই কয়দিনে বেশ কিছু শব্দ আর পরিস্থিতির সাথে বেশ ভালোভাবেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন – এ শব্দ আর পরিস্থিতিগুলো আগে দূরের মনে হলেও মহামারী সে দূরত্ব ঘুচিয়ে বেশ কাছাকাছি এনে দিয়েছে। মেডিসিন আর মেডিকেল সেক্টরেও বেশ আলো ফেলেছে পুরোটা সময় জুড়েই। এরই সুবাদে ওষুধবিজ্ঞানের বিভিন্ন অপরিচিত শব্দকে সাধারণের কাছে নিয়ে এসেছে খুব অল্প সময়ে। আজ তেমনই এক পরিচিত-অপরিচিত শব্দ ‘প্লাসিবো’ নিয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক।

প্লাসিবো কী?

সংজ্ঞার হিসেবে বলা যায়, প্লাসিবো এক ধরণের ওষুধ যার সরাসরি শরীরবৃত্তীয় চিকিৎসাগত কোনো ভূমিকা নেই। প্লাসিবোর এই সংজ্ঞাটি ওষুধের সংজ্ঞার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়, কারণ ওষুধের প্রভাবে অবশ্যই শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তন লক্ষণীয়। প্লাসিবোর রহস্য শুধু এটুকুই, রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় থেকেও অনেক সময় প্লাসিবো ওষুধের ভূমিকা পালন করে অসুখ সারিয়ে ফেলে! আরো সহজভাবে বোঝানো যাক, ধরুন আপনি ক্রিকেট খেলার সময় পায়ে খানিকটা ব্যথা পেলেন, আশেপাশে কোনো ফার্মেসিও নেই যে আপনার জন্য ব্যথার ওষুধ আনা যাবে। এমন সময় কেউ একজন একটি ব্যথার ওষুধ নিয়ে আসলো। আদতে তা কোনো ওষুধই ছিলো না, কিন্তু আপনি তা জানতেন না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেই নকল ওষুধ খেয়েই আপনার ব্যথা সেরে গেল। হ্যা, এই নকল ওষুধই প্লাসিবো। আশ্চর্য হওয়ার মতোই ব্যাপার, এমনি কেন হচ্ছে? এই প্রশ্নে একটু পরে আসছি। প্লাসিবো (Placebo) শব্দটি ল্যাটিন শব্দ থেকে আগত যার অর্থ করলে হয় I shall be pleasing।  আমাদের শরীরে প্লাসিবোর প্রভাব আর ফলাফলের জন্যই ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’ শব্দ যুগল বেশ পরিচিত।

Image Courtesy: zmescience.com
Image Courtesy: zmescience.com

প্লাসিবোর শুরুটা

প্লাসিবো শব্দটি সাইকিয়াট্রির সাথে বেশি জড়িত। যদিও বর্তমানে ড্রাগ ডিস্কভারির ট্রায়ালে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে প্লাসিবো ইফেক্ট। ধারণা করা হয় বেশ প্রাচীন সভ্যতা থেকেই মানুষ প্লাসিবোর ফলাফলের সুবিধা পেয়ে আসছে। তবে ব্রিটিশ ফিজিশিয়ান জন হ্যাগ্রিথ ১৭৯৯ সালে সরাসরি এর প্রভাবে লক্ষ করেন। পারকিন্স ট্রাক্টর নামে ওই সময়ে প্রচলিত একটি চিকিৎসা পদ্ধতিতে ধাতব রডের পরিবর্তে নকল কাঠের রড ব্যবহার করে দেখেন রোগীদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের রোগের প্রতিকার হয়েছে। পরবর্তীতে ফ্রেঞ্চ ফার্মাসিস্ট এমিল কুয়েই, রিচার্ড ক্যাবোটসহ অনেকেই এর কার্যকরিতা গবেষণা করেছেন তবে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।

