১৯০১ সালে একজন রসায়নবিদের গবেষণাগার কে কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়, যেটি এই উপমহাদেশের সর্বপ্রথম কেমিক্যাল কারখানা। নাম বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড। আর সেই অসাধারণ রসায়নবিদের নাম হলো পি সি চন্দ্র রায় অর্থাৎ স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বাংলাদেশের খুলনা জেলায় পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলি গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ রা আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হরিশ্চন্দ্র রায় এবং মাতার নাম ভুবন মহিণী দেবী। তার পিতা ছিলেন স্থানীয় জমিদার। এ রকম বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করার জন্যে তিনি ছোটবেলা থেকেই অনেক বেশি চঞ্চল ও কৌতূহলোদ্দীপক ছিলেন।
শিক্ষাজীবন
তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় তার বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। পরে তিনি ১৮৭২ সালে কোলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু রক্ত আমাশয়ের কারণে সেখানে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেন নি। তিনি তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। এই সময়েই তার মধ্যে একধরণের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। তিনি তার বাবার গ্রন্থাগারে প্রচুর বই এর সংস্পর্শে আসেন। এরপর তিনি ১৮৭৪ সালে কোলকাতায় ফিরে আলবার্ট স্কুলে ভর্তি হন।

আলবার্ট স্কুলে থেকে ১৯৭৮ সালে ১ম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি ম্যাট্রোপলিটন কলেজ হতে এফ এ পরীক্ষায় ২য় বিভাগে পাশ করেন এবং এর পরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বি এ ক্লাসে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে গ্রিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যান। এখান থেকেই তিনি বি এস সি পাশ করেন। পরবর্তীকালে এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়েই ডি এসসি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন।
তার সেই গবেষণার বিষয় ছিল কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ (Conjugated Sulphates of Copper Magnesium Group: A Study of Isomorphous Mixtures and Molecular Combination)। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পিএইচ ডি ও ডি এসসি ডিগ্রী লাভ করেন। এমনকি তার এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে হোপ প্রাইজে ভূষিত করা হয়। এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে (India Before and After the Sepoy Mutiny) এবং ভারত বিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ড ও এউ এস এ ফেরে দেন।

কর্মজীবন
১৮৮৮ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এখানে তিনি ২৪ বছর অধ্যাপনা করেছেন। এই সময়েই তিনি রসায়নের উপর গবেষণা শুরু করেন। এইসময়েই তৈরি করেন নিজস্ব গবেষণাগার। যা পরবর্তীতে বেঙ্গল ফার্মাসিকিউটিক্যাল লিমিটেড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

অবদান
• নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি তার গবেষণাকর্ম আরম্ভ করেন। তার এই গবেষণাস্থল থেকেই পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার সৃষ্টি হয় যা ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
• ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।
• সমবায়ের পুরোধা স্যার পিসি রায় ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে নিজ জন্মভূমিতে একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী পি সি রায় পিতার নামে আর. কে. বি. কে. হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
• বাগেরহাট জেলায় ১৯১৮ সালে তিনি পি. সি. কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে বিশাল ভূমিকা রাখছে।

সন্মাননা
• শিক্ষকতার জন্য তিনি সাধারণ্যে ‘আচার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত।
• সি আই ই: ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তৃতীয়বারের মত তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সি আই ই লাভ করেন।
• সম্মানসূচক ডক্টরেট: ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এই ডিগ্রী দেয়। এছাড়া ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহীশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডক্টরেট পান।
• নাইট: ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত নাইট উপাধি লাভ করেন ।

পি সি রায়ের রচিত গ্রন্থাবলী
• India Before and After the Sepoy Mutiny. (ভারত: সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে)
• সরল প্রাণীবিজ্ঞান, বাঙ্গালী মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার।
• হিন্দু রসায়নী বিদ্যা।
• মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১৪৫ টি।

পি সি রায়কে নিয়ে রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী
১। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জীবন ও সাধনা: অধ্যাপক এম কে আলী।
২। জীবন স্মৃতি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: জয়ন্ত কুমার ঘোষ।
৩। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়: শেখ শাহাদাত হোসেন বাচ্চু।
৪। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয় (জনকণ্ঠের সাপ্তাহিক প্রতিবেদন – ০৫ মে, ২০০২): অমল সাহা। ৫। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় উপমহাদেশে রসায়নশাস্ত্রের পথিকৃৎ (মাসিক সায়েন্স ওয়ার্ল্ড এর নিবন্ধ) – সুব্রত দাশ সোনা; বর্ষ ৫, সংখ্যা ৫৬, আগস্ট ২০০৬।

ভারতবর্ষের এই রসায়নবিদ ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞান শিক্ষক, কবি, দার্শনিক। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মার্কারি নাইট্রেটের আবিষ্কারক। এছাড়াও তিনি তার জীবদ্দশায় ১২ টি যৌগিক লবণ এবং ৫ টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন একজন শিল্প উদ্যোক্তা। এই মহান বাংলাদেশি রসায়নবিদ ১৯৪৪ সালের ১৬ই জুন মৃত্যুবরণ করেন।
Feature Image Courtesy: shikkhasova.files.wordpress.com
References:
1. “Proceedings of the Chemical Society”। Proceedings of the Chemical Society।
2. “Obituary: Sir Prafulla Chandra Ray”। Journal of the Indian
Chemical Society।
3. দেশবিদেশ পত্রিকা
4. সব বাংলায়
5. আনন্দবাজার
6. কোলকাতা নিউজ