Image Courtesy: thelills.com

১৯২০ সালে ‘The Lanchet’য়ে ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’কে প্রথমবারের মতো সংজ্ঞায়িত করা হয়। এর পরবর্তী দশকগুলোতেই মূলত প্লাসিবোর মূল গবেষণাগুলো শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে সাইকিয়াট্রিক ড্রাগের ট্রায়ালের পরিমাণ বেশি থাকলেও পরবর্তীতে গবেষণার ঊর্ধ্বগতির জন্য ড্রাগ ডিস্কভারির অন্যতম ধাপ হয়ে দাঁড়ায় প্লাসিবো। ১৯২২ সালের ‘নিকোলাস কোপেলফ-ক্লারেন্স ও চেনি’র গবেষণা, ১৯৩৩ এ উইলিয়াম ইভান্স-ক্লিফোর্ড হয়েলের পরীক্ষা, পরবর্তীতে হ্যারি গোল্ড এবং আরো দুই রিসার্চারের ২০৯ টি চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর গবেষণায় প্লাসিবোর ব্যাপকতা সম্প্রসারিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে প্লাসিবো পরীক্ষীতভাবে সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসায় ঢুকে পরে। এর পর পরই প্রচলিত ওষুধের জগতে ঢুকে পরে প্লাসিবো টেস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান এ্যানেস্থিয়োলজিস্ট হেনরি বিচার লক্ষ করেন যে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের অনেকেই মরফিন ব্যবহার ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠছে।

Image Courtesy: likeironstrong.com
Image Courtesy: likeironstrong.com

পরবর্তীতে হেনরি বিচারের গবেষণার সাথে সাথে প্লাসিবো ব্লাইন্ড ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রবেশ করে। এখনও যে কোনো ওষুধ আবিষ্কারের অন্যতম একটি ধাপ হলো এই ‘প্লাসিবো কন্ট্রোলড স্টাডিজ’। এই ধাপে রোগীদের মধ্যে একটি অংশকে দেয়া হয় আবিষ্কৃত ওষুধ এবং অন্যদের দেয়া হয় শরীরের জন্য নিরপেক্ষ কোনো মিথ্যা ওষুধ। অবশ্যই রোগীদের এভাবে বাছাই সম্পূর্ণ এলোমেলোভাবে করা হয়ে থাকে এবং রোগীদের জানতে দেয়া হয় না, কে কোন ওষুধ পাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় প্লাসিবো ওষুধ ব্যবহার করা রোগীরা রোগমুক্ত হয়ে যাচ্ছে। যদি প্লাসিবো ওষুধ এবং আবিষ্কৃত ওষুধের সক্ষমতার হারে একটি নির্ধারিত ব্যবধান থাকে তবে ওষুধটি পরবর্তী ধাপ বা ট্রায়ালে নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।

Image Courtesy: marksdailyapple.com

যাপিত জীবনে প্লাসিবো

প্লাসিবোর সম্পূর্ণ ব্যাপারটি বাইরে থেকে কাটখোট্টা মনে হলেও এর মজার মজার বেশ কিছু দিক রয়েছে। হ্যা, প্লাসিবো এবং প্লাসিবো ইফেক্ট মানুষের মনস্তত্ত্বকে ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। স্পষ্টতই ওষুধের গুনাগুণ না থাকা স্বত্তেও কোনো ব্যাথা সম্পূর্ণ নিরাময় হলে, জিনিসটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়েই গড়ায়। প্লাসিবোর এই ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রচলিত ওষুধের গুণাগুণ বৃদ্ধি করা যায় অনেক গুণে। একটি সাধারণ ওষুধের সিরাপ যে পরিমাণ কার্যকরী, এর চেয়ে বেশি কার্যকারিতা দেখায় ওই একই মাত্রার ওই ওষুধের ট্যাবলেট। আবার ট্যাবলেটের চেয়ে বেশি ক্যাপস্যুল, এখানেও আবার সাধারণ ক্যাপস্যুলের চেয়ে রঙিন ক্যাপস্যুল বেশি কার্যকরী। এর চেয়েও আবার একই ওষুধের ইনজেকশন ফর্ম আরো বেশি কার্যকরী। হ্যা, শরীরকে এভাবে প্রভাবিত করতে পারে ওষুধের এই ধরন কিংবা ‘কতিপয় নকল ওষুধ’। অবশ্যই প্লাসিবো হতে হলে ওষুধকে এমন কিছু উপাদানের তৈরি হতে হবে যা শরীরে অন্য কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে। প্লাসিবো ড্রাগ প্রায়শই প্রেস্ক্রাইবড করা হয়ে থাকে।

Image Courtesy: theconversation.com

সাধারণত ব্যথা, দুশ্চিন্তা, স্লিপিং ডিসঅর্ডার এসবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাসিবোর সফলতা দেখা যায়। এছাড়া রোগীকে আশ্বস্ত করার জন্য অনেক সময় এমন কিছু ওষুধ দেয়া হয়, সরাসরি যার কোনো ওষোধি গুণাগুণ নেই, কিন্তু তা রোগীর মনোবলকে দৃঢ় করে। ব্যাথা নিরাময়ে সাধারণ প্লাসিবো মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তিকে কাজে লাগায়। প্লাসিবো গ্রহণের পর পূর্বে নিরাময় হওয়া ব্যাথার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় উপদান তৈরির নির্দেশনা পাঠায় শরীরকে। রোগীকে প্লাসিবো প্রেস্ক্রাইব করার জন্য আগে বিভিন্ন দেশে ডাক্তাররা প্রেস্ক্রিপশনে Placebo-কে উলটো করে Obecalp লিখে দিতো। আচ্ছা, কখনো কি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সাথেসাথে সুস্থ সুস্থ অনুভব হয়েছে? এটিও কিন্তু প্লাসিবো ইফেক্টের একটি ধরন!

Image Courtesy: thesensitivegut.files.wordpress.com

এতক্ষণ মনস্তত্ত্বের এই ইতিবাচক দিকটি নিয়েই কথা বললাম, হ্যা, একই জিনিসের কিন্তু নেতিবাচক দিকটিও দেখা যায়। এরজন্য আলাদা একটি শব্দও আছে, নোসিবো (Nocebo)। প্লাসিবোর মতো এরও কার্যপদ্ধতি মনস্তত্ত্ব ভিত্তিক। প্লাসিবোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক চিন্তা যেভাবে নিরাময়কে তরান্বিত করে, নোসিবোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভঙ্গি কোনো অবস্থাকে আরো খারাপ করে তোলে। ভুডুসহ অন্যান্য অনেক ডার্ক ম্যাজিকের কারণ হিসেবে অনেকেই এই নোসিবো ইফেক্টের কথা বলে থাকেন। ওষুধবিজ্ঞান আর মনস্তত্ত্বের জগতেও নোসিবো শব্দটি বেশ পরিচিত।

নিউরোসায়েন্সের অন্যান্য গবেষণার সাথে সাথে সমানভাবেই চলছে এইসব প্লাসিবো ইফেক্টের কারণ বিশ্লেষণের গবেষণা। তবে প্লাসিবো বা নোসিবো যেটিই হোক বোঝা যাচ্ছে অনেক সময়ই মেকি ওষুধ দিয়ে খুব সহজেই বোকা বানানো যায় আমাদের মস্তিষ্ককে!

Image Courtesy: lostempireherbs.com

প্লাসিবো ইফেক্টের এই বাস্তব ফলাফল কিন্তু আবার বিবর্তনের বিতর্কের আগুনে আরেকটু ঘি দেয়ার মতোই কিছু তথ্যের ইঙ্গিত দেয়। ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’য়ের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে ‘If you want to heal, you will heal’ নীতিতে প্লাসিবো কাজ করে থাকে। কিছু জিনগত ব্যাখ্যাও আছে এর পেছনে। সে যাইহোক, আজ বির্তকগুলো না হোক বাদই দিলাম। অন্য কোনো দিন?

Feature Image Courtesy: gaia.com

Reference:

  • Canadian Journal of Psychiatry